লাভটা কী?
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০১৮, ১৭:৩৪
যারা এই লেখা পড়ছেন তাদের সম্ভবত একশত ভাগ আমার সাথে সহমত জানাবেন যে জীবনের কোন না কোন সময়ে তিনি এই প্রশ্নটি শুনেছেন - “এতে তোর/ তোমার/ আপনার লাভ?” বহুল প্রচলিত প্রশ্ন, বিশেষ করে যখন কেউ একজন কোন কাজ করবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে কিন্তু মাথা কুটে মরেও আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যমান কোন মুনাফা বা সুবিধা প্রাপ্তির তেমন আশা দেখা যাচ্ছে না। আমি অতি ক্ষুদ্র মানুষ, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি আসলে লাভবিহীন তেমন কোন কার্যক্রম এখনো করে উঠতে পারিনি - সাধ অনেক, সাধ্য নেই। কিন্তু কেউ কিছু করুক আর না করুক, এই প্রশ্নের হাত থেকে রেহাই নেই।
প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলাম সেই ছোটবেলা থেকেই। ক্লাস ফোরে যখন পড়ি, তখন আমি একদা একজনের সাথে কাড়াকাড়ি করে আমসত্ত্ব খেতে একেবারে পিছনের সিটে গিয়ে বসেছিলাম। আরেক বন্ধু যে কিনা প্রাণের চেয়ে প্রিয় ছিল, আসতে দেরী করেছিল। প্রাণের বন্ধু এসে আমার অবস্থা দর্শনে শিহরিত, শঙ্কিত এবং হতাশ। সে আমাকে ডেকে নিয়ে যে উপদেশ দিলো তার সারমর্ম হচ্ছে তার আম্মিজান এক থেকে বিশ রোল নং এর বাইরে যেসব ছাত্রী, তাদের সাথে মিশতে মানা করে দিয়েছেন। সে আরো জানালো যে তারা অত্যন্ত খারাপ ছাত্রী বিধায় খারাপ মানুষ, সম্ভবত পরিবারের অবস্থাও খারাপ। তাদের সাথে মিশলে উচ্ছন্নে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন ফলাফলের আশা দুরূহ। আমার নিজের রোল নং তখন ত্রিশ-চল্লিশের ঘরে, বন্ধু হারানোর শঙ্কায় তাকে অনুরোধ করলাম সে যেন তার মাকে আমার রোল না জানায়। তাতে সে উত্তর দিয়েছিল, আমাকে নিয়ে তার মার কোন সমস্যা নেই, তার মা জানেন আমার বাবা ডাক্তার; রোল নং ত্রিশের ঘরে থাকা একটা দুঃসময় ছাড়া আপাতত আর কিছু নয়। আমার প্রতি তার আম্মার আস্থায় আমি তখন ছিলাম কৃতজ্ঞ, জ্ঞান হবার পর তার মানসিকতায় হয়েছিলাম শঙ্কিত। মেয়ে কার সাথে মিশবে, এতেও সেই প্রশ্ন - “ওর সাথে মিশলে লাভ কি?”
লাভের খবর পাইনি, তবে ফাঁপা অহংবোধ ছাড়া যে পৃথিবীতে দাম নেই, সে ব্যাপারটি টের পেয়েছিলাম। ত্রিশ থেকে হঠাৎ করে পাঁচের মাঝে চলে আসায় অনেক বন্ধু হারিয়েছিলাম। অঙ্কে ফেল করা বন্ধুটি আমার সাথে পরিষ্কারভাবেই বন্ধুত্ব ভেঙেছিল; বলেছিল আমার ভালোর জন্যই। এখন আমাকে প্রথম সারিতে বসতে হবে, সেখানে সে বেমানান; তার সাথে থাকলে অন্য কেউই আমাকে গ্রহণ করবে না। ঘটনা নির্মম হলেও সত্য ছিল; কিন্তু মনের মণিকোঠায় তাকে এখনো রেখে দিয়েছি। ক্লাস ফোরে সে আমাকে নিজের হাতে একটি কার্ড বানিয়ে দিয়েছিল। গোলাপ বানান ভুল করে লিখেছিল ‘গোলাফ’। কেউ হয়ত বললে বিশ্বাস করবে না, কার্ডটি আমার কাছে দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত সযত্নে ছিল; সম্ভবত এখনো দেশের বাসায় সেভাবেই আছে।
