‘বিমান বালা’ শব্দটিতে পেশাদারিত্ব নেই, আছে নারী বিদ্বেষ

প্রকাশ : ১৯ মে ২০১৬, ১৯:১৪

গতকাল আমাদের বাড়িতে গৃহকর্মীর বোন বেড়াতে এসেছিলো। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম সে কোথায় থাকে। উত্তরে জানিয়েছিলো এক বিমানবালা ম্যাডাম আর বিমানবালা স্যারের বাসায় কাজ করে। অর্থাৎ সে যে বাসায় থাকে তারা স্বামী স্ত্রী উভয়েই কেবিন ক্রু।

কৌতূহল নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করি বিমানবালা কি কাজ করে তুমি তা জানো? সে উত্তর দেয় “ঐ যে যারা বিমানের মধ্যে সুন্দর পোশাক পরে যাত্রীদের খাবার দাবার চা পানি নাস্তা দেয়?” এ ছিলো এয়ারলাইন্স কেবিন ক্রু প্রফেশনের বিষয়ে খুব সাধারণ নিরক্ষর নির্বোধ ধারণা। কিছু শিক্ষিত এবং আধুনিক মানুষ প্রকৃত পেশাটি জানলেও বেশিরভাগ মানুষেরই এই পেশার দায়িত্ব সম্পর্কে ধারণা এরকমই। শুধু আরাম আয়েশ নয়, যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তাই এ পেশার প্রধান এবং অন্যতম দায়িত্ব। নারীর সৌন্দর্য এখানে অন্যতম শর্ত নয়।

ইতালির বিজ্ঞানী ও চিত্রশিল্পী লিউনার্দো দ্য ভিঞ্চি ১৫০০ সালে মানুষের মনে প্রথম আকাশে ওড়ার তীব্র ও অদম্য বাসনার বিজ্ঞানভিত্তিক রুপ দেন। সেই থেকে এই অদম্য ইচ্ছার বাস্তবায়নে আরামদায়ক বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজে করে মানুষ নির্বিঘ্নে পাড়ি জমাচ্ছে গন্তব্যে। আকাশে ওড়ার পর আকাশযানের কর্মীদের বিষয়ে সাধারণ মানুষের কল্পনা রুপ নেয় আকর্ষণে আর কৌতূহলে। আর সফলতার ব্যবসায়িক কৌশল হিসেবে এই আকর্ষণকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বহুকাল ধরে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নারীকে সকল কাঙ্খিত বস্তু লাভের মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থাপন করেছে যা নতুন কিছু নয়। নারীর অবয়ব মেধা আর শ্রম অপব্যবহার করে পুঁজিবাদের সাফল্য কালানুক্রমিকভাবে ঘরে তুলেছে পুঁজিপতিরা।

উড়োজাহাজ আবিষ্কারের আগে মানুষ সমুদ্রপথে জলযান জাহাজ ও স্থলপথে ট্রেনের মাধ্যমে দূরদেশে ভ্রমণ করতো। সে সময় জাহাজ ও ট্রেনে যাত্রীসেবার জন্য কর্মীরা যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা ও সেবাদান করতো যা বর্তমানের স্টুয়ার্ড পেশার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো। সীমাবদ্ধ, সংক্ষিপ্ত এবং যান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিরন্তর পরিশ্রম করে আকাশকে যারা নিরাপদ গৃহপরিবেশের মতো সেবা দিয়ে নিশ্চিত গন্তব্য পৌঁছে দেন বাংলাদেশের মানুষেরা সে পেশাজীবীদের ‘বিমান বালা’ বলে অভিহিত করেন। হীন নারীবিদ্বেষ নারীর পেশাগত জীবনকে অনৈতিক এবং নিষ্ঠুরভাবে বিদ্ধ করে এই শব্দটি। শাব্দিক অর্থে ‘বালা’ মানে কন্যা যুবতী, বালিকা, স্ত্রী অথবা রমনী যা একটি স্ত্রী বাচক শব্দ। এখানে শব্দ নিতান্তই একটি মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যম। প্রচলিত ‘বিমানবালা’ নামটি একটি নারীসুলভ পেশাকেই ইঙ্গিত করে।

যে পেশায় পুরুষের কোনো পদ নেই বলেই মনে হয়। যদিও এ পেশায় নারী পুরুষ উভয়ই যার যার কর্মদক্ষতায় সফলভাবে একসাথে কাজ করছেন। মঙ্গল গ্রহে যাবার প্রস্তুতির সময়ও এই নামকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের কিছু অনগ্রসর মানুষের মধ্যে যে তাচ্ছিল্য ও অবমাননা করার নিকৃষ্ট প্রবণতা দেখা যায় তা শুধু নারীকে অপমান ও অবমাননাই নয়, একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পেশার প্রতি ইচ্ছাকৃত অসম্মান এবং অজ্ঞতা প্রদর্শন বলেও মনে হয়। বাংলাদেশে এখনো অনেক মানুষেরই ভ্রমণের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু না জেনে মন্তব্য আছে অগণিত। তারা এই পেশাকে আতিথেয়তা ব্যতীত অন্য কিছুই ভাবতে পারেন না। কারণ যাত্রাকালে তারা হয়তো কোনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সম্মুখীন হননি।

সাধারণ মানুষ জানে না যে কৃত্রিম পরিবেশে অসুস্থ হয়ে গেলে, অক্সিজেনের প্রয়োজন হলে, ডিকম্প্রেশন হলে, পানিতে অথবা কাঁচা মাটিতে অবতরণ করলে অথবা জঙ্গলে জীবন রক্ষা করতে হলে, এমনকি ইনফ্লাইটে গর্ভবতী মাকে সন্তান প্রসব করানোর প্রশিক্ষণও তারা পেয়ে থাকেন। নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর একজন কেবিন ক্রুকে জরুরি নিরাপত্তা বিষয়ক যে সকল প্রশিক্ষণগুলোতে সফলতার সাথে কৃতকার্য হতে হয়, তা হচ্ছে, ফার্স্ট এইড, ফায়ার ফাইটিং, জরুরি অবতরণ বহির্গমন পদ্ধতি, পানিতে অবতরণ পদ্ধতি, ডেঞ্জারাস গুডস রেগুলেশন্স, হাইজ্যাকিং ও বোম থ্রেট , বিভিন্য ধরনের যাত্রী ব্যবস্থাপনা, একাকী শিশু যাত্রী, ডিকম্প্রেশন, স্টাইড বেলুনকে পানিতে অবতরণের পর তা ডিঙ্গিতে পরিবর্তন, কাস্টমার সার্ভিস, ফিজিকাল এক্সারসাইজ, এনাউন্সমেন্ট মোটিভেশন, লিডারশীপ, ফুড হাইজিন ইত্যাদি এবং আরও অনেক।

এ সকল প্রশিক্ষণ ও পেশার ধরন দেখে খুব সহজেই বোঝা যায় যে যাত্রাকালীন সময়ে যাত্রীদের আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করাই এ পেশার একমাত্র লক্ষ্য নয়। যাত্রীর জীবনের নিরাপত্তাই এ পেশার অন্যতম দায়িত্ব। যে পেশাকে আমাদের দেশে ‘বিমান বালা’ বলা হয়, এয়ারলাইন্স পরিবহন ব্যবসার ইতিহাসে সে পেশার প্রথম পেশাজীবী জার্মানির হেনেরিস কিউবিস নারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন পুরুষ। ১৯১২ সালের মার্চ মাসে জার্মানির প্রথম কমার্শিয়াল যাত্রীবাহী এয়ারশীপ উড়োজাহাজ ডিল্যাগ এল ২৭-১০ সওয়াবেন নামে ফ্লাইটে ‘চীফ স্টুয়ার্ড’ মনোনীত হয়ে প্রথম কমার্শিয়াল ফ্লাইটে অভ্যন্তরীণ যাত্রী সেবা প্রদান করেন। ১৯৩৭ সালের ৬ মে তারিখ ইতিহাসে ‘গ্র্যাফ জেপোলীন হিন্ডেনবারগ ডিজাস্টার’ নামে উল্লেখযোগ্য।

যে দুর্ঘটনায় যাত্রীবাহী উড়োজাহাজটি অবতরণের কিছু আগে আগুন লেগে বিস্ফোরিত হয়। কিউবিস উক্ত ফ্লাইটে ৩৬ যাত্রী ও ক্রু সহ মোট ৬২ জনকে সঠিক সময়ে জানালা দিয়ে কোনোরকম ইঞ্জিউরি ছাড়াই সফলভাবে জরুরি বহির্গমন করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ঘটনায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে তিনি এক বিরল সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন।

পৃথিবীর প্রথম মহিলা কেবিন ক্রু যুক্তরাষ্ট্রের এলেন চার্চ। ক্যারিয়ারের শুরুতেই তিনি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও বৈষম্যর শিকার হয়েছিলেন। তিনি একাধারে পাইলট ও রেজিস্টারড নার্স ছিলেন। কিন্তু ১৯৩০ সালে বোয়িং তাঁকে পাইলট হিসেবে নিয়োগ না দিয়ে যাত্রীদের ফ্লাইটে ওঠার ভয় কাটানোর জন্যে কেবিন ক্রু হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলো। ১৯৬৮ সালের আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে অবিবাহিত থাকার শর্তে নারী কেবিন ক্রুর বয়স সীমা ৩২ থেকে ৩৫ এর মধ্যে ছিল যা পরবর্তীতে বাতিল করা হয়। ঐ আইনে বলা হয় হয় যে লিঙ্গভিত্তিক নির্বাচন পেশার শর্তের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

আশির দশকে এ পেশায় শুধুমাত্র মহিলা কর্মী নিয়োগ এবং অবিবাহিত থাকার শর্তটিও বাতিল ঘোষিত হয়। বাইশ বছর বয়সি এক ব্রিটিশ নারী কেবিন ক্রু বারবারা জেন আগুন লেগে যাওয়া উড়োজাহাজ থেকে যাত্রীদের সফলভাবে নামানোর পরে নিজে নামার ঠিক আগে এক পঙ্গু নারীকে বাঁচাতে গেলে উড়োজাহাজটি সম্পূর্ণভাবে বিস্ফোরিত হয়। যাত্রীর জীবনের প্রতি এহেন আত্মত্যাগ এ পেশার পেশাজীবীদের জন্য এক বিরাট অনুপ্রেরণা।

 `বিমান বালা` সম্বোধনের এই পদবীর অস্তিত্ব নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড এর ট্রেনিং সেন্টার এর গ্রাহক সেবা বিভাগের উপ মহাব্যবস্থাপক ও প্রধান প্রশিক্ষক এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন`` ‘বিমান বালা’ নামে আমাদের সংস্থায় কোনো পদ নেই। বিমানে এবং আন্তর্জাতিকভাবে এই পেশাটি কেবিন ক্রু হিসেবেই পরিচিত এবং গ্রহণযোগ্য।

বাংলাদেশ বিমানে স্টুয়ার্ড এবং স্টুয়ারর্ডেস হিসেবে সংবাদপত্রে এ পেশার জন্য কর্মী আহ্বান করা হয়। যথাযথ নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিরাপত্তা প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হতে পারলেই এ পেশায় যোগদান করা সম্ভব হয়। বিমানের অন্যান্য সকল কর্মীদের মধ্যে এটি একটি বিশেষ অপারেশনাল পেশা যেখানে তাঁরা সরাসরি যাত্রীদের সাথে যোগাযোগ করে নিরাপত্তা এবং সেবা দিয়ে থাকে।

এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশাকে যারা অবজ্ঞা ছুঁড়ে দিতে চায় তারা ‘মেল শভিনিজমে আক্রান্ত’ বলে তিনি মনে করেন। ধারণা পরিবর্তনের জন্য ব্যয়বহুল আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ভ্রমণ সম্ভব না হলেও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ভ্রমণ করে ধারণা গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। 

লেখক : সহকারী ব্যবস্থাপক প্রশিক্ষণ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড

সূত্র: জাগো নিউজ

0Shares
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত