আরো একজন মায়ার গল্প

প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০১৭, ২২:৩৮

সাইকোলজিস্ট দরজায় দু’বার মৃদু নক করার পর ভেতর থেকে বলিষ্ঠ নারী কন্ঠের উত্তর এলো, 'প্লিজ কাম ইন'।
দরজার দিকে পেছন ফিরে একটা কাঠের চেয়ারে বসে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে মেয়েটি। আমাদের দিকে না ফিরেই বলল, 'প্লিজ টেক আ সিট। আয়াম ফিডিং মাই বেবি। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড'।

মেয়েটা বাঙালি? সিলেটি? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। অপরিচিত দু’জন মানুষের সামনে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়টা তার কাছে এতোটা স্বাভাবিক? এতোটুকু জড়তা নেই। ইংরেজিও তো ভালোই বলছে, স্পষ্ট উচ্চারণ। আমাকে তাহলে কী করতে আনা হয়েছে?

এই ফাঁকে কামরার ওপর চোখ বুলিয়ে নিলাম। এদেশের শোবার ঘরগুলো থেকে তুলনামূলকভাবে বেশ বড় কামরাটা। একপাশে একটা দামি কাঠের ডাবল বেড। তার পাশে একটা বড় কট, টেবিলের ওপর বাচ্চার ময়লা কাপড়গুলো স্তুপিকৃত করে রাখা। মেঝেতে বাচ্চার একটা প্লাস্টিকের ক্রাডল, মিনি রকিং চেয়ার বলা যেতে পারে। পরিষ্কার মেঝের নানাস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাচ্চার নানান জিনিস- ন্যাপির প্যাকেট, কাপড়ের বাস্কেট। বোঝাই যায় এই ছোট জগতে এই শিশুটারই আধিপত্য।

‘আমার রাজা বাচ্চা, আমার সোনা বাচ্চা, মাশাল্লাহ, মাশাল্লাহ। আর ইউ হ্যাপি বেবি?’ দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে বাচ্চার সাথে কথা বলছে মেয়েটা। আমাদের উপস্থিতি সম্পর্কে কি সম্পূর্ণই উদাসীন হয়ে পড়েছে সে? এমন সময় আমাকে প্রায় চমকে দিয়ে কাঁচা সিলেটিতে প্রশ্ন করল, আমাদের দিকে না ফিরেই, ‘আফনে সিলেটি নি গো আফা?’

আমি এখনো ওর মুখটা দেখিনি। মাথায় হালকা করে ওড়নাটা তুলে দেয়া, ফর্সা গালের পাশটা দেখা যাচ্ছে শুধু। আমি ভাবছি মেয়েটার সমস্যার ধরন কী হতে পারে। কথাবার্তায় তো মানসিক কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হচ্ছে না, তাহলে সাইকোলজিস্ট কেন? 

‘জ্বী অয়, আমি সিলেটি। আফনে তো ভালাউ ইংরেজি পারোইন। আমারে কেনে দরকার?’ 
‘ইতা তারাউ জানে গো আফা’।

কিছুক্ষণ পর দুধ খাওয়ানো শেষ হলে মেয়েটা চেয়ার ঘুরিয়ে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসল। তার বিপরীতে দেয়াল ঘেঁষে রাখা ডাবল সোফাটায় বসলাম আমি এবং সাইকোলজিস্ট।

মেয়েটার বর্তমান সমস্যা-সংকুল জীবনে বাচ্চাদের দায়িত্ব নেবার মত মানসিক ক্ষমতা তার আছে কী না সেটা পরীক্ষা করবেন বলে ব্যাখ্যা করলেন সাইকোলজিস্ট। কিছু নির্দেশনা বেশ জটিল হতে পারে বলে অনুবাদ করার জন্য আমাকে আনা হয়েছে বলে জানালেন। আরো অনেক কিছুর সাথে এই পরীক্ষায় পাশ করার উপরেও নির্ভর করবে তার বড় বাচ্চা দু’টোকে সে ফিরে পাবে কী না। বাচ্চা দু’টো বর্তমানে ফস্টার কেয়ারে আছে। পরীক্ষাটা বেশ মজার। নানান ধরনের প্রশ্ন করা হবে। শুরু হবে সহজ দিয়ে, পরে একটু একটু করে কঠিন হতে থাকবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাচ্চাকে ক্র্যাডলে বসিয়ে তার সাথে সংযুক্ত মিউজিক বাটনটা টিপে দিল মেয়েটা। বাচ্চাটা নিবিষ্ট মনে মিউজিক শুনতে থাকল। পরীক্ষা শুরু হলো।

