বাংলার প্রতিটা মেয়েই বাঘিনী হোক

প্রকাশ : ০৫ জুন ২০১৮, ১৩:৪০

সাদিয়া ইসলাম
যৌন হয়রানির দায়ে ছাত্রত্ব বাতিল হওয়া শিশির

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের জনৈক শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব বাতিল হয়েছে। কখনও ভাবিনি তাকে নিয়ে এমন নিউজ কখনও শেয়ার দিতে হবে। ভার্সিটি জীবনের প্রথম কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে সে একজন ছিল। আরও অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে যে কয়জনের অভিযোগের ভিত্তিতে তার ছাত্রত্ব বাতিল হয়েছে সে তাদের সবারই খুব কাছের একজন ছিল। কারো বন্ধু, কারো বড় ভাই, কারো ছোট ভাই, কারো আবার পরিচিত কিন্তু বেশ ভালই সম্পর্ক। প্রশ্ন জাগতেই পারে, কি এমন করেছিল ছেলেটা যাতে তার ছাত্রত্বই চলে গেল? অনেকেই ইনবক্সে নক দিয়ে জিজ্ঞাসা করে আসছিল, ছেলেটা তো ভালই ছিল। খেলাধুলা, এক্সট্রা ক্যারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ নিয়ে পড়ে থাকতো দেখতাম। কি এমন হলো যে তোমরা তার ছাত্রত্ব বাতিল চাইছো? কাউকে কখনও খোলাসা করে বলতে পারিনি। কারণ সে যা করেছে সেটা কাউকে বলার মতো না। আর বলবোই বা কার নামে? ভার্সিটিতে প্রথম যে ছেলেটাকে বন্ধু ভেবেছিলাম তার নামে?

ঘটনার শুরু লেবার ল পরীক্ষার আগেরদিন। শুনলাম, শিশির গ্রেফতার হয়েছে। পরে জানলাম এক ছোটবোনকে নাকি ফেসবুকে উত্যক্ত করেছে। আর সবার মতো আমিও ভেবেছিলাম, কিইবা এমন বলেছে যার জন্য পুলিশে দিতে হবে? ধীরে ধীরে জানলাম হয়রানির মাত্রা কতটা সীমা ছাড়িয়ে গেলে একটা মেয়ে পুলিশের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। মেয়েটাকে বিগত দুইটা কোর্সের পরীক্ষার আগ থেকে জ্বালাচ্ছিল। রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল করছিল আর অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। প্রস্তাবে রাজি না হলে যেসব হুমকি দিচ্ছিল তাতে যেকোনো মেয়েরই কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার কথা। মেয়েটা তাকে বারবার নিষেধ করেছিল এমনটা না করতে। কিন্তু সে তো তখন মানুষ ছিল না। থাকলে কি আর দিনের বেলা যাকে 'বোন' ডাকে, রাতেরবেলা ফেসবুকে তাকেই নিজের গোপনাঙ্গের দৈর্ঘ্য আর কামনা জানায়? 

একে তো পরীক্ষা চলছে, এর মধ্যে বাচ্চা মেয়েটার বাবা আবার হৃদরোগের পেশেন্ট। বাসায়ও জানাতে পারছে না। আর দশটা মেয়ে হলে যা করতো, ব্লক মেরে সেখানেই ঘটনাটা হয়তো শেষ করে দিতো। কিন্তু সে বুঝতে পেরেছিল এটা অবশ্যই তার কাছের কেউ করছিল। আর এভাবে তার জীবন যে নরক বানালো তাকে সে ছেড়ে দিতে চায়নি। এক বন্ধু আর বড় বোনের সাহায্য নিয়ে সে প্রথমে থানায় মামলা করলো। পরবর্তী ২ দিন নাওয়া-খাওয়া, ঘুম সব বাদ দিয়ে ফেক আইডিটির পেছনে তারা যাকে আবিষ্কার করলো তার জন্য প্রস্তুত ছিলনা কেউই। আরে এ তো সেই শিশির যার সাথে দুইদিন আগেও মেয়েটি একসাথে গ্রুপ স্টাডি করেছে। আগেরদিন সন্ধ্যায়ও যাকে তার অরিজিনাল আইডি থেকে ম্যাসেজ দিয়েছে, "ভাল করে পরীক্ষা দিস বোন, ফি আমানিল্লাহ"। কেমন করে বিশ্বাস করবে সে এই বড় ভাইটির ভেতরে এত কিছু ছিল? ধরা পরার পর কিন্তু বড় ভাইয়ের রূপ আবার বদলে গেল। কিছুক্ষণ আগেই যে ফেক আইডি থেকে ম্যাসেজ দিয়েছিল, "দেখি কি করতে পারো তুমি আমার" সে তখন পুরোই ভেজা বেড়াল। সবার চড় থাপ্পড় খেয়ে মেয়েটার পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইলো, বললো এমনটা সে 'না-বুঝেই' করেছে। আর তার বাবা খুবই অসুস্থ! এসব জানলে হার্ট অ্যাটাক করেই মারা যাবে। যদিও মেয়েটার অসুস্থ বাবার কথা সে ভাবেনি। কিন্তু নারী জাতি তো দয়ার সাগর, সবার অনুরোধের ভিত্তিতে সে ছেলেটাকে আরেকটা সুযোগ দেওয়ার জন্য শুধুমাত্র মুচলেকা নিয়েই ছেড়ে দিল। অথচ ঐ সময় যে পরিমাণ আলামত আর এভিডেন্স ছিল তাতে সে মামলা করলে ওর কমপক্ষে ৭ বছরের কারাদন্ড হয়ে যেতো।

ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু শেষ যে পরীক্ষা তাকে দয়া করে দিতে দেওয়া হয়েছিল, সেদিন সে আবার তার আগের রূপ দেখালো। মেয়েটাকে দেখে আড়চোখে হাসছিল, বান্ধবীদের কাছে গল্প করে বেড়াচ্ছিল, "আমার তো *লটাও ছিঁড়তে পারেনি" "আরে সময়মতো ম্যাসেঞ্জার থেকে লগ আউট করলে আমাকে ধরতেই পারতো না", আর মেয়েটাকে যারা সাহায্য করেছিল তাদেরকেও ব্যঙ্গ করছিল। এটা দেখা স্বাভাবিকভাবেই মেয়েটা আরো কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। এর মধ্যেই আমাদের এক সহপাঠী ওর ফেক আইডির লিংক দিয়ে পোস্ট করলো যে এই আইডি থেকে কারো কাছে ম্যাসেজ গেছে কি না। এরপর কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হওয়ার মতো বের হলো আরো বীভৎস দৃশ্য। খোদ আইন বিভাগেরই ২০-২৫ জন মেয়েকে সে একই ভাষায় ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। ম্যাসেজের বিষয়বস্তু মোটামুটি একই, সেই মেয়েকে দেখে তার কেমন অনুভূতি হয়, তাকে নিয়ে সে কি কামনা করে, সেটা সে কিভাবে কোথায় পরিপূর্ণ করবে, তার গোপনাঙ্গের দৈর্ঘ্য আর সেটা দিয়ে সে কিভাবে মেয়েটাকে সন্তুষ্ট করবে। আর হ্যাঁ, কিছু কিছু মেয়েকে সে হাজার দশেক টাকাও অফার করেছিল। কাউকে কাউকে পার্সোনাল লাইফের বিভিন্ন ইনফরমেশন নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। আর কমবেশি সবাইকেই একটা ফিশিং সাইটের লিংক পাঠিয়েছে আইডি হ্যাক করার উদ্দেশ্যে। 

আমরা সবাই তখন বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে। আমরা সবাইই ওর টার্গেট ছিলাম? জাস্ট আদার্স ফোল্ডারে ওর ম্যাসেজ সিন করিনি দেখি ভাগ্যজোরে বেঁচে গেছি? হ্যাঁ, দুই তিনজন ম্যাসেজ দেখেছিল, কেউ কেউ রিপ্লাই দিয়েছিল। কিন্তু তার বিকারগ্রস্তের মতো কথা বার্তা দেখে শেষে বিরক্ত হয়ে ব্লক মেরে দিয়েছে। একমাত্র সেই মেয়েটা দিনের পর দিন প্রচণ্ড মানসিক চাপ সহ্য করে ওর পেছনে লেগেছিল বলে ফাইনালি তাকে খুঁজে বের করা গেছে। ঘটনা এখানেই শেষ না। তার ফোন জব্দ করে সেখান থেকে জানা গেল ঐ আইডি থেকে সে শতাধিক মেয়েকে ম্যাসেজ দিয়েছে। আর কমবেশি সবাইই তার পরিচিত। তার আসল আইডিতে সবাইই ফ্রেন্ডলিস্টে আছে, ম্যাসেজে কমবেশি কথা বলে। এমনকি এক পেশাদার যৌনকর্মীর সাথেও সে দরাদরি করছিল! ভিক্টিমদের মধ্যে আইন বিভাগেরই ৪০ জনেরও বেশি, বাকিরা কেউ বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, কেউ ঢাকার, কেউ সিলেটের। ব্যাচেমট, সিনিয়র, জুনিয়র কাউকে বাদ দেয়নি। তার যে বেস্ট ফ্রেন্ড শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, তাকেও ছাড়েনি। মেয়েটা যখন জানলো এই কাজ ও করেছে, পুরো ট্রমাটাইজড হয়ে গেছিল। মজার ব্যাপার হলো ঐ আইডি থেকে যখন ওকে ডিস্টার্ব করা হচ্ছিল সে শিশিরের সাহায্যই চেয়েছিল সবার আগে!

এবার আমরা সবাই একত্র হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম একে ছেড়ে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। ও যেটা করেছে সেটা ভুল নয়, ক্রাইম। দিনের পর দিন প্ল্যান করে এতগুলো মেয়েকে এভাবে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করেছে। একজন রিপ্লাই দেওয়ায় দেখিয়ে দিয়েছে সে কতটা নিচে নামতে পারতো অন্যদের সাথেও। দুইজন থানায় মামলা করলো। কিন্তু নানাবিধ আইনী জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতার কথা ভেবে আর সর্বোপরি বাসা থেকে তুমুল প্রতিরোধের কারণে দুইটা মামলাই উইথড্র করা হলো বাধ্য হয়ে। এরপর আমরা গেলাম ডিপার্টমেন্টে, ভার্সিটি প্রশাসনে। আর কিছু না হোক, অন্তত ওর সাথে এক ক্লাসে বসা সম্ভব না, এক ডিপার্টমেন্ট এর বারান্দায় চলাচল করা সম্ভব না। আমাদের শ্রদ্ধেয় চেয়ারম্যান স্যারসহ ছাত্র উপদেষ্টা ম্যাম, প্রো-ভিসি স্যার এবং ভিসি স্যারও আমাদের সর্বোচ্চ সাপোর্ট দিয়েছেন। প্রথম থেকেই যার কাছেই গিয়েছি, তিনিই আশ্বাস দিয়েছেন তার জায়গা থেকে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন এরকম মানসিক বিকারগ্রস্ত ও বিকৃত যৌনরুচিসম্পন্ন ছেলেকে ন্যূনতম শাস্তি দিতে।

এর মধ্যে আমরা শুনলাম শিশির রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে আর আমাদের ব্যাপারে তখনও উত্তপ্ত বাক্য ছড়িয়েই যাচ্ছে। তার মধ্যে দুই একটা বাণী শোনাই, "*দে দিয়ে আসিনি তাই এত লাফাচ্ছে মা*রা। একবার এইগুলা মিটে যাক, সব কয়টাকে দেখে নিব" বাকিগুলো মুখে আনার মতো না। ধন্যবাদ সবাইকে সেই সময় যারা ওকে সাহায্য করেননি নিজের বিবেকের কাছে বন্দী হয়ে। আর হ্যাঁ, অন্যদিকে কিন্তু সে ও তার পরিবার (বাবা, মা, বোন, দুলাভাই) ডিপার্টমেন্ট ও ভার্সিটি প্রশাসনের কাছে এসে ধরনা দিয়েই যাচ্ছে আর অনেক ভিক্টিমের সাথেই যোগাযোগ করে ইমোশনালভাবে ব্ল্যাকমেইল করে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা তার আসল রূপটা জানায় কনভিন্স হইনি কেউই।

সবচেয়ে ভাল লাগার বিষয় হলো পুরো ঘটনাতে আমরা সবার এত বেশি সাহায্য আর সাপোর্ট পেয়েছি যে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করতে পারবো না। বিভাগের প্রতিটি শিক্ষক, বড় ভাই-বোন, প্রাক্তন শিক্ষার্থীসহ সবাই সহমর্মিতা জানিয়ে বলেছিল তারাও এরকম অপরাধীর শাস্তি চান। তবে অন্যান্য সবার পাশাপাশি আলীম স্যার, আমাদের চেয়ারম্যান স্যার আর সাবেক ছাত্র উপদেষ্টা ম্যামের কথা না বললেই না। এই ৩টা মানুষ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাশে ছিল। ম্যামের কাছে গেলে তো মনে হতো মায়ের কাছে এসেছি। তার কাছে যে মমতা পেয়েছি তা বলার মতো নয়। অন্য কোন হয়রানির ক্ষেত্রে ভিক্টিমরা এত মানসিক সাপোর্ট বা সহানুভূতি পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। পেলে আজ অন্য এক দেশে বাস করতাম আমরা।

শিশিরের এই পরিণতি শুধু ওর জন্যেই না, বরং আশেপাশে ভাল মানুষের মুখোশ পরে থাকা আরো হাজার হাজার অপরাধীর জন্যে একটাই বার্তা দেয়, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। আর চোরের দশ দিন তো সাধুর একদিনই যথেষ্ট। ফেক আইডির আড়াল থেকে যতই হম্বিতম্বি করুন, ভিক্টিম একটু সাহসী হলে আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠী মিলে দৌড়িয়েও কুল পাবেন না। কাজেই সময় থাকতেই সাবধান হোন। আর এতগুলো ভিক্টিমের মধ্যে সাহস করে যে ১৫ জন এগিয়ে এসেছিল, পাশে থেকে যে ২ জন সর্বাত্মক সহযোগীতা করেছিল (নিরাপত্তার কারণে কারো নামই বলছি না) সবাইকে জানাই অভিনন্দন। বাংলার প্রতিটা মেয়েই তোমাদের মতো বাঘিনী হোক।

বিঃ দ্রঃ নিজের রুচিবোধের কারণে তার কোন ম্যাসেজের স্ক্রিনশট দিতে পারছি না। নাহলে যারা তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ডিফেন্ড করে এসেছেন তাদের মুখের উপর একটা ভাল জবাব দেওয়া যেতো।

সাদিয়া ইসলামের ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত