কুকুরদের প্রতি অনন্য ভালোবাসা
প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:১৫
রাজধানী আবাসিক এলাকা ধানমন্ডির জনপ্রিয় স্থান ‘ধানমন্ডি লেক’। প্রাতঃভ্রমণ থেকে শুরু করে কাজ শেষে সন্ধ্যায় একটু আড্ডা, ক্ষণিকের জন্য হলেও এখানেই প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে যান নগরবাসীরা। বিশেষত বিকালে প্রণয়যুগলদের আড্ডায় মুখরিত হয়ে উঠে এই লেক। ধানমন্ডি লেকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি দ্বিধায় ফেলে- লেকে পানির পরিমাণ বেশি, নাকি প্রেমের?
চিরচেনা এই ধানমন্ডি লেকের পরিচিত দৃশ্যের ভিড়ে একটা দৃশ্য একটু অন্যরকম। এই গল্পের মধ্যমণি এক তরুণী, চারপাশে যাকে ঘিরে আছে অনেকগুলো কুকুর। বিদেশী নয়, লেক ও তার আশেপাশে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এদের। দূর থেকে তরুণীর ছায়া দেখে কিংবা কণ্ঠ শুনে ছুটে আসছে অন্য কুকুর। অনেকের মতো আমিও আঁতকে উঠলাম। ভাবলাম এই বুঝি এসে তাকে আক্রমণ করে বসে। কিন্তু একি দেখছি! হন্যে হয়ে ছুটে আসা কুকুর নতজানু হয়ে জড়িয়ে রয়েছে তরুণীর গলায়! একে একে খাবার খাইয়ে কুকুরগুলোর মাথায় হাত বুলাচ্ছেন তিনি। এমন দৃশ্য পশ্চিমের দেশগুলোতে বিরল না হলেও আমাদের দেশে অকল্পনীয়।
ভেতর থেকে খুব ইচ্ছে হলো তরুণীর সাথে কথা বলি। তার কুকুরগুলোর মাথায় একটু হাত বুলাই। সামনে গিয়ে পরিচয় দিয়ে বললাম- একটা সাক্ষাৎকার পাবো কি? শর্ত দিলেন তিনি- একটি শব্দও বাড়িয়ে লেখা যাবে না, তবেই মিলবে কথা বলার সুযোগ।
রাজি হলাম। শুরু হলো ভালোবাসার এক অনিন্দ্য সুন্দর আখ্যান। কলেজপড়ুয়া তন্বী ২০০৯ সালে ৯ বন্ধু মিলে আড্ডা দিতেন ধানমন্ডি লেকে। নিয়মিত আড্ডায় লেকের কিছু কুকুরের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাঁর। দিন যেতে থাকে, তন্বীর মমতার স্পর্শে বাঁধা পড়ে অবুঝ চতুষ্পদেরা। তখন প্রতিদিনের টিফিন খরচ ১০০ টাকা থেকে ৫০ টাকা আলাদা করে তিনি কুকুরের জন্য খাবার কিনে আনেন। এভাবেই আট বছর কেটে যায়। ক্লাস, খাওয়া, ঘুমের মত রুটিন করেই প্রতিদিন বিকেলে ধানমন্ডি লেকে কুকুরের খাবার যোগাড় এবং পরিচর্যা করে আসছেন তিনি। প্রথম দিকে মাসে গড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা খরচ হলেও বর্তমানে কুকুরের সংখ্যা এবং খাবারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খরচও বেড়েছে অনেক। তখন পাশে দাঁড়ান রুহেল আহমেদ।
অবুঝ প্রাণীদের প্রতি মমতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য রুহেল আহমেদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তন্বী। বলেন, “কুকুরগুলো আমাদের যতটুকু ভালোবাসে, তার কাছে এই অর্থ কিংবা পরিশ্রম খুব তুচ্ছ মনে হয়”। তাঁর চোখে খেলে যায় অবাধ মমতা, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি।
আমাদের চারপাশে অ্যারিনা মঞ্চে তখন জাঁকিয়ে বসেছে টাইগার, মাইকেল, বাঘা, ডগি, সাধু, লালী, কালু, টমি, লায়ন, মতি, বুলেট এবং টাকনা। রোমিও নামের যে বয়স্ক কুকুরটি ছিলো সেটি এখন লেকের দ্বীপের দিকে থাকে। তন্বীকে দেখলে রোমিও এমনভাবে দৌড়ে আসে যেনো বহুদিন পর মুক্ত আকাশ পেয়ে গোত্তা খাচ্ছে লাল-নীল ঘুড়ি।
এখন বিস্তৃত হয়েছে কুকুরের প্রতি তাঁর ভালোবাসার পরিসর। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কুকুরের খোঁজ-খবর নেন। তন্বী বলেন, “প্রধানত দুটি কারণে ঢাকায় কুকুরের সংখ্যা বাড়ছে না। দুর্ঘটনায় মৃত্যু এবং বন্ধ্যাকরণ কার্যক্রম। এরমধ্যে রহস্যজনকভাবে গুলশান-বনানী এলাকায় কোন কুকুরই নেই।” সিটি কর্পোরেশনের নেওয়া হত্যা না করে কুকুরকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কর্মসূচিকে সাধুবাদ জানিয়ে তন্বী জানান, জোরালোভাবে বেল্ট পরানো কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি। কুকুরের গলায় বেল্ট দেখলে মানুষ নিরাপদ বোধ করে। নিম্নমানের বেল্ট পরানো হলে অন্য কুকুরের সহায়তা নিয়ে কুকুর তা ছিঁড়ে ফেলে। তাই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে কুকুরের গলায় ভালো মানের বেল্ট পরানোর কার্যক্রম সফল করা গেলে অনেক সমস্যাই আর থাকবে না। যদিও কুকুর নিয়ে সমস্যাগুলো মানবসৃষ্ট। কুকুর বলতেই আমাদের মনে একধরনের আতংক কাজ করে। অনেক বেশি ক্ষুধার্ত কিংবা অসুস্থ মানুষের আচরণ কী স্বাভাবিক থাকে? খাবার এবং চিকিৎসা পেলে কুকুর নিয়ে কোন সমস্যা থাকার সম্ভাবনা নেই।
খাবার নিয়ে বলতে গিয়ে তন্বী মজার একটা কথা জানান। কুকুরের জন্য খাবার যোগান দিতে তিনি এবং তাঁর বন্ধু কারওয়ান বাজারের মুরগীর দোকান থেকে চামড়া সংগ্রহ করেন। নিয়মিত বস্তা হাতে মুরগীর চামড়া সংগ্রহে যেতে যেতে কারওয়ান বাজারের সকল দোকানদারই তন্বীকে চিনেন। তার জন্য আগে থেকেই বস্তা করে মুরগীর চামড়া প্রস্তুত করে রাখা হয়। তন্বীকে দেখলে তাদের কমন ডায়ালগ- ‘আপা আইছেন, এই নেন আপনার জন্য চামড়া বস্তাভরে রেখেছি’!
তন্বী জানান, প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে চামড়া জমা হয় কারওয়ান বাজারের মুরগীর দোকানগুলোতে। দিন শেষে এই চামড়া পিক-আপ ভাড়া করে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হয় ব্যবসায়ীদের। অথচ শুধু এই চামড়াটাই যদি সংগ্রহ করা যেতো তবে এই শহরের কুকুরের জন্য খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যেতো। শুধু খাবার নয়, সমন্বিত ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করা গেলে রাজধানীর সকল কুকুরের বাসস্থানেরও ব্যবস্থা করা সম্ভব।
অনেক সময় কুকুরের পিঠের চামড়ায় অনেকগুলো দাগ দেখা দেয়। দাগের আশেপাশে পশম থাকে না। তন্বী জানালেন সেভলন দিয়ে তিন-চারদিন গোসল করিয়ে দিলে এই রোগ সেরে যায়। প্রায়শই কুকুরের এ রোগ দেখা দেয়। মাত্র ১৫০ টাকা খরচ করেই রোগটি সেরে ফেলা যায়। কিন্তু কুকুরের সংখ্যা যখন অনেক, রোগীর সংখ্যা বেশি, তাই খরচটাও বেশি দাঁড়িয়ে যায়। তাছাড়া এই কাজটি নিয়মিত করতে অনেক কর্মীরও প্রয়োজন। সরকারি পশু হাসপাতালে অসুস্থ কুকুর নিয়ে গেলে পকেট ফাঁকা হয়ে যায়। একটি টিস্যু পেপারও সেখানে ফ্রিতে পাওয়া যায় না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পশুর চিকিৎসা ব্যয় নাগালের বাইরে। তাছাড়া মেডিসিন ও ভ্যাকসিনগুলো দুর্মূল্য। সবকিছু মিলিয়ে পশুদের জন্য বাসস্থান, খাদ্য ও চিকিৎসা নিশ্চিৎ করার কাজটি ব্যক্তিগতভাবে করতে গেলে অনেক কঠিন। তবে শক্তিশালী কমিউনিটি তৈরি করতে পারলে এটি কঠিন কিছু নয়। পশু এবং পরিবেশের প্রতি আমাদের রাষ্ট্র পূর্বের তুলনায় এখন অনেক সচেতন হয়েছে। নতুন অনেক ভাবনা এবং কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে। আশাকরা যায় অল্প সময়ের মধ্যেই একটা বড় পরিবর্তন আসবে।
শক্তিশালী একটি কমিউনিটি তৈরির চেষ্টা করছেন তন্বী। প্রথম টার্গেট ঢাকা, এরপর সারাদেশে থাকবে তাঁদের নেটওয়ার্ক। শুধু কুকুর নয়, যেকোন পশুর নিরাপত্তার জন্য তাদের কমিউনিটি ভূমিকা রাখবে।
আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে কথা শেষ করে তন্বী মিষ্টি হাসলেন। ঠোঁটের কোণে বোধহয় একটা দীপ্তি খেলে গেলো। তারপর উঠে দাঁড়ালেন, কুকুরদের খাবার দিতে হবে।