এরপর আসলো নোটের যুগ। টাকা দিয়ে স্যারের কাছে পড়ছি, ওই নোট অন্যকে দিলে আমার লাভ কি? বরং ক্ষতিই ক্ষতি। একবার একজনকে আমার হাতে বানানো নোটস দিয়ে দেয়ায় সে আমাকে এসে বলেছিল যে তার বাবা আমাকে বলেছে এঞ্জেল; কারণ এ কাজ কেউ করে না। এতে খুশি না হয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম, কেউ না করলে আমি করলে পিছিয়ে পড়বো না তো? মাথায় দশ রকমের জিনিস সবসময় ঘুরতে থাকায় সেটি নিয়ে মাথা ঘামাইনি এবং আমার ভাগ্য যে ঘামাইনি। কারণ সুদে আসলে তা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে আমার বন্ধুরা। প্রতিটি পরীক্ষার পাসের জন্য অগণিত মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ। এক বন্ধু একটু অলস হতেই পারে, তাই বলে কি তাকে বাঘের সামনে বন্দুক ছাড়া পাঠানো যায়? কিন্তু এখন যখন চিন্তা করি যে কি ভয়াবহ একটা শিক্ষাই না আমরা পাই চারপাশ থেকে! সফলতার মূল মন্ত্র হচ্ছে নিজে পরিশ্রম করা এবং সাথে অন্যকে সাহায্য করা থেকে শত হস্ত দূরে থাকা।
আর একটি ভয়াবহ উৎকট উদাহরণের কথা মনে পড়ছে, না বলে পারছি না। বিসিএস প্রিলি পরীক্ষা দিতে গিয়েছি। একেবারে মেডিকেলের রোল ধরেই বলতে গেলে সিট পড়েছে। তবে বিসিএস কর্তৃপক্ষও কম চালাক না, মাঝ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি অঙ্কে ভয়াবহ কাঁচা, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নই। সিফাত-মুনমুন কেউ না কেউ আমাকে টেনে তুলে ফেলবে; খাদে আমি পড়বো না - এরকম নিশ্চিন্ত। আমার মত নিশ্চিন্ত না হলেও আমার পিছনের মেয়েটি তার ব্যাচমেটকে ঠিক তার পাশে আবিষ্কার করে উল্লসিত। কিন্তু পরীক্ষা শুরু হবার পর আমি হতভম্ব হয়ে শুনলাম যে মেয়েটির ব্যাচমেট তাকে সব ভুল উত্তর বলে দিচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত অকাজে আমার চোখ-কান বেশি কাজ করে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে ব্যাচমেট নিজের খাতায় লিখেছে উত্তর সি আর বলে দিচ্ছে ডি। শেষমেশ সহজ একটা ইংরেজি বানান যখন ভুল বলে দিলো ধৈর্যহারা হয়ে মেয়েটিকে আমি ঠিক উত্তর বলে দিলাম। মেয়েটি আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার ব্যাচমেটের বলা উত্তরটিতেই দাগ দিলো। কারণ লাভ ব্যতীত অচেনা ব্যক্তি সাহায্য করবে? নির্ঘাত আমাকে লেঙ্গি মারার ধান্ধা! তবে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে; এ কারণে ওই ব্যাচমেট সি দাগিয়েও সুবিধা করতে পারার কথা না - কারণ উত্তর ছিল এ।
উদাহরণ দিতে গেলে আসলে একটা ছোট বই হয়ে যাবে; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একটা কথা না বলে পারছি না। আমি যখনই অন্য দেশের কারো জন্য কিছু করেছি, তারা এখনো পর্যন্ত কেউ আমাকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা ছাড়া অন্য কোন প্রশ্ন শুধায়নি। কিন্তু একবার এক বন্ধুর অনুরোধে এক জায়গায় আমি ফ্রি এএমসির ক্লাস নিচ্ছিলাম, এক বাঙালি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “কেন আপু, আপনার লাভ কি?” থতমত খেয়ে উত্তর মাথায় আসছিলো না, আমতা আমতা করে বললাম, “এই তো, মানে এই ইনফো টিনফো পেলে সবার একটু সুবিধা হবে।” আপুটির দৃষ্টির সামনে লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম, স্পষ্ট লেখা ছিল - “ওয়েল, ইউ আর নট টেলিং মি সামথিং।” এর পরের প্রশ্নটি ছিল আরো ভয়াবহ - “আপনার জব হচ্ছে না এখনো, ডিএমসির স্টুডেন্ট!” মানীর মান আল্লায় রাখে, তখন আসলে আমি রেজিস্ট্রেশনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তাকে সেটা জানাতেই সে আরো বিরক্ত হয়ে যা বলেছিল তার মূল বক্তব্য হচ্ছে কোন লিঙ্ক ছাড়া চাকুরি পাওয়া যায় না। মনে মনে ভাবছিলাম - অন্যের ত্রুটি/ দুর্বলতা খোঁজার জন্য উনি যে চেষ্টাটা করছেন, তার ২০ ভাগ জব-হান্টিং এ দিলেই চাকরি হয়ে যেত। প্রশ্ন হচ্ছে তার এই মানসিকতার জন্য কি একশত ভাগ তিনিই দায়ী?
