আমরা ভয়ে থাকি
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০১৭, ০০:৫৪
১৯৯৮ সালে শাজনীন রহমান নবম শ্রেণীতে পড়তো। আমি পড়তাম ক্লাস ফোর এ। শাজনীন সারাজীবন ক্লাস নাইনেই থাকবে। সে ক্লাস নাইন পেরিয়ে ক্লাস টেন, তারপর এসএসসি তার পর কলেজ, তারপর ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারতো। হয়ত শাজনীন এর একটা বয়ফ্রেন্ড হতো, হয়ত সে বিয়ের আগেই সেক্স করতো, নিজের আনন্দে, নিজের সম্মতিতে। কিংবা করতো না। হয়ত সে ক্লাস নাইন, টেন, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে হিজাব ছাড়া চলে, ইউনিভার্সিটির শেষের দিকে এসেই হঠাৎ করে মাথায় হিজাব পরা শুরু করতো, কিংবা বিয়ের পর হিজাব করা শুরু করতো। হয়ত শাজনীন এর বিয়ের পর দুইটা বাচ্চা হতো। কিংবা হয়ত শাজনীন দেশের বাইরে পড়তে যেতো। হয়ত দেশের বাইরে নানান জায়গায় সে বেড়াতো।
শাজনীন সেইসব কিছুই জানলো না। শাজনীন তো এটাও জানলো না যে ফেসবুক নামের একটা বস্তু পৃথিবীতে এসেছে, যেখানে আমার মতো কিছু লেখক, কিছু হলেই ভ্যাড়ভ্যাড় করে লেখালিখি করে। শাজনীন তার ছবি ইন্সটাগ্রামে যে দেয়া যায় জানলো না। শাজনীন জানলো না আমরা অভ্রতে বাংলা লিখি। শাজনীন তো জানলোই না আমরা থ্রি জি পেড়িয়ে ফোর জি, ফাইভ জি তে আছি, ভিডিও কল করি, সেলফি তুলি, ফেসবুকিং করি।
এন্ড্রয়েড ফোন হাতে আছে, হাতে আছে আইফোন (এলিট দের জন্য)। শাজনীন তো এলিট ছিল, শাজনীন হয়ত এলিটদের নানান অনুষ্ঠানে যেতো, আইফোন হাতে নিয়ে। হয়ত যেতো না। ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বিশাল পরিবর্তন শাজনীন দেখে যেতে পারলো না। অথচ সে যেমন ছিল, যেমনই হতো, যেমনই হতো তার মানসিকতা তার বেঁচে থাকার অধিকার ছিল।
বেঁচে থাকার অধিকার ছিল, তৃষা, সীমা, সিমি, তানিয়া, ইয়াসমিন, ফাহিমার; বেঁচে থাকার অধিকার ছিল তনুর, বেঁচে থাকার অধিকার ছিল রূপার। তারা বেঁচে থাকতে পারতো, কিন্তু তারা তা পারেনি।
রূপা যে কিনা দরিদ্র একটি পরিবার থেকে এসেছিল, সেই রূপার জীবনের মূল্য, উচ্চবিত্ত পরিবারের শাজনীনের জীবনের মূল্য, আদিবাসী নারীদের জীবনে মূল্য, সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নারীদের মূল্য, রোহিঙ্গা মুসলিম নারীর জীবনের মূল্য, ডিস্কোতে যাওয়া নারীর জীবনের মূল্য, গার্মেন্টস এ কাজ করা নারী শ্রমিকের মূল্য, ইট ভাটায় কাজ করা নারী শ্রমিকের জীবনের মূল্য, বাংলাদেশ ব্যাংক এ কাজ করা নারীর জীবনের মূল্য, পিংক স্যাম বাইক চালানো নারীর জীবনের মূল্য, আমার জীবনের মূল্য একই। আমাদের প্রত্যেকের রয়েছে নির্ভয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। আমাদের রয়েছে বিচার পাবার অধিকার।
আর সেই অধিকার নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র।
কিন্তু আমরা সেই নিশ্চয়তা পাই না। আমরা ভয়ে থাকি। আমরা যেকোন সময় ভয়ে ভয়ে থাকি। আমরা ভয়ে থাকি যখন আমাদের যৌনাঙ্গও ভালো মতো তৈরি হয় নি তখন। আমরা ভয়ে থাকি বাড়ির বাইরে, বাড়ির ভিতরে। আমরা ভয়ে থাকি দিনে, দুপুরে, বিকেলে, সন্ধ্যায়, রাতে। আমরা ভয়ে থাকি ঘুমে, স্বপ্নে, জাগরণে, আমরা ভয়ে থাকি বাস্তবে, আমরা ভয়ে থাকি ভার্চুয়াল এ।
আমরা ভয়ে থাকি।
আর এইভাবেই প্রতিনিয়ত আমার, আমাদের মানবাধিকার লংঘিত হয়।
ভয় মুক্ত জীবন আমার মানবাধিকার।
প্রমা ইসরাত এর ফেসবুক থেকে