গুলশান হামলার এক বছর
শুভ সত্তার জাগরণ হোক
প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০১৭, ১৫:৪২
মাত্র এক বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঢাকা এবং বাংলাদেশের জন্য একটি সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হবে। হোলি আর্টিজান বেকারিতে যে বর্বর আক্রমণের ঘটনা ঘটে, যার পরিণতিতে পাঁচটি দেশের ২২ জন নির্দোষ মানুষ প্রাণ হারান, আমি সেই ঘটনার কথাই বলছি। এই মানুষগুলো সেখানে গিয়েছিলেন শুধু একজন আরেকজনের সান্নিধ্য এবং ঢাকার অন্যতম চমৎকার একটি রেস্তোরাঁর খাবার উপভোগ করতে। এ রকম একটি ব্যস্ততম জনবহুল স্থানে তাঁদের জীবনের এই অচিন্তনীয় পরিণতির ঘটনা বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশের সমমনা বন্ধুদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
ওই দিন আমরা সবাই বহু ধরনের ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিলাম। জীবনের ভয়ংকর এসব ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনের ভেতর এই প্রশ্নটাও জেগেছিল যে এরপর আমরা নির্ভয়ে এই বৈচিত্র্যময় ও আনন্দপূর্ণ শহরটি উপভোগ করতে পারব কি না। ওই সময়টিতে বাংলাদেশিরা যে সন্ত্রাস প্রত্যক্ষ করেছে, এর আগে এ দেশে এ রকম সন্ত্রাসী হামলা কেউ দেখেনি। বাংলাদেশের খোলামেলা, অতিথিপরায়ণ এবং সহনশীল সংস্কৃতিতে বসবাসরত বিদেশি অতিথি হিসেবে আমরা আমাদের সরল বিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলেছি যে আমরা কোনো সন্ত্রাসী হামলার লক্ষ্য নই। এমনকি যেসব তরুণ অত্যন্ত বর্বরভাবে এ হত্যাযজ্ঞ ঘটাল, তারা যে ভালো পরিবার থেকে এসেছিল এবং উন্নতমানের শিক্ষা লাভ করেছিল, এই বিষয়গুলো ওই মর্মান্তিক ঘটনাটিকে আরও বেশি অর্থহীন করে তুলল। সমাজের সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা এই সব তরুণ হয়তো আর ১০-১৫ বছরের মধ্যে তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারত, যদি তারা নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নির্দোষ শিকারদেরও ধ্বংস না করে ফেলত।
যখন পয়লা জুলাইয়ের বার্ষিকী আসছিল, এটা বলা সঠিক যে বাংলাদেশিরা এবং বিদেশিরা এখনো তাদের দুঃখ ও কষ্টের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এক বছর পর হামলার জায়গায় অনুষ্ঠিত হৃদয়বিদারক স্মৃতি অনুষ্ঠান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের ক্ষত এখনো শুকায়নি এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যাঁরা হামলায় নিহত হয়েছেন তাঁরা এবং তাঁদের পরিবার ও বন্ধুরা ভুলে যাওয়ার নয়। যাঁদের আমরা হারিয়েছি তাঁদের স্মৃতি, আশা ও স্বপ্ন আমাদের ভাবনায় এবং প্রার্থনায় প্রাধান্য পাওয়া উচিত, যখন আমরা এই হামলার শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। সম্ভব হলে আমি নিহত প্রত্যেকের কথা ব্যক্তিগতভাবে বলতে চাইতাম। হামলায় নিহত ব্যবসায়ী নেতা, শিক্ষার্থী ও দাতা সংস্থার লোকজন—সবাই ঢাকায় ছিলেন। কারণ, তাঁরা এখানে থাকতে চেয়েছিলেন, কারণ বাংলাদেশের প্রতি তাঁদের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। আমরা অনেকে তাঁদের ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না কিন্তু নিহত ২২ জন নারী ও পুরুষের প্রত্যেকের অর্জন ও সম্ভাবনার অপূরণীয় ক্ষতি এবং এই শোকের সময়ে আমরা সবাই একত্র হয়েছি।
এই নিষ্ঠুরতা, যা ভীতির সঞ্চার করতে চেয়েছিল তার জবাবে বরং আমরা ওই দিন নিহত ব্যক্তিদের অন্যতম তরুণ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ফারাজ আইয়াজ হোসেন থেকে অনুপ্রেরণা নিই, যাঁকে বন্দুকধারীরা ছেড়ে দেওয়ার পরও তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে রয়ে যান এবং মৃত্যুকে বরণ করে নেন। এই রকম নিঃস্বার্থ একটি কাজ আমাদের চ্যালেঞ্জ করে নিজেকে প্রশ্ন করতে যে কীভাবে আমরা প্রতিদিনের হেনস্তা থেকে শুরু করে গৃহনির্যাতন, ক্ষমতার অপব্যবহারের উত্তর দিই।
অকল্পনীয় ক্ষতি কীভাবে আমাদের ভেতরের শুভ সত্তা, যাকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ‘বেটার অ্যাঞ্জেল’ বলেছেন, তাকে জাগ্রত করে, তা আমরা একটি উদাহরণ থেকে বুঝতে পারি। সম্প্রতি আমার সুযোগ হয়েছিল হোলি আর্টিজান বেকারি হামলায় নিহত অবিন্তা কবিরের মায়ের প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল পরিদর্শনের। অবিন্তা একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক ছিলেন। তাঁর পরিবার তাঁর স্মৃতি অম্লান করে রাখতে সুবিধাবঞ্চিত বাংলাদেশি শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে; তাঁরা ধ্বংসের বিপরীতে সৃষ্টি বেছে নিয়েছেন, নেতিবাচকতা ও বিশৃঙ্খলার বিপরীতে তাঁরা বেছে নিয়েছেন শিক্ষা ও সম্ভাবনা। এই কার্যক্রম অবিন্তার স্মৃতির প্রতি এবং সেই সব ছেলেমেয়ের জন্য, যারা তাঁর দূরদৃষ্টি ও তাঁর পরিবারের বদান্যতায় উপকৃত হচ্ছে, খুব সুন্দর ও স্থায়ী একটি উপহার।
কাদামাটিতে জন্মেও পদ্মফুল অনিন্দ্যসুন্দর—এই রূপকটি এখানে যথার্থ। তেমনি হোলি আর্টিজান বেকারির বিয়োগান্ত এ ঘটনা থেকেও বাংলাদেশিদের প্রিয় ঐতিহ্যগত মূল্যবোধগুলো যেমন শান্তি, সহনশীলতা, বহুমুখিতা ইত্যাদি আরও গভীরতর হচ্ছে। সেই রাতে আমরা যাঁদের হারিয়েছি, তাঁদের সুন্দর জীবন নিয়ে আলোকপাতের পাশাপাশি তাঁদের, তাঁদের পরিবার ও বন্ধুদের জন্য রইল আমাদের প্রার্থনা।
লেখক: বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত
সূত্র: প্রথম আলো