পদ্মাবতী দেখা, নাকি পদ্মাহত হওয়া!
প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০১৮, ২১:১০
পদ্মাবতী দেখা তো নয়, পদ্মাহত হওয়া! ইতিহাসের গোটা চচ্চড়ি বটে, তবে দেখতে মন্দ লাগে না। আধা-বর্বর খিলজি তার পনেরো বাই দশ ফুটের রাজসভায় সালমান খানের মত নাচেন (আমার যেন মনে হল গানে ক্যাশ শব্দ অব্ধি শুনলাম, মানে গানের কথা তো বুঝিনি), রানী যখন তখন হুট করে সর্বসমক্ষে চলে আসেন (যদিও এখনো রাজস্থানে রানীদের ছবি নেই রাজকীয় সংগ্রহশালায়, কারণ রানীর মুখ দেখা এবং দেখানো দুইই বারণ), দিল্লি চলে যান রাজাকে উদ্ধার করতে, সেখান থেকে ফেরেন কী করে, কেন খিলজির সৈন্য তাদের পিছু নেয় না, এসব প্রশ্ন মোটেই তুলছি না। বানসালী কমার্শিয়াল সিনেমা বানিয়েছেন, ডকুমেন্টারি না, কাজেই সেখানে সব জায়েজ। মায়, জহর যে লড়াইয়ের আগে হতো, পরে নয়, এবং খোলা যায়গায় হতো না, এ পর্যন্ত না। গোরা বাদল সম্ভবত পদ্মিনীর আত্মীয় ছিলেন, রাজপুত গোরা সিং বাদল সিং নন এবং বাপ ছেলে তো মোটেই না, যাই হোক সেসবও বাদ থাক।
আমার বক্তব্য অন্য যায়গায়। পদ্মিনী সিংহলের রাজকুমারী, অস্ত্রবিদ্যায় তার জুড়ি নেই। রাজনীতি কূটনীতি দর্শন শাস্ত্র সবেতেই তার অগাধ জ্ঞান। তিনি অসামান্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার অধিকারী; পারদর্শী নতুন ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, পোষাক, সবকিছু অতি শীঘ্র আয়ত্ত করায়। সব ভালো, সব ঠিক, সর্বগুণান্বিতা রাজকুমারী থাকা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু বারবার তাহলে রাজপুতানীর সাহস, শৌর্য, ধৈর্য, ত্যাগের প্রতীক হিসেবে তাকে প্রোজেক্ট করার কারণ কী? মানে তিনি এসেছেন এক বছরও হয়নি বিয়ে হয়ে এরকমটাই দেখানো হচ্ছে মুভিতে, তার মধ্যেই তার সমস্ত সাহস, শক্তি, জ্ঞান, শৌর্য, সবকিছুর গোত্রান্তর হয়ে গেছে? যে সিংহল রাজপরিবার তিল তিল করে এই রাজকুমারীকে বানিয়েছে, জঙ্গলী বাজের ন্যায় ক্ষিপ্রগতি যোদ্ধা, রাজা অপেক্ষা তীক্ষ্ণধী, জ্ঞানী, তার কোনো উল্লেখ অবধি নেই বিবাহ-পরবর্তী অধ্যায়ে? খালি রাঘব চেতন, ভালো হোক সেই বিশ্বাসঘাতক বামুনের, খিলজিকে পদ্মিনীর রূপগুণ বর্ণন করার সময় একবার মাত্র বলে যে তিনি সিংহলের পদ্ম, তার মতই আনমোল!
পদ্মিনীর পিতৃকূল তার আসন্ন বিপদের খোঁজ নেয় না, সেনা পাঠানো তো দূরস্থান। সে নিজেও বাপের বাড়ির কোন কথা মনে করে না। ভালোবাসা টাসা ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে যে মুক্ত বিহঙ্গের মত বড় হয়েছে সমুদ্রতটে আর চন্দনবনে, তার এই বালির রাজ্যের পাথরের গড়ে সে কথা মনে অবধি পড়তে নেই? বরং রাজা সে কথা মনে করালে সে গদগদ প্রেমে বলে যে রাজার চোখেই তার সমুদ্রদর্শন হয়। এ কথা এই রঙিন কাব্য-নির্মাতাদের বিশ্বাসযোগ্য লাগবে বলে মনে হয়েছে। যারা দেখছে তাদেরও হচ্ছে। আমার বিয়ের শুরু শুরুতে, যখন আমার শাশুড়ি-মার আশা ছিল যে আমায় বশ মানানো যেতে পারে, তিনি বারবার বলতেন, তুই এখন তামিলই তো! খাওয়া দাওয়া, পোশাক আশাক, কথাবার্তা, সবেতেই বলতেন। উদাহরণ দিতেন এমন সব মহান বিজাতীয় বৌমাদের যারা বিয়ের পর একশো শতাংশ তামিল হয়ে গেছেন। ধর্ম, জাত্যাভিমান, সংস্কৃতি এবং প্রথা, সবকিছু এক বিবাহমূহুর্তে বদলে ফেলার দায় এবং দায়িত্ব শুধুমাত্র মেয়ের, পদ্মিনীর।
তাই পদ্মিনীর আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার আগে তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় পতির হস্তচিহ্ন সম্বলিত বস্ত্রখণ্ড। যে সাহসী সিংহলকুমারী প্রেমে, সাহসে এবং ত্যাগে উজ্জীবিত হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিলেন, তার লেশমাত্র যেন না থাকে এই মৃত্যুতে। এই ত্যাগ রাজপুতানীর, এই মৃত্যু রাজপুতানীর, এই সাহস রাজপুতানীর। ধন্য রাজপুত, ধন্য রাজপুত-রানী!
আর হ্যাঁ, রাজা রতন সিং, যদিও তখনো জামাই হন নি, (তবুও মেয়ে তো প্রেমে পড়েছে, কাজেই হবু জামাই বৈকি) কিন্তু হবু শ্বশুরের সামনে উঠে দাঁড়ানোর ভদ্রতা অবধি দেখান না। কে না জানে, আমাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী কন্যাকূল স্বভাবতই থাকে নিচু হয়ে। জামাতার পায়ে ধরে কন্যা সমর্পণের রীতি আছে কিনা!
দেবশ্রী মিত্রের ফেসবুক থেকে