সাহেব-ই-দাওয়া
প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০১৭, ০১:৪৭
গতবছর ঢাকায় আমার স্বামীর এক বন্ধুর বাসায় তার পিতার মৃত্যু পরবর্তী মিলাদ মাহফিলে গিয়েছি। আর সবার সাথে দুই হাত তুলেছি মোনাজাতে অংশ নেবার জন্য। একপর্যায়ে প্রার্থনাটি পুরুষতান্ত্রিক রূপ নিয়ে নিল যখন সুললিত কন্ঠে হুজুর গাইতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহ, আমাদের যাদের যাদের পুত্রসন্তান উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে আছে, তুমি তাদের হেফাজত করো। হে আল্লাহ আমা...দের যাদের যাদের পুত্রসন্তান চাকরিবাকরি করছে তাদেরকে তুমি তরক্কি দাও...।’
এভাবে একের পর এক আল্লাহপাকের দরবারে সাতটি আরজি পেশ করা হলো খাস করে পুরুষসন্তানদের জন্য। প্রতিটি নতুন আরজির সাথে হুজুরের কন্ঠস্বর আরো চড়া হতে লাগল, সেইসাথে আবেগের মাত্রাও। শুনতে শুনতে আমার কান গরম হয়ে উঠতে লাগল, মোনাজাতের উদ্দেশ্যে তোলা হাত দু’টো শিথিল হয়ে নিজেরই কোলে এসে পড়লো।
মোনাজাত শেষ হলে সমবয়েসী কয়েকজনের সাথে বারান্দায় বসে কাচ্চি আর বুরহানি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা কেউ কি এই মোনাজাতের মধ্যে কোন অসংগতি লক্ষ্য করলেন? কোন ব্যালান্সের অভাব?’
অনেকেই খানিক্ষণ চোখমুখ কুঁচকে ভেবে নিয়ে নিরীহ মুখে বললেন, ‘কই না তো?’
একজন নারী ফটোগ্রাফার, যিনি আমার স্বামীর বন্ধুর বন্ধু, মুচকি হেসে বললেন ‘আপনি যা শুনেছেন তা আমিও শুনেছি। আমাদের সমাজে এটা এতোই স্বাভাবিক যে সবাই এটা লক্ষ্যই করবে না’।
আমি ঘটনাটা খুলে বলার পর কয়েকজন প্রতিবাদ করলেন ‘না না এটা হতেই পারে না। আপনারা নারীবাদী মেয়েরা যেখানে যান সমস্যা খুঁজতে থাকেন। হুজুর তো সন্তান বলেছেন, পুরুষ সন্তান বলেননি’।
উপস্থিত এক ভদ্রলোক গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘এখানে একটা ব্যাপার আছে। ব্যাপারটা হলো ‘সাহেব-ই-দাওয়া’। যিনি মিলাদের আয়োজন করেন, মোনাজাতটা তার জীবনকে কেন্দ্র করেই করা হয়ে থাকে। আজকের মিলাদের আয়োজকের কোন কন্যা সন্তান নেই, তার একমাত্র পুত্র বিদেশে থাকে তাই মোনাজাতের ভাষাটা এরকম ছিল। এতে অন্য কোন অর্থ খোঁজার চেষ্টা করবেন না’।
এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। ঘটনাটা আরো দু’একজনের কাছে গল্প করে জানতে পারলাম ‘সাহেব-ই-দাওয়া বিষয়টা আসলেই সত্যি।
যা’ই হোক, তার ঠিক দুইদিন পরই ছিল আমার সদ্যপ্রয়াত শ্বাশুড়ির আত্মার মাগফেরাতের উদ্দেশ্যে আয়োজিত বিশাল পারিবারিক মিলাদ। মিলাদের প্রধান আয়োজক আমার মেঝো দেবর যার পুত্র সন্তান নেই, একটা মাত্র মেয়ে। সাতশ’ লোকের মিলাদে মাইক দিয়ে মোনাজাত হচ্ছে। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি মেয়েসন্তানদের জন্য স্পেশাল দোয়া হবে আজকে। কিন্তু আমাকে নিরাশ করে দিয়ে প্রায় আধঘন্টার মোনাজাতে পুত্র অথবা কন্যা কারো কথাই আলাদাভাবে বলা হলো না। বুঝতে পারলাম সাহেব-ই-দাওয়া যিনি তার পুত্রসন্তান থাকলে আলাদা দোয়ার প্রয়োজন, মেয়েসন্তানের জন্য আলাদা প্রার্থনার প্রয়োজন নেই।
নারী ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে, শিক্ষা অর্জন করেছে, পরিবারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার দায়িত্ব কিছুটা হলেও কাঁধে নিতে শুরু করেছে কিন্তু তার শিক্ষা, তার নিরাপত্তা, তার তরক্কি আমাদের প্রার্থনার অংশে পরিণত হতে পারেনি এখনো। তার চারিত্রিক নিষ্কলুশতা এবং স্বামীভাগ্যই এখনো তার জন্য আমাদের একমাত্র প্রার্থনার বিষয়। এসব বিষয়কে ছোট বলে উড়িয়ে দেয়ার কোন কারণ নেই, আপাতদৃষ্টিতে ছোট মনে হওয়া এইসব আচরণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে নারীকে পুরুষের চেয়ে ছোট করে দেখার ঘৃণ্য প্রবণতা।
কিছুদিন আগে একটি অনলাইন পত্রিকায় পাঠানো আমার একটি লেখা থেকে উপরের অংশটুকু কেটে ফেলে দেয়া হয়েছিল। আমি তাদের সীমাবদ্ধতা বুঝি, এধরনের বক্তব্য ছাপালে পোর্টালের উপর গণ-আক্রোশ পড়বে, কিন্তু আমি এই গণ-আক্রোশকে বুঝি না। একটি স্বাভাবিক দাবীর সাথে কোন একটি ধর্মীয় আচার সংযুক্ত হয়ে গেলেই কেন আমরা চোখ কান বন্ধ করে উচ্চকন্ঠে প্রতিবাদ করতে শুরু করি? আমাদের বিশ্বাস কেন এতো ঠুনকো?
অনেক নারীই এসব অসংগতি লক্ষ্য করতে অক্ষম বা করলেও এ নিয়ে ভাবনা প্রকাশে অনিচ্ছুক। আমি ছোটবেলা থেকেই এসব লক্ষ্য করে এসেছি, ব্যথিত হয়েছি এটা জেনে যে একটা মেয়ে হিসেবে সমাজে আমার অবস্থান ইচ্ছাকৃত ভাবেই কিছুটা নিচে রাখা হয়েছে এবং এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ছোটখাটো বিষয়ের মধ্য দিয়ে যার পেছনের উদ্দেশ্যগুলো ছোট নয়, এবং একদিনে তৈরি হয়নি।
আমি কেন এসব লিখি? না, ধর্মের বা সমাজের বিরোধীতা করতে নয় বরং এই আপাত ছোট বিষয়গুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপেক্ষাকৃত বড় ইস্যুগুলোর প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। শুধু মুখে বললেই তো হবে না 'আমার কাছে নারী/পুরুষ সবাই সমান'। কাজে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিন, আমি আপনাদেরকে বিশ্বাস করতে পারলেই বেশি আনন্দিত হব, কিন্তু আমার জন্য শুধুমাত্র 'সিইং ইজ বিলিভিং।'
জেসমিন চৌধুরীর ফেসবুক থেকে