পুরুষ তুমি কাঁদতে শেখো
প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ২৩:০৪
বাচ্চা জন্মানোর পর বেশ কিছুদিন তার নিজস্ব কোনো বোধ থাকে না, সে ছেলে না মেয়ে। সেই সময়ে, তাকে ব্যথা দিলে সে কাঁদে। সে ব্যথা পেলে, কাঁদে। সেটাই হিউম্যান ইন্সটিংক্ট। সেটাই স্বাভাবিক। সেটাই মানুষের বেসিক নেচার। কিন্তু একটা বয়সের পর থেকে ছেলেদের ক্রমাগত শেখানো হতে থাকে, "কাঁদতে নেই, তুমি না ছেলে?" এবং মেয়েদের কাঁদতে আরো উৎসাহ দেওয়া হয়। ফলে, মেয়েরা কাঁদতে শেখে, এবং ছেলেরা কান্না চাপতে শেখে। এর চেয়ে 'অমানবিক' বোধয় আর কিছুই হয় না।
প্রত্যেক মানুষই, বৈজ্ঞানিকভাবে, পুরুষ ও নারীসত্ত্বা দুইই নিয়ে জন্মায়। তার জেন্ডার ডিসাইড করে কোন সত্ত্বাটা প্রাধান্য পাচ্ছে। কোন হরমোন ডমিনেট করছে। কিন্তু থাকে তো দুটোই। মানুষ এই যে 'নারী' ও 'পুরুষ' হয়ে ওঠে, এটা হরমোনের চেয়ে অনেক বেশী সোশ্যাল স্কুলিং-এর মাধ্যমে। একটি পুরুষ সন্তানের মাথায় ব্রেনওয়াশ করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তার 'পৌরুষ'। তাকে এই ঢপটা ক্রমাগত খাইয়ে যাওয়া হয়, যে সে 'শ্রেষ্ঠ', সে 'শাসক', সে যা করছে সেটাই উৎকৃষ্ট। এবং যা কিছু 'মেয়েলি', তা নিকৃষ্ট। যেমন চুড়ি পরা, কাঁদা, মন খারাপ করা, কেউ নির্যাতন করলে নালিশ করা, ইত্যাদি। এগুলো 'মেয়েলি'। আর বুক চিতিয়ে লড়ে মরা, মুখ বুজে কান্না চাপা হল 'পৌরুষ'।
একসময়ের মানুষ নিজের সার্ভাইভালের খাতিরে এই নিয়ম ইম্পোজ করেছিল। কেন? কারণ তাকে শিকার করে খেতে হত। কিন্তু গর্ভাবস্থায় নারী শিকার করতে পারে না। তাই কনভিনিয়েন্ট এটাই হত, যে পুরুষ শিকার করে আনুক, আর নারী ঘরে থাকুক, বাচ্চা পালুক। সেই আদিম যুগ আমরা মিউজিয়ামে ফেলে এসেছি। এখন পুরুষ-নারী কাউকেই শিকার করে খেতে হয় না। উভয়ই রোজগার করতে পারে, এবং সমান রোজগার করতে পারে। গর্ভাবস্থার ওই ন'মাসের জন্যেও নারী সঞ্চয় করে রাখতে পারে (শিকার করা খাদ্য নয়, যা পচে যাবে, বরং ক্যাশ, যা ব্যাংকে সুদে বাড়বে), কোনো অসুবিধেই নেই। কিন্তু এতই স্মৃতিকাতর আমরা, যে সেই মানসিকতাটাকে আমরা এখনো বয়ে বেড়াই, প্রতিপালন করি, রীতিমত লালন করি। কেন?
নারীর যেমন পুরুষের মত মারতে শেখা প্রয়োজন, পুরুষেরও তেমনই নারীর মত কাঁদতে শেখা প্রয়োজন। ভারতীয় ফিলসফি আমাদের সৃষ্টির আদি রূপ হিসেবে অর্ধনারীশ্বর দেখিয়েছে, কিন্তু আমাদের ডার্টি মাইন্ড শুধুই সেক্স পজিশন দেখেছে। যাকগে। কথা হল, পুরুষ কাঁদতে না পারলে কী হয়? চরম ডিপ্রেশন। যা থেকে আসে সেই সিচ্যুয়েশন, যেখানে নারীদের তুলনায় বেশীসংখ্যক পুরুষ আত্মহত্যা করছে ভারতে। শুধু বিবাহিত পুরুষ নয়। ওটা ডিস্টর্শন অফ ফ্যাক্ট। সব পুরুষই। ডেটায় 'বিবাহিত পুরুষ' দেখা যাচ্ছে কারণ অধিকাংশ পুরুষই বিবাহিত। কারণ কী দেখাচ্ছে ডেটা? 'সাংসারিক ও বৈবাহিক সমস্যা'। সেটা এক্স্যাক্টলি কী? কেউ জানে না। কেন জানে না? কারণ পুলিশ রেকর্ড নেই। কোনো আইনি নালিশ জানানো হয়নি। কোনো তথ্য নেই।
এবার, মেয়েরা কি সাংসারিক ও বৈবাহিক সমস্যায় আত্মহত্যা করছে না? অবশ্যই তারাও করছে। প্রচুর সংখ্যক মেয়ে। সেই সংখ্যাটা পুরুষদের চেয়ে কম। কিন্তু প্রচুর। প্লাস, মেয়েরা শুধুমাত্র বধুহত্যা এবং পণ-সংক্রান্ত হত্যার শিকার হচ্ছে প্রতিদিন ২১ জন করে। টোটাল করলে সংখ্যাটা যা দাঁড়াবে, তাতে 'কে বেশী মরল, আমরা না ওরা?' - এই কাব্যিক প্রশ্নটির উত্তরে যে হার্ড ফ্যাক্টটি আসবে তা 'মেনস রাইটস আ্যক্টিভিস্ট'দের পছন্দ নাও হতে পারে। কিন্তু সেদিকে যাচ্ছিই না। এই মূহুর্তে বেচারী পুরুষদের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল ফিল করছি। তারা এমন 'চুপিচুপি একা একা' মরে যায় কেন?
সজ্জনেরা বলবেন, কারণ তো পরিস্কার। মেয়েরা সাংঘাতিক রকম বর পেটাচ্ছে। বরগুলো আইনের ফাঁদে পড়ে কেউ কিচ্ছু বলতে পারছে না। তাই সুইসাইড। আচ্ছা। আমি না হয় মেনে নিলাম। নারীবাদীরাও না হয় মেনে নিল। কিন্তু আজ ভারতের সমস্ত নারীবাদী যদি সমস্বরে বলে ওঠে, 'আমাদের পুরুষেরা বড়ই বিপন্ন!' আইন কিন্তু বদলাবে না। কারণ আইন বদলানোর একটা প্রসেস আছে। সেই প্রসেস তথ্যনির্ভর। কোথায় কোন হারামি আইনজীবি কূটপ্রশ্ন করে বসবে, 'আচ্ছা... এই যে মিনসেরা গলায় দড়ি দিল, বউ পিটিয়েছে বলেই তারা মরেছে তার প্রমাণ কোথায়? এবারে ফসল ভালো হয়নি, লোন শোধ করতে পারবে না বলেও তো মরে থাকতে পারে। তারপর... বউ কচি প্রেমিকের সাথে ভেগে গেছে বলেও তো মরে থাকতে পারে। এমনকী, বউকে পেটাতে গেছিল, বউ উলটে ঝ্যাঁটাপেটা করেছে বলেও তো...'। ওয়েল? এই হারামি আইনজীবিটির মুখ বন্ধ করা যাবে কী উপায়ে? কোথায় সেই ডেটা, যা প্রমাণ করছে সংসারে 'নারীতান্ত্রিক' অত্যাচারের শিকারই হয়েছে এই পুরুষগুলো?
আচ্ছা, এটা বাদ দিন। ইন জেনেরাল, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের আইন জেন্ডার নিউট্রাল নয় কেন? সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের আইন জেন্ডার নিউট্রাল নয় কেন? কেন আইন এখনো বোকাচোদার মত বলে যৌন হেনস্থা মানে 'আউটরেজিং দ্য মডেস্টি অফ আ উওম্যান'? ধর্ষণের আইন কেন জেন্ডার নিউট্রাল নয়?
কারণ? তথ্য। নেই। জাস্ট নেই।
কেন নেই? কারণ পৌরুষ। সিম্পল। পুরুষেরা যৌন হেনস্থা হলে হেসে উড়িয়ে দেয়। 'খিল্লি' করে। ধর্ষিত হলে চেপে যায়। লোকে কী বলবে? বউয়ের হাতে মার খেলে লজ্জায় সুইসাইড করে। তবু কমপ্লেইন করে না। তথ্য জোগাড় করে না। একজোট হয়ে অধিকার দাবী করে না। পুলিশের কাছে যায় না। কারণ এতে তাদের 'পৌরুষ' নামক বায়বীয় মেল ইগো ধুলোয় মিশে যাবে। তার চেয়ে তারা নিজেরাই ধুলোয় মিশে যাওয়া প্রেফার করে। এবং সবচেয়ে হাস্যকর যেটা, তা হল তারা মনে করে, যে এটা বীরত্ব। এইটাই সবচেয়ে কমিক। এবং ট্র্যাজিক।
মাইক্রফট হোমস বিবিসি'র 'শার্লক' সিরিজে ওয়াটসনকে বলেছিলেন, "Bravery is the kindest word for stupidity, don't you think?"
Well, in this case, I certainly do.
ভারতীয় জুডিশিয়াল সিস্টেমে আগে আইন এবং তারপর তথ্য আসে না। আগে তথ্য আসে, তারপর আইন। তাই চারিদিকে এত হাহাকার সত্ত্বেও আইন খুব একটা বদলাবে না। আইন কীভাবে বদলায়? যখন সার্ভে করে, তথ্য এনে, দেখানো হয় যে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স হচ্ছে, সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট হচ্ছে। নারীদের পক্ষে প্রত্যেকটা আইন এভাবেই এসেছে। কিছু বাতেলাবাজ পুরুষ এখন একদিকে বলছে 'আইন জেন্ডার নিউট্রাল নয়', এবং অন্যদিকে বলছে 'মেল ইগো হল পুরুষের অলংকার'। তারা ঠিক চায়টা কী? সমস্ত আইনকানুন উঠে গিয়ে সমাজ মধ্যযুগে ফিরে যাবে? না কি মেয়েরা তাদের হয়ে আন্দোলনটা করে দেবে? ওয়েল, সেক্ষেত্রে তাদের করুণা ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার নেই। আর তারা যদি মনে করে যে তারা মেল প্রিভিলেজ না ছাড়তে পারলেও মেয়েরা স্বেচ্ছায় নিজেদের 'ফিমেল প্রিভিলেজ' ছেড়ে দেবে, তাহলে বিষয়টা আরোই করুণ। কারণ মাদার টেরেজা মেয়ে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু মেয়েমাত্রেই মাদার টেরেজা নয়।
আন্দোলন করে নিজের অধিকার কীভাবে ছিনিয়ে নিতে হয়, কীভাবে কেঁদে বোঝাতে হয় ব্যথা লাগছে, তা মেয়েরা শিখিয়েছে। তারা মুখ বুজে কান্না চেপে ইগো অক্ষত রেখে আত্মহত্যা করেনি। ইগোর তোয়াক্কা না করে বাস্তব লড়াইটা করেছে। কারণ তারা জানে, দিনের শেষে, পালিয়ে যাওয়া একধরণের ভীরুতাই, যতই তাকে 'পৌরুষ' বলে গ্লোরিফাই করা হোক। কাঁদতে, চিৎকার করতে, যন্ত্রণা এক্সপ্রেস করতেও সাহস লাগে। কিছু ক্ষেত্রে, সেটাই বীরত্ব। কারণ সেটা ক্ষতটা দেখাতে ও চিকিৎসা হতে সাহায্য করে। তারা পুলিশে গেছে, রেকর্ড ও প্রমাণ রেখেছে, তথ্য এনেছে। সেই তথ্য দেখিয়ে আইন আদায় করেছে। খুব সহজ নয়। বহুদিন লেগেছে। বহু ব্যর্থতা পেরোতে হয়েছে। একসময়ে মেয়েরা 'যৌন হেনস্থা' হয়েছে, ধর্ষিতা হয়েছে, শুনলে লোকে খিল্লি করত না, ছিছি করত। মেয়েটাকে 'বেশ্যা' বলত। আর বর যে বউকে পেটাবে, সেটাই 'স্বাভাবিক' ছিল। আর সেই সময়টা খুব বেশী দিন আগেও নয়। সেখান থেকে এখানে পৌঁছতে সাহস এবং বাস্তববুদ্ধি প্রয়োজন হয়েছে। ইগোকে গলার দড়ি বানালে সেসব হত না।
তাহলে, কী করবেন, হে পুরুষ? কাঁদতে এবং লড়তে শিখবেন? না কি পৌরুষের অহংকার বুকে জড়িয়ে কান্না চেপে বীর সাজবেন? কাঁদতে যদি শিখতে পারেন, তাহলে আইনে সাম্য আসতেও পারে। কারণ মেয়েরা তো মারতে খানিক শিখে গেছে। কিন্তু যদি সেই কান্না চেপে বীরত্বের ধূসর প্রান্তরে আপন পৌরুষটি ধরে বসে থাকেন, তাহলে মার খাবেন, এবং পাল্টা মারতে গেলে কেস খাবেন। মেয়েদের 'অশ্লীল' দৃষ্টিতে দেখলে পাব্লিক ক্যালানি খাবেন, কিন্তু আপনার শ্লীলতার পরোয়া কেউ করবে না। আপনি নিজেও না। যৌন হেনস্থার শিকার হয়ে আপনি খিল্লি করতে থাকবেন... বউয়ের হাতে মার খেয়ে মদ গিলতে থাকবেন... তারপর একদিন মেল ইগোর 'সম্মান' রক্ষার্থে টুপ করে ঝুলে পড়বেন। এবং আপনাকে নিয়ে কেউ কবিতাও লিখবে না। ভাবুন একবার।
এখন, রবীন্দ্রনাথকে 'নারীবাদী' বললে অনেকে রে রে করে তেড়ে আসে। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাই বলছি না। শুধু 'স্ত্রীর পত্র' থেকে চার লাইন কোট করার লোভ সামলানো গেল না। এমনিই।
"তোমরা বললে, 'এ-সমস্ত নাটক করা।' তা হবে। কিন্তু নাটকের তামাশাটা কেবল বাঙালি মেয়েদের শাড়ির উপর দিয়েই হয় কেন, আর বাঙালি বীরপুরুষদের কোঁচার উপর দিয়ে হয় না কেন, সেটাও তো ভেবে দেখা উচিত।"
অধীশা সরকার এর ফেসবুক থেকে