নূরজাহান বেগম আমাদের আলোর দিশারী
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০১৮, ১৩:৫৪
যুগে যুগে অনেক মহীয়সী মানুষ জন্মান, যারা সমাজের পরিবর্তনে আজীবন ভূমিকা রাখেন। নূরজাহান বেগম ছিলেন ঠিক তেমন একজন গুণী ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের অন্যতম একজন শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তি। নূরজাহান বেগম সাংবাদিকতা জগতেরও একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকা 'বেগম' এর সূচনা থেকেই সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছয় দশক ধরে তিনি বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বেগম শুধুমাত্র একটি পত্রিকা নয়। বরং এই পত্রিকাটি চলমান সমাজ ব্যবস্থার নারীদের প্রতিচ্ছবি।
বেগম পত্রিকা সম্বন্ধে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পর জানতে পারি। এই পত্রিকা সম্বন্ধে দু’একটা ফিচার পড়েছিলাম। কিন্তু এই পত্রিকার ইতিহাস সম্পর্কে বেশি দূর জানা ছিল না। একবার ছাত্র ইউনিয়নের একটা প্রোগ্রামের কার্ড পৌঁছাতে আমার সিনিয়র চির তরুণ বন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা আক্কু চৌধুরীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে উপহার স্বরূপ মালেকা বেগম সম্পাদিত ৪ খণ্ডের বেগম বইটা উপহার দিয়েছিলেন। আক্কু ভাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বইগুলি নিয়ে এসেছিলাম। বইগুলো পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত ছিলাম। এরপর বাসায় ফিরেই বইগুলোতে চোখ বুলাতে লাগলাম। এখনও মাঝে মাঝে চোখ বুলাই। বেগম যখন পড়ি তখন আমার মনে হয়, বই নয় যেন সাক্ষাত ইতিহাস হাতড়ে বেড়ানো।
শ্রদ্ধেয় মালেকা আপা খুব সংক্ষেপিত আকারে বেগম পত্রিকা থেকে আংশিক গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে দিয়েছিলেন। তারপরেও এতদিনের বেগম পত্রিকা পড়ে সেটিকে সম্পাদনা করাও একটা দুঃসাধ্য কাজ। এটা পড়ে আমি রীতিমত নূরজাহান বেগম এর ভক্ত হয়ে গেলাম। তখন তার ব্যাপারে খোঁজ খবর শুরু করলাম। এরপর ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের সমাজ কল্যাণ সম্পাদক কাজী রীতা এবং ঢাকা মহানগরের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা লাভলী হককে সাথে নিয়ে তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
সেদিন তার বাসভবনে চমৎকার কিছু সময় কাটিয়েছিলাম। তিনি ঘুরে ঘুরে তার বাড়ির ইতিহাস বলেছিলেন। সেসময় নারীদের শিক্ষা গ্রহণ করা কতটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল সে বিষয়ে তিনি আমাদের বললেন। তিনি টানা বলে যাচ্ছিলেন বেগম পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে তিনি কত ধরণের সমস্যার মধ্যে পড়েছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। তিনি বলছিলেন তার সময়ের কথা। বলছিলেন সেসময়ে বেগম পত্রিকায় নারীদের লিখা সংগ্রহ করতে তার অদম্য ছুটে চলার কথা।
আমাদের দেখে তিনি খুব আশাবাদী হয়েছিলেন। বলছিলেন এখন নারীরা কত এগিয়ে গিয়েছে। অথচ তার সময়ে প্রথম দিকে নারীরা লিখতে আগ্রহী হতেন না। বেশিরভাগ নারীরাই ছদ্মনামে লিখতেন। তিনি আমাকে তার বাড়িতে সংগ্রহে রাখা বেগম পত্রিকা দেখালেন। ধুলো জমা স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখা বেগম দেখে মনে হল ইতিহাসই যেন স্তরে স্তরে সাজানো। তিনি দুঃখ করে বললেন উলিতে বেশিরভাগ পত্রিকা নষ্ট হয়ে গেছে। পানিতেও অনেক বেগম নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু তারপরেও যেটুকু আছে তাও মহামূল্যবান। পুরো বাড়িটা দেখে, বাড়িতে সাজিয়ে রাখা বেগম পত্রিকা দেখে আমার মনে হল যেন একটা যাদুঘরে এসেছি। শেষে তিনি আমাদের বললেন লেখাপড়া ছাড়া নারীদের উন্নতি হবে না। নারীদের জ্ঞানের আলোতে আলোকিত হতে হবে। নূরজাহান বেগমের সাথে অসাধারণ কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে আমরা ফিরে এসেছিলাম।
উল্লেখ্য নূরজাহান বেগম ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে তিনি আইএ এবং ১৯৪৬ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৫২ সালে কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। নারীর উন্নয়ন ও সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানের জন্য নূরজাহান বেগম ১৯৯৭ সালে রোকেয়া পদক পান। আজ এই মহীয়সী নারীর জন্মদিন। তাকে নিয়ে আমাদের সমাজের অনেকেই জানেন না। আমার মনে হয় রাষ্ট্রীয়ভাবেই তার জন্মদিন উদযাপন করা দরকার। তার সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানানো প্রয়োজন। এতে সবাই একজন প্রকৃত আলোর দিশারী খুঁজে পাবেন।
নূরজাহান বেগমের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।