কোভিড-১৯-এই মহাদুর্যোগে করণীয়
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২০, ১৫:৪৭
করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী নিয়ে এনেছে মহাদুর্যোগ। ইতিহাস বলে- অন্যান্য মহামারি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রতিষেধক আবিস্কার হয়েছে দ্রুততর সময়ে। সার্স ২০০৩ সালে যেভাবে বিস্তার লাভ করেছিল, এই শতাব্দীতে সেটাই ছিল জনস্বাস্থ্যজনিত সংক্রামক রোগের আলোচ্য বিষয়। সার্স গড়ে প্রতি মাসে একটি বা দুটি পরিব্যক্তি বা মিউটেশনের মাধ্যমে। কিন্তু কোভিড-১৯ প্রতিনিয়ত জিন পরিব্যক্তি ঘটিয়ে বিচিত্রভাবে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা প্রতিষেধক আবিস্কারে বা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রতিনিয়ত ব্যস্ত রয়েছেন। এই প্রবন্ধ যখন লিখছি তখন বাংলাদেশে মোট সংক্রমিত রোগী চিহ্নিত হয়েছে ৪৮ জন, আর মৃত্যুবরণ করেছেন পাঁচজন। সংখ্যা জ্যামিতিক গতিতে বাড়তে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে আসা প্রবাসী অনেকেই হয়েছেন পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু বা সংক্রমণের কারণ। তারা অনেকেই সরকারি নির্দেশনা মানেননি এবং বাড়িতে অন্তরীণ বা পরিবারের সদস্যদের থেকে আলাদা থাকেননি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ বা আংশিক লকডাউন করার কথা বলেছে। এবং বর্তমানে আমরা আংশিক লকডাউনে আছি। তবে সবাই মানছি কিনা- সেটাই প্রশ্ন। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, এটি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংক্রমণ প্রতিরোধ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করে এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রচারমাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিশেষজ্ঞ পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে, মানুষ কীভাবে জনসমাগম থেকে দূরে থাকবে; হাত ধোয়ার শিষ্টাচার পালন করবে; পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে এবং অসুস্থতার ক্ষেত্রে কোথায় যোগাযোগ করবে। অনেকেই নানা ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচাই-বাছাই না করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাই বিশেষজ্ঞ পরামর্শগুলো জানা জরুরি।
মনে রাখতে হবে, বিশ্বব্যাপী এই প্যানডেমিক বা মহামারি থেকে আমরা কেউই নিরাপদ নই। উন্নত দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে। আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশের পদক্ষেপ তাই বাস্তবতার নিরিখে নিতে হবে। এই মহাদুর্যোগে শ্রেণিভিত্তিক সমাজে সবাই একইভাবে ঝুঁকিপ্রবণ নয়। নাজুক জনগোষ্ঠীর ঝুঁকিগুলো আগেই নিরূপণ করতে হবে। সবাই একই রকম সচেতন বা সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে প্রস্তুত নন। দেশব্যাপী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যারা ছিলেন- বর্তমানের সে সংখ্যা অনেক বেশি হবে। সমাজে প্রতিবেশী বা সচ্ছল জনগোষ্ঠীর সবাই কিন্তু 'সামাজিক দূরত্ব' বজায় রাখছেন। তাই বিকল্প ব্যবস্থায় সেবা ও ত্রাণকার্যে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান- (যেমন, সরকারিভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়) ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবীণ দিনমজুর, দরিদ্র ও প্রান্তিক এলাকায় বসবাস করা জনগোষ্ঠী তাদের মধ্যে গর্ভবতী নারী, শিশু সবাই রয়েছেন।
বর্তমানে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাদের কাছে ব্যক্তিগত সুরক্ষার সরঞ্জাম বা পিপিই সরকারি হাসপাতালে ইতোমধ্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা। তবে সেগুলো সম্পূর্ণ সুরক্ষামূলক হওয়া প্রয়োজন। শুনেছি, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পিপিই ব্যবহার হচ্ছে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটিতে। অনেকেই চলে গেছেন বাড়িতে অন্তরীণে। এতে অন্য রোগীদের পড়তে হচ্ছে বিপাকে। এই অবস্থা চললে মৃত্যুর মিছিলে যোগ হবে আরও অনেকে। বিভিন্ন সংস্থা (যেমন, যারা তৈরি পোশাক বা নকশি ব্যাগ ইত্যাদি তৈরি করতেন) তারা পিপিইতে শিল্পকে নিয়ে যেতে পারেন। শুনেছি, দু-একটি সংস্থা তা করছে। আমরা তাদের অনলাইনে ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করতে পারি।
সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বর্তমানে মানুষকে ঘরে রাখার কাজে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে। এ ছাড়া যারা জরুরি সেবা কাজে নিয়োজিত- সংবাদকর্মী, অফিসে কাজ করতে হচ্ছে তাদের ঝুঁকি কমানোর জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা যদি স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান থেকে নিজ নিজ জরুরি সেবাদানকারীদের জরুরি উপকরণ সরবরাহ করি, তবে নিরাপদ থাকবে তাদের জীবন-পরিবার-সমাজ।
এই মহাদুর্যোগে জনস্বাস্থ্যই নয়, পুরো বিশ্ব যাচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দার দিকে। করোনা ভাইরাস, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও সহনশীল মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এখন থেকেই না নিলে এই অর্থনৈতিক সংকটের দুষ্টচক্রে আবর্তিত হবে সমগ্র মানব জাতি। দুর্যোগপূর্ণ দেশগুলো বেশি নাজুকতায় পড়বে এই চিন্তা মাথায় রেখে বাংলাদেশকে করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। পূর্বের দুর্যোগগুলো মোকাবিলা থেকেই বাংলাদেশ নিয়েছে পূর্বপ্রস্তুতি। কোভিড-১৯ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় মহামারির দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে। মহড়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেসব খাত থেকে আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছিল- যেমন পোশাক শিল্প তাদের জন্য যেমন, তেমনি অন্যান্য খাতের কর্মজীবীদের কথা শুধু সরকার নয়; সামর্থ্যবান সব মানুষকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। অধীনস্তদের বেতন-বকেয়া অগ্রিম দিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। বেসরকারি খাতে নিয়োজিতদের কাজ বন্ধ। তাদের সহায়তার পথ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
লেখকদ্বয় :অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম প্রকাশ: সমকাল, ২৯ মার্চ, ২০১০