একটি জটিল অংক
প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:৫৮
শীতের মৌসুম। কর্জ করা টাকা দিয়ে টিকিট কিনে কোলের বাচ্চাকে নিয়ে দেশে যাচ্ছি প্রথমবারের মত। সে কী উত্তেজনা! গত আড়াই বছরের অভাব অনটনের জীবনে মনে হয়েছিল দেশে যাওয়ার টাকা জোগাড় করতে পারবো না সমস্ত জীবনেও। শেষ পর্যন্ত এক বিদেশী বন্ধু দয়া করে টাকাটা কর্জ দিয়েছিল বলেই টিকিট কিনতে পেরেছিলাম। এই টাকা শোধ করতে যে আরো কত বছর লাগবে কে জানে!
প্লেনের যাত্রার দীর্ঘ সময়টা খুব আনন্দের সাথেই কাটছে। আমার একবছর দুইমাসের নাদুসনুদুস হাসিখুশি ছেলেটা অন্যান্য যাত্রীদের আর বিমানবালাদের মন জয় করে নিয়েছে। সবার কোলে কোলে ঘুরে আদর আর চকলেট খাচ্ছে। দুইবার তার ন্যাপি বদলানো ছাড়া কিছুই করতে হয়নি আমাকে।
জানালা দিয়ে দেখছি হাজার ফুট নিচের দিগন্ত রেখা থেকে ভোরের সূর্যের রশ্মী ছিটকে পড়ছে আকাশব্যাপী, জানালা দিয়ে ঢুকে ছুঁয়ে দিচ্ছে আমাকেও। আর মাত্র একঘন্টার মধ্যেই আমরা ল্যান্ড করবো। এনাউন্সমেন্ট শোনামাত্র উত্তেজনায় আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল। হাতে ধরা চায়ের কাপটা থেকে অনেকখানি চা ছলকে পড়ে গেল। সত্যি একটু পর আমার দেশের মাটিতে পা রাখব? এও কি সম্ভব? ঢাকার কাছাকাছি পৌঁছুতেই আবার পাইলটের এনাউন্সমেন্ট, আমরা এখন বাংলাদেশের আকাশ সীমানায় প্রবেশ করেছি। এবার আর আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। উত্তেজনায়, আবেগে, আনন্দে কান্নায় ভেঙে পড়ি। আশেপাশের যাত্রীরা ফিরে তাকায়, অবাক হয় না কেউ, অনেকেরই চোখ ভিজে ওঠে। এমন অনুভূতির সাথে নিশ্চয়ই তাদেরও পরিচিতি ঘটেছে কোনো না কোনো সময়।
কানেক্টিং প্লেন সিলেট এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার পর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেই দেখি আব্বা দাঁড়িয়ে। জীবনে এই প্রথম এবং শেষবার আব্বাকে সিলেটে নিজের পরিচিতির সুবিধা নিতে দেখেছিলাম। আমি ছুটে গিয়ে আব্বাকে সালাম করে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ি। আচ্ছন্নের মত বারবার বলতে থাকি, 'আমি চলে এসেছি আব্বা, আমি সত্যি সত্যি চলে এসেছি।'
এক বৃদ্ধ সহযাত্রী এগিয়ে এসে আমার পিঠে হাত রেখে বলেন, 'সারাপথ কত হাসিয়েছ আমাদেরকে, কত আনন্দ দিয়েছ, এখন কাঁদছ কেন?'
এমন সুখের দিনে কেন কাঁদছি গত আড়াই বছরের সব গল্প না বলে বোঝানো কঠিন। স্বপ্নের দেশ বিলেতে একটা দুঃস্বপ্নের মত কেটেছে আড়াইটি বছর, তিরিশটি মাস। সিলেটের মাটিতে পা রাখা মানে ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখার পর ঘেমে জেগে ওঠা, নির্ধারিত একমাস ছুটির পর যে আবার সেই দুঃস্বপ্নের কাছে ফিরে যেতে হবে হয়তো মনের গভীরে সেই ভাবনাও কাজ করে। আমি চারদিকে তাকাই, বুক ভরে শ্বাস নেই, দূরের পাহাড়গুলো নিশ্চয়তা দেয়- আমি সত্যি এসে গেছি, আমার জীবনের কাছে, আমার চিরচেনা জগতের কাছে।
আব্বার সাথে খুব দ্রুত সিকিউরিটি আর কাস্টমস এর ফর্মালিটিজ সেরে বাইরে বেরিয়ে এসে আমার দেশে আসার সুখের স্বপ্ন আবার দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। বাইরে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তারা যে এই সকালে মৌলভীবাজার থেকে চলে আসবেন আমি তা কল্পনাও করিনি। দেশে ফেরার শিশুসুলভ উত্তেজনায় সামাজিক নিয়মকানুনের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি সিলেটের মেয়ে। আমার ভাবনায়, স্বপ্নে, অনুভবে সিলেট। ভেবেছিলাম সিলেটে দুইএকদিন থেকে তারপর শ্বশুরবাড়ি যাব। কিন্তু মনে ছিল না, আমি এখন 'ঘোমটা দেয়া কাজল বধূ দূরের কোনো গাঁয়’ এবং সেখানেই আমাকে যেতে হবে।
আমার শ্বশুর এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বললেন, 'আমি মাইক্রোবাস নিয়ে এসেছি। আমার নাতিকে এক্ষুনি নিয়ে যাব।'
আব্বা বললেন, 'আপনার নাতি, আপনি তো নিয়ে যাবেনই বেয়াই সাহেব। কিন্তু এরা দীর্ঘ জার্নিতে ক্লান্ত হয়ে এসেছে। একটু আমাদের বাড়ি চলুন, একদিন রেস্ট নিয়ে কাল সবাই মিলে যান।'
কিন্তু পুরুষের বাপের কথার সামনে নারীর বাপের কথার কী দাম? যে এ আর চৌধুরীর দাপটে কাঁপত পুরা সিলেট তার অনুরোধ অগ্রাহ্য করেই আমাদেরকে ঠেলেঠুলে মাইক্রোবাসে তোলা হলো। আমি প্রতিবাদ জানাতে গেলে আব্বা এক কোণায় ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন কথা না বাড়িয়ে শান্তির পন্থা অবলম্বন করতে।
শান্তির বাণী জপতে জপতেই মৌলভীবাজারে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমার ছেলেকে নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে মাইক্রোবাসের ভেতরে, কে তাকে কোলে নেবে, কে আদর করবে। এক বছরের ছেলে হয়তো কিছু বোঝে না কিন্তু অনুভব করতে পারে নিশ্চয়ই। সে আমার কোলে মুখ লুকিয়ে শক্ত করে দুইহাতে আঁকড়ে রইল আমাকে। কারো দিকে তাকাবে না, কারো কোলে যাবে না। এই ছেলেই প্লেনের অপরিচিত মানুষগুলোর কাছ থেকে নির্দ্বিধায় আদর খাচ্ছিল, কে বিশ্বাস করবে?
মৌলভীবাজারে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই ছেলের গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে। তার উপর ডায়রিয়া আর বমি। খাওয়া দাওয়া বন্ধ। কান্নাও করে না। শুধু আমার গালের সাথে গাল ঠেকিয়ে দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে থাকে। কেউ কোলে নিতে চাইলেই চোখ বন্ধ করে ফেলে। ডাক্তার দেখানো হয়, ওষুধ আনা হয় কিন্তু সে মুখ খোলে না। জ্বর বাড়তে থাকে। তার অবস্থা দেখে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি। এক সময় দয়া হয় শ্বশুর মশাইয়ের, সিলেট যাওয়ার অনুমতি পাই। হয়তো সেখানে একটু ভালো চিকিৎসা হতে পারে। আবার মাইক্রোবাস, আবার যাত্রা।
সিলেটে আমাদের বন্ধু একজন ইরানি ডাক্তার তাকে দেখতে আসেন। ডাক্তার সাহেবের সাথে ভালোই খাতির হয় ছেলের। ডাক্তার সাহেবের চশমা আর স্টেথোস্কোপের প্রতিই ছেলের আগ্রহ বেশি। পুরোপুরি না সারলেও অবস্থা কিছুটা ভালোর দিকে গেলে আমাদেরকে আবার ফিরতে হয় মৌলভীবাজারে। এইভাবে বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ির মাঝখানের টানাপোড়েনে দেখতে দেখতে একটি মাস কেটে যায়। বাল্যবিবাহের শিকার এক তরুণী মায়ের দুঃস্বপ্নই যেন চিরসঙ্গী।
ছেলে এতোদিনে সেরে উঠেছে। নানাবাড়ির বাংলোর কালো সিমেন্টের চওড়া বারান্দা তার খুব পছন্দ হয়েছে। ভারসাম্যহীনভাবে ছুটে বেড়াচ্ছে, পড়ছে, ব্যথা পাচ্ছে, কাঁদছে, আবার মুসলিম মামার পিঠে ঘোড়া চড়ে খিলখিলিয়ে হাসছে। আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি রান্নাঘরের পেছনের বাগানে, কূয়াতলায়, গরুরঘরের পেছনের সারিবাঁধা পেয়ারা গাছের ছায়ায় ছায়ায়। কাল ফিরে যাব। তার আগে আমার প্রিয় প্রতিটি পাতাকে ছুঁয়ে যেতে হবে আমাকে, আজন্ম পরিচিত প্রতিটি ধূলিকণার স্পর্শ মেখে নিতে হবে সর্বাঙ্গে।
হাঁটি আর চোখ মুছি। কেন যেতে হবে আমাকে? কেন মানুষকে যেতে হয়? কেন যা কিছু সে ভালোবাসে তার সব ছেড়ে ফিরে যেতে হয় এক দুঃস্বপ্নের জগতে? কে বানায় এসব নিয়ম? কেনই বা মানতে হয় নিয়মগুলো? বড়বোন আর আব্বার সাথে চুপিচুপি নিজের গভীর কষ্টের দু’চার কথা শেয়ার করেছি। মনের গভীরে একটুখানি আশা, হয়তো তারা বলবেন তুমি ফিরে যেয়ো না। বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে? বাচ্চা হয়েছে তো কী হয়েছে? কিন্তু কেউ কিছু বলে না, সমাজ নামের অদৃশ্য শোষকের অলিখিত নিয়ম ভাঙ্গতে উৎসাহ দেয়ার সাহস পায় না কেউ। মাত্র এসএসসি পাশ করার পর বিয়ে হয়ে যাওয়া আমিও সাহস পাই না।
আমার ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে সারা বাড়ি জুড়ে। বাড়ির গাছের শিমের বিচি ছিলছে রুবীর মা, অসময়ের পেয়ারা পেড়ে আনছে মুসলিম, আব্বার তদারকিতে গজার মাছের শুঁটকি ছোটছোট করে কুটছে রুবীর মা’র শ্বাশুড়ি, সদ্য বিচি ছাড়ানো পাকা তেঁতুলকে সরিষার তেল মাখিয়ে গোল গোল করে তাল পাকানো হচ্ছে। ছরতা দিয়ে অড়হড়ের ডাল কাটছেন মা, তার ঠোঁট দুটো থেকে থেকে তিরতির করে কাঁপছে। সবাই মিলে এক স্যুটকেস দেশ ভরে দিলেন বিদেশের মাটিতে আমাকে একটুখানি স্বস্তি দেয়ার জন্য। কেউ জানলেন না আমার শুধু এক স্যুটকেস সাহস দরকার ছিল, আর কিছু না।
তারপর প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। আমি এক পাহাড় সাহস সঞ্চয় করেছি। সমাজ নামক শোষককে কাঁচকলা দেখিয়ে তার সবগুলো নিয়ম ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ছুঁড়ে দিয়েছি। সেই একবছরের ছেলেটি এখন অনেক বড় হয়েছে, সমাজ বলে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করে না বলেই সে মায়ের বুকের বল আর হাতের লাঠিতে পরিণত হয়েছে।
এখন দেশে যেতে হলে আমাকে টাকা কর্জ করতে হয় না কিন্তু প্লেন থেকে নেমেই মাটিতে কোনো প্রিয় মুখ দেখি না। মাইক্রোবাসের অত্যাচারও আর নেই। নিজের ইচ্ছামত যেখানে খুশি যাই। গত দুই যুগে জীবনের খাতায় সীমাহীন সঞ্চয়। আত্মীয়, বন্ধু, সুহৃদ অসংখ্য। যাওয়ার মত জায়গাও অনেক কিন্তু পরম নির্ভরতার, নিঃশর্ত দাবির জায়গা নেই একটিও। বিলেত ফেরার দিনে ব্যস্ত হয়ে ডানোর টিনে শুঁটকি ভরে মোম দিয়ে এঁটে দেয় না কেউ আর। তিরতির করে কাঁপে না কারো ঠোঁট। অনেক করেছি, অনেক পেয়েছি জীবনে কিন্তু দুই দেশে বিস্তৃত বিশাল মানসাঙ্কের হিসাবটা আজো মেলাতে পারি না কিছুতেই।
জেসমিন চৌধুরীর ফেসবুক থেকে