পাঠ্যবইয়ে ভুল ঘিরে সমালোচনা, শোধরাতে কমিটি
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০১৭, ২১:৩৬
নতুন পাঠ্যবইয়ের একাধিক 'মারাত্মক' ভুল নিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন মহলের তীব্র সমালোচনার পর এসব পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এনসিটিবির সদস্য (অর্থ) অধ্যাপক কাজী আবুল কালামকে আহ্বায়ক করে গঠিত তিন সদস্যের এই পর্যালোচনা কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা জানান, যেসব ভুল নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে সেগুলো ছাড়াও নতুন শিক্ষাবর্ষের সব বই পরিমার্জনে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের ইতোমধ্যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার তিনি বলেন, “পাঠ্যবইয়ের সব ভুল-ক্রটি ঠিক করে সংশোধনী শিট দেওয়া হবে।”
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারও জানিয়েছেন, পাঠ্যবইয়ের ভুল দ্রুত সংশোধন করতে এনসিটিবিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেসব কর্মকর্তার অবহেলায় পাঠ্যপুস্তকে ভুল হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছেন মন্ত্রী।
অধ্যাপক নারায়ণ বলেন, “ভুলগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে হয়। কোথায় কীভাবে ক্রটি হয়েছে জানতে পুরো বইগুলো দেখা হবে। কমিটি বলেছে, আরেকটু সময় লাগবে। যারা বই রচনা করেছেন, পাণ্ডুলিপি দেখেছেন …।”
প্রতি বছরই নতুন বই প্রকাশের পর পরিমার্জন করা হয় জানিয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন বই প্রকাশ করা হয়।
তিনি বলেন, “এত কাজের মধ্যে কিছু ভুল-ক্রটি হয়, সবার সাহায্য নিয়ে তা সংশোধন করব। ভুল কোন পর্যায় থেকে এসেছে সেটা বের করা হবে।… যেটা হয়েছে হয়েছে, একটা সংশোধনীতে যেতে হবে, আমরা সংশোধনী দেব।”
২০১২ সালে তৈরি করা নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী ২০১৩ সালের প্রথম দিন নতুন বই হাতে পায় শিক্ষার্থীরা। সে সময়ও ভুল-ক্রটি সংশোধন করা হয়েছিল জানিয়ে অধ্যাপক নারায়ণ বলেন, “এখনও ওই কারিকুলামই আছে। তবে কোনো গল্প পরিবর্তন, ভুল থাকলে সেগুলো পরিবর্তন অর্থাৎ, পরিমার্জন করা হয়েছে। কোনো একটা কবিতা দেওয়া হয়েছে কিন্তু দেখা গেল ওই কবিতাটি ওই বাচ্চার জন্য কঠিন হয়ে গেছে তখন আমরা ওরকম একটা কবিতা রিপ্লেস করে দিই।”
যেসব বিষয়ে সমালোচনা
গত ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই যাওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন ভুল-ক্রটি ধরে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে সমালোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,
প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ে বর্ণ পরিচয়ে লেখা হয়েছে, ‘ও’-তে ওড়না চাই; যা নিয়ে ফেইসবুকে চলছে তুমুল সমালোচনা। তবে ২০১২ সালে নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী ২০১৩ সালে বিতরণ করা বইয়েও ‘ও’-তে ওড়না চাই বাক্যটি লেখা ছিল।
এছাড়া তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি বিকৃত করা হয়েছে। প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ে শুনি ও বলি পাঠে একটি ছাগলের ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে, অজ (ছাগল) আসে। আম খাই। এক সময় অ-তে অজগর শেখানো হলেও তার বদলে শিশুদের বইয়ে প্রায় অপ্রচলিত ‘অজ’ শব্দের ব্যবহার সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আবার আম খাওয়া বোঝাতে একটি আম গাছের নিচের অংশে দুই পা তুলে একটি ছাগলের দাঁড়িয়ে থাকার ছবি দেওয়া হয়েছে যা অনেকেই অবাস্তব বলে অভিযোগ তুলেছেন।
তৃতীয় শ্রেণির একটি বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবির নিচে ইংরেজিতে একটি বাক্য লেখা হয়েছে ভুল বানানে। ওই বাক্যে আঘাত করা বোঝাতে গিয়ে হার্ট বানান লিখতে ভুল হয়েছে; লেখা হয়েছে, DO NOT HEART ANYBODY.
অষ্টম শ্রেণির গল্পের বই আনন্দপাঠে সাতটি গল্পের সবগুলোই বিদেশি লেখকের গল্পের বাংলা অনুবাদ; দেশি লেখকের কোনো গল্প সেখানে নেই। এ নিয়েও সমালোচনা করেছেন কেউ কেউ।
এসব ব্যাপারে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এই বয়স থেকেই যদি বাচ্চাদের মনের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দিতে থাকি তাহলে কি হবে? ওড়না শব্দটি ব্যবহারের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। যে বা যারা করছেন তারা যদি বিশেষজ্ঞই হন, তাহলে কী মনে করে এটা লিখেছেন তা বোধগম্য নয়, এগুলো দেখার কি কেউ নেই?”
শিক্ষাবিদদের সঙ্গে এনসিটিবির সভায় অপ্রচলিত শব্দ অজ (ছাগল) ব্যবহার নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছিল জানিয়ে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “বলেছিলাম, অপ্রচলিত শব্দ দিয়ে প্রথম শ্রেণির বাচ্চা, অভিভাবক ও শিক্ষকদের বিভ্রান্ত করার প্রয়োজন নাই, সেটা উনরা শুনেননি।”
তবে ভুল স্বীকার করায় এনসিটিবিকে সাধুবাদ জানিয়ে রাশেদা বলেন, “দায়বদ্ধতার জায়গাটা কার? ভবিষ্যতেও এটা যে ঘটবে না সেটার নিশ্চয়তা কোথায়? দোষীদের অবশ্যই দায়বদ্ধতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।”
তিনি বলেন, “এনসিটিবিতে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম দেখার জন্য একটি অংশ এবং প্রিন্টিং, টেন্ডার, কেনাকটা- এসব করা উচিত আরেকটি অংশের। বই ছাপানোর কাজে বেশি সময় দিতে গিয়ে তারা অ্যাকাডেমিক বিষয়গুলোতে সময় দেয় না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “মন্ত্রণালয়ের স্ট্রং পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কারণ (শিক্ষাখাতে) যেটুকু সুনাম হয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।”
পাঠ্যবই থেকে যুক্তাক্ষর তুলে দেওয়া ‘অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত’ বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক মনজুরুল।
তিনি বলেন, “সব কিছুকেই কেন সহজ করতে হবে? ছোটবেলায় যদি যুক্তবর্ণ না শেখে তাহলে কখন শিখবে? মাতৃভাষা যদি সহজ করে শেখাতে হয়… এটা তুঘলকি কাণ্ড, এগুলো পরিহার করতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. দেলোয়ার হোসেন শেখ পাঠ্যবই প্রণয়নে সংশ্লিষ্টদের আরও সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে বলন, “শিশুরা এখন থেকেই যদি ভুল শেখে তাহলে আজীবন তা তাদের মধ্যে থেকে যাবে। সবারই যে কোনো এক ধরনের বানানরীতি অনুসরণ করা উচিত।”
অধ্যাপক দেলোয়ার বলেন, “শুধু সংশোধনী দিলেই হবে না। আমি মনে করি শিশুদের বইগুলো নতুন করে মুদ্রণ করে দেওয়া উচিত।”
উল্লেখ্য, বছরের প্রথম দিন ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫৩ হাজার ২০১ জন শিক্ষার্থীর হাতে এবার ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার বই ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করে সরকার।