‘সাত আর তিন দু’টো ভিন্ন শব্দ কিন্তু তাদের মধ্যে একটা মিল রয়েছে, মিলটা কী? খাদ্য আর পেট্রোলের মধ্যে কী মিল? ব্যাজ আর মুকুটের মধ্যে কী মিল?’

প্রথমটা বাদে আর কোনোটারই খুব বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিতে পারলো না মেয়েটি তবু তার সহজ সরল ব্যখ্যায় আমি মুগ্ধ হলাম। ‘খানি আমরা খাই, পেট্রোল দিয়া আমরা গাড়ি চালাই। দুইটাউ খুব কামোর জিনিস। যদি কেউরোর কামোর জাগাত মুকুট ফিন্দা লাগে, আবার ব্যাজ ফিন্দা লাগে, তাইলে দুইটাউ অফিসিয়াল জিনিস’।

আমি আড় চোখে তাকাই সাইকোলজিস্টের দিকে আর মনে মনে প্রার্থনা করি তিনিও যেন আমার মতই মুগ্ধ হন, মেয়েটা যেন পরীক্ষা পাশ করে, হারিয়ে ফেলা বড় বাচ্চা দু’টোকে ফিরে পায়।

এরপর তাকে অনেকগুলো শেপ-নির্ভর পাজল মেলাতে দেয়া হলো, তার স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করা হলো, কয়েক ডিজিটের নাম্বার উলটা গুনতে বলা হলো। মেয়েটা খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে সব করে যাচ্ছে, আর বাচ্চার দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে, আদুরে গলায় বলছে, ‘ও বাবা, আম্মায় তুমারে ফালাইয়া খেলাইয়ার দেখছোনি? আম্মায় তুমারে এটেনশন দিয়ার না বাবা। আম্মা আইজকু পচা অইছি’।

বাচ্চার দিকে মনোযোগ দেয়ার জন্যই হয়তো সে একের পর এক ভুল করছে কিন্তু টের পাচ্ছে না। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, আফা ই পরীক্ষা তো একেবারে সোজা। আমি তো এ প্লাস ফাইমু আফা’। 

আমি কথাটা সাইকোলজিস্টকে অনুবাদ করে বলতেই আমরা সবাই হাসিতে ফেটে পড়লাম। নির্যাতিত মেয়েদের আশ্রয়স্থল উইমেন রেফিউজের এই নীরব, বেতনাতুর কামরাটা এক ঝলক আনন্দের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু বেশি সময়ের জন্য নয়। পরবর্তি প্রশ্নটা পুরো কামরাটায় আবার এক আকাশ কষ্ট ঢেলে দিলো। 

‘মিস চৌধুরী, তুমি যথাসম্ভব কোমলভাবে ওকে জিজ্ঞেস করো, এতো নির্যাতনের পরও তার কেন মনে হলো স্বামীকে ত্যাগ করে যাওয়া যাবে না?’

খুব সাবলীলভাবে উত্তর দিল মেয়েটা, ‘আফা, আফনে নিজোরে আমার জাগাত বওয়াইয়া ভাবিয়া দেখইন, আফনে দুই বাইচ্চা লইয়া ই দেশো নতুন আইছইন, কিছছু চিনোইন না। পেটো আরেকটা বাইচ্চা। বাসাত গ্যাস নাই, কারেন্ট নাই, বড় দুই বাইচ্চারে স্কুল দিছইন না জামাইয়ে। তান বদ অভ্যাসোর পিছে সব টাকা খরচ করিলাইন। খালি ব্রেড খাইয়া দিন যায়, তবু তো মাথার উফরে একখান ছাদ আছে। বারইয়া গেলে কই থাকবা? বাইচ্চাইন্তরে কিতা খাওয়াইবা? ই দেশো সোশাল সার্ভিস কইয়া ভি একটা জিনিস আছে আমি আগে জানতাম না। যেদিন জানছি, ওউদিনউ গিয়া তারারে কইছি। কিন্তু তারা মনো করে আমি দুর্বল, আমার দুর্বলতার সুযোগে আমার জামাই আবার আমার কাছে ফিরিয়া আইবা, আমার বাইচ্চাইন আবার আগোর লাখান বিপদো পড়ব। এর লাগি বাইচ্চাইন দের না আমারে’।