শেষবেলায় আরেকটি সত্য গল্প - আমার জনাবের অজি বন্ধুর। ছেলেটি এক বন্ধু নিয়ে মালয়েশিয়া ঘুরতে গিয়েছে। এক রাস্তার মোড়ে যখন ম্যাপ, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিয়ে হিমশিম অবস্থা তখন এক ব্যক্তি যে তাদের কথা-বার্তা পাশ থেকে শুনে ফেলেছিল, এগিয়ে এসে একটা চাবি দিয়ে বললো, “তোমরা গাড়ি চালাতে পারো? তাহলে আমার গাড়ি নিয়ে ঘুরতে পারো।”
অজি ছেলেটি হতভম্ব হয়ে গেলো, “ইয়ে গাড়ি দিয়ে দিচ্ছ?”
“হ্যাঁ, আমার অফিস শেষ অমুক সময়ে, তার মাঝে গাড়িটি এইখানে পার্ক করে যেও।”
“আমাদের তো তুমি চেন না।”
“তাতে কি? সময়টা একটু খেয়াল রেখো।”
অজি ছেলে আর তার বন্ধু মহানন্দে গাড়ী নিয়ে ঘুরে বেড়ালো।
সে যখন এই গল্প আমার জীবনসঙ্গীকে উচ্ছ্বাস নিয়ে করছিল যে এশিয়ার মানুষ কত ভালো এবং গাড়ী নিয়ে সে কি রকম সাবধানে চালিয়েছে যাতে কিছু না হয়, তখন আমার জনাব চিন্তিত সুরে তাকে বললো, “কিন্তু এমন যদি হত যে গাড়িটি চোরাই?”
অজি ছেলে হা করে তাকিয়ে থেকে বললো - “সে তো আমার মাথাতেই আসেনি!”
আর সে যখন বাসায় ফিরে আমাকে গল্পটা বলছিল তখন আমি মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করছিলাম, কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম যে গল্পের শেষ হবে অজি ছেলের হাজত বাস দিয়ে। নির্ঘাত গাড়িতে ড্রাগস, আর ওই ব্যাটা পুলিশে খবর দিয়েছে এই ভ্রমণকারীকে গাড়ি দিয়ে।
কিন্তু কিছুই হয়নি, চমৎকারভাবে গল্প শেষ হয়েছে। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের জয় হয়েছে।
এবারে বলুন, আমরা যে সবাই সাদা-সুন্দর ভাবে চিন্তা না করে, জগতের কুটিল দিকগুলো নিয়ে আতঙ্কে থাকি, তার জন্য দায়ী কে? সম্ভবত আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ের পারিপার্শ্বিকতা।
পারিপার্শ্বিকতা কাদের দিয়ে তৈরি? - আমরা।
সুতরাং বদলাতেও আমাদেরই হবে। এখানেও কিঞ্চিত সমস্যা আছে, অনেকে বলে, “লাভ কি? আমার জীবদ্দশায় তো কিছুই হবে না।” সম্ভবত সত্য। যদিও আত্মায় ভাঙন ধরেছে খুব দ্রুতই (বাংলাদেশের বয়সই মোটে ৪৭ বছর), ধরলাম আত্মায় শুদ্ধতা আনতে না হয় ৯৪ বছরই লাগলো। কিন্তু তারপরেও শুরু তো করতে হবে, মানুষ হিসেবে যাবতীয় সুবিধা ভোগ করবো কিন্তু দায়ভার নেবো না, সে তো হতে পারে না। যাদের এখনো সন্দেহ আছে, তারা শান্ত মাথায় একটু নিজ নিজ জীবনের কথা চিন্তা করুন - আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা থেকে এই পর্যন্ত। অবাক হয়ে খেয়াল করবেন যে জীবনের যা প্রাপ্তি তার পিছনে পিতা-মাতা সহ পরিচিত-অপরিচিত অসংখ্য মানুষের অবদান। সত্যি বলতে কি, কোন কিছুই আপনার একার অর্জন নয়। আপনার পরিশ্রম আর একাগ্রতার পাশে সহায়তা দিয়ে গেছে কেউ না কেউ, লাভের আশা না করেই। সকলেই যদি নিজের মুনাফা ছাড়া কিছুই না দেখতো, তবে আপনি এখন কোথায় থাকতেন?
প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ‘এতে আমার লাভটা কি’ বদলে ‘এতে কারো ক্ষতি হবে না তো’ প্রশ্নটি করা শুরু করুন। নিজের কাজ গুছিয়ে সময় থাকলে সে সময়টুকুতে ‘মুনাফা বিহীন’ কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করুন। তাতে ব্যাংক-ব্যাল্যান্স হবে না সত্য, কিন্তু দিন শেষে মনে প্রশান্তি আসবে। আমরা যদি না জাগি মা, তবে কেমনে সকাল হবে?
সামারা তান্নির ফেসবুক থেকে