'রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রযুক্তি সেকেলে ও অনুপযুক্ত'
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০১৬, ০০:৪২
রামপাল প্রকল্পকে ‘একটি দ্বিতীয় শ্রেণির বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতে ‘সেকেলে ও অনুপযুক্ত প্রযুক্তি’ ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে নাগরিক সংগঠন ‘সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি’।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে পাঁচজন ‘আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞের’ মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ওই প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছে এই কমিটি।
বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি বলছে, ভূমিকম্প ও প্লাবন বিষয়ে ঝুঁকির কথা এ প্রকল্পে ‘বিবেচনায় রাখা হয়নি’। ফলে প্রকল্পের চারপাশের জলাশয়ে ভারী ধাতুর দূষণ ঘটতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতে ‘সেকেলে ও অনুপযুক্ত প্রযুক্তি’ ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা সুন্দরবন ও আশেপাশের জনপদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব প্রতিরোধে ‘সক্ষম নয়’।
অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এই স্থাপনা বাংলাদেশকে ‘ফাঁকা পকেটে’ পরিণত করবে এবং তা থেকে মুক্তির ‘উপায় থাকবে না’- এমন শঙ্কাও প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে।
শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল বলেন, “আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সকল ভুল তথ্যভিত্তিক প্রচার বন্ধ করে এখানে সন্নিবেশিত আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের প্রদত্ত মতামত বিবেচনা ও গ্রহণ এবং বাংলাদেশের আপামর জনগণের দাবি মেনে নিয়ে সর্বোতভাবে সুন্দরবন ও দেশের সার্বিক পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর রামপাল প্রকল্প অবিলম্বে বাতিল করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।”
মূল্যায়ন প্রতিবেদন তুলে ধরে সুলতানা কামাল বলেন, "রামপাল নিয়ে ‘সমন্বিত ও সঠিক পরিবেশগত প্রভাব নিরুপণ’ না হওয়ায় সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি ‘নিরপেক্ষ, নির্মোহ ও প্রকৃত’ বিশেষজ্ঞদের খোঁজ করে তাদের মাধ্যমে রামপাল প্রকল্পের বায়ু দূষণ প্রশমন প্রযুক্তি, পানি দূষণ, ভূমি ধস, ভূমিকম্প, কয়লা জমা করার পুকুর ও কয়লার ছাইসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এই বিশ্লেষণ তৈরি করেছে। সকল বিশেষজ্ঞের সর্বসম্মত মতামত হচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাতিল করতে হবে”।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পাঁচজন ‘নিরপেক্ষ’ বিশেষজ্ঞ আলাদা পাঁচটি বিষয়ে তাদের মতামত দিয়েছে। এর ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির এই মূল্যায়ন প্রতিবেদন।
এর মধ্যে ভারতীয় বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ ও জ্বালানী বিষয়ক পরামর্শক রঞ্জিত সাহু রামপাল প্রকল্পের বায়ু দূষণ ঝুঁকি নিয়ে; যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবাদী সংগঠন ওয়াটার কিপার অ্যালায়েন্সের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পানি দূষণ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডোনা লিসেনবি রামপালে পানি দূষণের সম্ভাব্যতা নিয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেব নিয়েমেইয়ার রামপাল প্রকল্পের কয়লার ছাই নিয়ে মূল্যায়ন দিয়েছেন।
এছাড়া কয়লার ছাই অপসারণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জিও-হাইড্রো ইনকরপোরেশনের জলীয় ভূতত্ববিদ্যা ও ভূ-বিদ্যা ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ চার্লস এইচ নরিস এবং সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিকম্প ঝুঁকি নিয়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেমন্ট-ডোহার্টি আর্থ অবজারভেটরির গবেষক ক্লাউস এইচ জ্যাকবের মতামত নেওয়া হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
একজন ‘বিশেষজ্ঞের’ মতামত তুলে ধরে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রস্তাবিত স্থান নিরাপদ রাখার বিষয় নিশ্চিত করতে বিশাল খরচ হবে। ফলে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম সহজলভ্য রাখা সম্ভব হবে না। বরং ওই এলাকায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রকল্প ভালো বিকল্প হতে পারে।
প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের বরাতে যা বলা হয়েছে-
>> রামপালের প্রস্তাবিত নাইট্রাস অক্সাইট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনাটি ৩০ বছরের পুরাতন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মত। এ ধরনের যন্ত্রপাতি কোনো উন্নত দেশ ব্যবহার করবে না।
>> পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পারদ অপসারণে এই কেন্দ্র অনুপযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার করবে। প্ল্যান্ট থেকে অপসারিত পারদ সুন্দরবনের মাছ ও কাঁকড়া প্রজাতির জলজ খাদ্যচক্রে যুক্ত হবে।
>> রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তার বেরিয়ে যাওয়া পানির পুনঃব্যবহার করবে না। অথচ ভারতীয় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে তা অবশ্যই রাখতে হবে।
>> কয়লার ছাইয়ে পানি ব্যবহারের ফলে বিষাক্ত কয়লার কাদা তৈরি হবে।
>> বঙ্গোপসাগর থেকে রামপাল প্রকল্প পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার নদীপথ ড্রেজিং করতে হবে। এতে করে ৩৪ মিলিয়ন ঘন মিটার নদীর তলা খনন হবে। আর ওই স্থানেই মাছ, কাঁকড়া ও ডলফিনের আবাসস্থল।
>> রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার গুঁড়া ব্যবস্থাপনার সুযোগ সীমিত।
>> বড় ভূমিকম্প, আঞ্চলিক ও স্থানীয় ভূমির বিচ্যুতির সম্ভাবনার বিষয়গুলো প্রকল্প পরিকল্পনায় গুরুত্ব পায়নি। ফলে দুর্যোগ ঘটলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ওই এলাকা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
ভারতীয় বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ রঞ্জিত সাহু স্কাইপের মাধ্যমে সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেন এবং রামপাল প্রকল্প নিয়ে নিজের মতামত তুলে ধরেন। কয়েকজন সাংবাদিকের প্রশ্নেরও জবাব দেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব মো. আবদুল মতিন, অধ্যাপক এম এম আকাশ, সিপিবি বাসদের কেন্দ্রীয় কমটির সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স, সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য শরীফ জামাল উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, সুন্দরবনের কাছে বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক এই ‘মৈত্রী সুপার পাওয়ার থারমাল’ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে; যার ক্ষমতা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা নিয়ে কয়েকটি সংগঠনের আন্দোলনের মধ্যেই ইউনেস্কো এক প্রতিবেদনে নিজেদের উদ্বেগ তুলে ধরে সরকারকে চিঠি পাঠিয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড দাবি করেছে, তারা ইউনেস্কোর চিঠিতে ৩৬টি ভুল পেয়েছে। জাতিসংঘ সংস্থাটির প্রতিবেদনের জবাব পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে তৈরি করেছে বলেও গণমাধ্যমে খবর এসেছে। তাতে বলা হয়েছে- রামপাল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে কয়লা ছাড়া অন্য কোনো উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় কি না, তা যাচাই করছে সরকার।