অণূগল্প

দাঙ্গা

প্রকাশ : ১৫ এপ্রিল ২০১৭, ২২:০১

ফিরোজ আহমেদ

হঠাৎ করে কুকুরটা টের পেল বাড়ির কেউ তাকে আর খাবার দিচ্ছে না। আগে একটা মাটির সানকিতে নির্দিষ্ট সময়ে, সকালে, দুপুরে কিংবা রাতে, তিনবেলাই খাবার দিয়ে যেত বাড়ির কেউ না কেউ। কিন্তু আজ কয়েকদিন এর ব্যাতিক্রম। প্রথমে সে কিছু আমলে নেয়নি। অপেক্ষায় থেকেছে। বাড়ির কেউ বাইরে এলেই ভেবেছে যে, এবার বোধহয় খাবার আসছে...কিন্তু দেখা গেছে তার কথা সবাই মনে হয় ভুলে গেছে। আগে ভোরবেলা গৃহকর্তা বেরিয়ে এসে পুকুর ঘাটে যেত। বাচ্চারাও কেউ কেউ ঘুম থেকে উঠে পড়ত...মেয়েরা তুলসীতলায় প্রথামত জোড়হাতে একবার মাথা নুইয়ে মুরগির খাঁচা খুলে খুদ দিত। চুলোয় রান্না বসাতো। ভাপ ওঠা ভাত সবার খাওয়া হলে, তার জন্য নির্দিষ্ট মাটির সানকিতে দেয়া হতো ভাত বা অন্য কিছু। এখন এসকল রুটিনের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছে। মেয়েরা কেমন যেন গলায় কান্না আটকে ঘুরে বেড়ায়। সকালের রান্না কখন হয় তার ঠিক নেই। বাচ্চারা কাঁদতেও ভুলে গেছে...এসব কিছু সে নিশ্চুপ দেখে। শুধু গভীর রাতে অমঙ্গল আশংকায় একাকী আকাশের দিকে মুখ তুলে করুণ সুরে বিলাপ করে।

এমনিই প্রকৃতিগতভাবে সে একাহারী। দিনে একবার খাবার পেলেই চলে। কিন্তু গৃহস্থবড়িতে থেকে তিনবেলা খেয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে। তার প্রখর বোধশক্তি তাকে সাবধান করলো...আর তিনবেলা নয়, বোধহয় একবেলা। যখন একবেলাও কিছু জুটলো না, অবচেতনে সে বুঝলো তার আহারের নিয়মিত যোগান আর নেই। নিজের ব্যবস্থা নিজেরই করতে হবে। সে এখন পাড়াময় ঘুরে বেড়ায়, কোথাও উচ্ছিষ্ট পেলেই মুখ দেয়। প্রায়ই ধাওয়া খায়, মারও খায়, আবার মাঝেমধ্যে কেউ কেউ হয়তো বাসি-পচা এঁটো-কাঁটা ছুড়ে দেয় দয়াবশতঃ। এভাবেই চলতে থাকলো, শুধু অভ্যাসমত প্রতিবেলায় এসে হাজির হয় পুরাতন উঠানে...হাঁটু মুড়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর তাই তুলে বেরিয়ে পড়ে খাদ্যান্বেষণে...

এমনই বসে থাকার একদিন। তখন বেশ সকাল। চারিদিকে ভালো করে আলো ফোটেনি। ঘরের অভ্যন্তরে কেমন যেন চাপা উত্তেজনা চলছে। নীচু স্বরে বয়স্করা নির্দেশনা দিচ্ছে-

–তাড়াতাড়ি কর। আলো ভালো করে ফোটার আগেই বেরিয়ে পড়তে হবে। নিবারণ নৌকা তৈরী রেখেছে। দেরি হলে মুশকিল হবে..
–আহ! অতবড় ট্রাংক নিয়ে টানাটানি করছো কেন? পথে কে ঘাড়ে নেবে এসব?

সে বোঝে মারাত্মক বিপর্যয়ের শেষ পর্ব চলছে। পরিস্থিতি ভুলে সে আকাশের দিকে মুখ তোলে, করুণ সুরে বিলাপ করে, করতেই থাকে থেমে থেমে...

একসময় ঘরের সবাই বেরিয়ে আসে, কাঁধে-ঘাড়ে বোঁচকা নিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে নদীর দিকে। লেজ নাড়িয়ে তাদের অনুসরণ করে সে। সবাই নৌকায় ওঠে অতি দ্রুত...শুধু মাঝবয়েসী স্ত্রীলোকটি গলবস্ত্র হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে চোখের পানি মুছে নৌকার শেষ যাত্রি হয়। নৌকা দূরে মিলিয়ে যায়...কুকুরটা পাড়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ ফরিয়াদে দেখে। তারপর পূর্বপথে ফিরে যায় সকালের খাবারের অন্বেষণে...

সময়টা ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাস... 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত