সুইপার কলোনি থেকে গ্র্যাজুয়েটের সারিতে সনু, মিনা
প্রকাশ : ০২ মে ২০১৯, ১৫:৩৫
সমাজের ভদ্রলোকদের কাছে যারা অচ্ছ্যুত সেই সুইপার কলোনির সাধারণ মেয়ে তারা। যে সম্প্রদায়ে তাদের জন্ম তাতে আরও অনেকের মতো তাদেরও হয়তো নিয়তি ছিল শৈশবে বা বড়জোর কৈশোর পর্যন্ত কয়েক ক্লাস পড়ে তারপর স্বামীর সংসার সামলানো কিংবা সুইপারের কাজ করা। কিন্তু নিজের ভাগ্য নিজের হাতেই লেখার অদম্য ইচ্ছায় সমাজের ভ্রূকুটি ও হাজারো প্রতিবন্ধকতা দূর করে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন নারায়ণগঞ্জের টানবাজার সুইপার কলোনির সনু রাণী দাস ও তার বান্ধবী মিনা রাণী।
এই সুইপার কলোনিতে ১৫০টি পরিবারের বাস। ১৯৬৪ সালে এই কলোনির শিশুদের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। সেই থেকে এই একটি স্কুলই তাদের ভরসা। অথচ ২০০৬ সালের আগে সেই কলোনি থেকে কেউ মাধ্যমিকের গণ্ডিও পার করেননি। নারায়ণগঞ্জের হরিজনদের মধ্যে সনু এবং তার দুই বান্ধবী মিনা ও পূজাই প্রথম এসএসসি পাস করেন। কিন্তু এই অনগ্রসরতার পেছনে কি কারণ?
সনু মনে করেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় হরিজন সম্প্রদায়ের অনাগ্রহের একটা প্রধান কারণ হচ্ছে ভাষা। সুইপারদের মাতৃভাষা হিন্দি হলেও পাঠ্যবইগুলো লেখা হয়েছে বাংলায়। স্কুলের শিক্ষকদের ভাষা, পাঠ্যবইয়ের ভাষা সবই ভিন্ন হওয়ায় লেখাপড়ায় কোন আনন্দ খুঁজে পায় না এখানকার শিশুরা। ফলে প্রাথমিক পর্যায়েই ঝরে পড়ে তারা। এছাড়া পরিবারগুলোর অসচেতনতা ও অর্থনৈতিক দৈন্যতাও এর পেছনে ভূমিকা রাখছে।
কিন্তু এতসব বাধা পেরিয়েও সুইপার কলোনির প্রথম গ্র্যাজুয়েট হিসেবে নিজেদের নাম লিখিয়েছেন সনু ও মিনা। মেথরপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শেষ করে সনু ও তার বান্ধবী মিনা ভর্তি হন র্যালিবাগান গণবিদ্যা নিকেতন উচ্চবিদ্যালয়ে। এরপর নারায়ণগঞ্জ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে স্নাতক (বিবিএস) করেন দু’জন। এবার তাহলে ভবিষ্যতের কি পরিকল্পনা?
মিনা বলেন, আমরা যখন বাইরের স্কুলে পড়াশোনা করতে যাই, তখন অনেকেই বলেছে, মেয়েমানুষ এত পড়াশোনা করে কী হবে? শেষ পর্যন্ত তো চুলাই সামলাতে হবে। তাই আমরা যদি আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে না পারি তাহলে ভবিষ্যতে এই কলোনির মেয়েদের জন্য একটা বাজে উদাহরণ হয়ে থাকবে। আর কোন মেয়েকে কেউ পড়তে উৎসাহ দিবে না।
তাহলে কি সেই স্বপ্ন সনু ও মিনার চোখে?
সনু বলেন, আমি আমার কলোনির শিশুদের নিয়েই কাজ করতে চাই। শিশুদের বাংলা শেখানোর জন্য শিক্ষক হতে চাই যেন তারাও বাংলাটা শিখে নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করার পথে এগুতে পারে। নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি এটাই আমাদের দায়বদ্ধতা।
জানা যায়, নামমাত্র মূল্যে কিংবা বিনা পারিশ্রমিকেই কলোনির শিশুদের পড়ান সনু। সনু ও মিনা মনে করেন তাদের প্রাথমিক স্কুলে কলোনি থেকেই শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হলে শিক্ষার সাথে এখানকার শিশুদের ব্যবধান অনেক কমে আসবে। আর তাই প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবেদন করেছেন সনু, মিনা দু’জনেই। এখন অপেক্ষায় আছেন পরীক্ষার।
মেথরপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও মনে করেন, সুইপার কলোনির স্কুলগুলোতে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্য থেকেই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলে তা আরও ফলপ্রসূ হবে।
প্রধান শিক্ষিকা অর্চনা রানী সাহা বলেন, শুধুমাত্র ভাষার প্রতিবন্ধকতার কারণে কলোনির ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ শিক্ষার্থী প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ে। তাই কলোনির বাসিন্দাদের মধ্য থেকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হলে এখানকার শিশুদের লেখাপড়ার প্রতি আরও আগ্রহী করে তোলা যাবে।
কিন্তু সেদিন কি আসবে? সুইপার কলোনির শিশুদের জীবনে কি ঘুচবে অশিক্ষার অন্ধকারে থাকার নিয়তি? আপাতত এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য কেবল অপেক্ষাতেই আছেন সনু, মিনা ও তাদের মতো হবার স্বপ্ন দেখা আরও অনেক শিশু। আশায় আছেন দেশের উন্নয়নের একজন অংশীদার হবার।