মেয়েটার কথা বলার ভঙ্গি, কন্ঠস্বরের দৃঢ়তা, বাচ্চার সাথে কথা বলার আদুরে স্বর, নিজের কষ্ট আর দুর্ভাগ্য নিয়ে কথা বলার সময় কন্ঠস্বরে আবেগের নিয়ন্ত্রণ সবকিছু আমাকে মুগ্ধ করে। 

পরীক্ষা শেষ হলে সাইকোলজিস্ট বললেন, ‘তুমি খুব ভালোভাবে পাশ করেছ, আমি মনে করি তুমি বাচ্চাদের দায়িত্ব নিতে সক্ষম কারণ নিজের জন্য সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তোমার আছে’।

একথা শুনে অবাক হয়ে গেল মেয়েটা, ‘আমি কিলান সিদ্ধান্ত লইমু আফা? সিদ্ধান্ত তো লইবা জজসাবে। তাইন হুকুম না দিলে আমার বাইচ্চাইন্তরে আমার কাছে দিতো নায়’।

নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়া বিষয়টা তাকে বোঝাতেই আমার সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হলো কারণ এই কন্সেপ্টটার সাথে তার পরিচয় ঘটেনি আগে কখনো। আমি বললাম, ‘এই ধরুন আমরা যখন কামরায় ঢুকলাম, আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন আপনার বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো আগে শেষ করবেন তারপর আমাদের সাথে কথা বলবেন। এটাই হলো নিজের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারা’।

একথা শুনে করুণ হাসি ফুটে উঠল মেয়েটার মুখে। ‘জামাই যাওয়ার ফর তাকি নিজেউ সিদ্ধান্ত লইতাম ফারি। এখন আমার দুইটা বাইচ্চারে ফিরত ফাইলেউ আমি খুশি। জীবনো আর কিচ্ছু চাই না’। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় এই প্রথম মেয়েটার চোখে অশ্রু দেখলাম। আমার নিজের চোখও শুকনা ছিলো না। 

বাইরে বেরিয়ে আমি সাইকোলজিস্টকে বললাম, ‘শি ইজ আ ব্রিলিয়ান্ট মাম। শি শুড গেট হার কিডস ব্যাক’।
‘ইট’স আপ টু দ্য কোর্ট বাট শী নিডস টু বি মাচ স্ট্রংগার’। 

মা বাবার সুরক্ষিত ডানার নিচ থেকে সরাসরি এক নির্যাতক স্বামীর খপ্পরে পড়ে যে বাঙালি মেয়ে সে কী করে ‘স্ট্রংগার’ হয়?

আমি বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবলাম, ‘এই তো আরো একজন মায়া, যারা জীবনের বিষের খবর না রেখেই তাদের দিকে বাড়িয়ে দেয়া পেয়ালা মুখে তুলে। তারপর সীমাহীন যন্ত্রণায় কাটে বাকিটা জীবন’। 

অপুকে বললাম ‘মায়া’জ হানিমুনস’ নাটকটা প্রতিটা শহরে মঞ্চায়িত করতে হবে, গল্পটা বারবার বলতে হবে, মেয়েদের মনে সাহস আর শক্তি গড়ে তুলতে হবে, মা-বাবাদের সচেতন করে তুলতে হবে। গ্রান্ট না পেলে পকেটের পয়সা নিয়েই নেমে যাব’।

জেসমিন চৌধুরীর ফেসবুক থেকে

0Shares
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত