জয়ললিতা: লাস্যময়ী অভিনেত্রী থেকে গণমানুষের আম্মা
প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:২৩
একজন অভিনেত্রী থেকে ভারতের গণমানুষের প্রিয় নেতা, 'আম্মা' হয়ে উঠা এক নারী জয়ললিতা জয়রাম। শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয় শুরু করে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হয়ে উঠা এই নারী সোমবার রাতে মৃত্যুবরণ করেছেন। তামিলনাড়ু রাজ্যের পাঁচবারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাবিড় মুন্নেত্র কাজাগাম পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া জয়ললিতা তার ভক্তদের কাছে আম্মা, পারাচি থালাভি, থাঙ্গা গপুরাম, থাঙ্গা চিল্লাই, এবং থাঙ্গা থারাগাই (স্বর্ণময়ী নারী) এরকম নানা নামে পরিচিত। জনগণের কাছে বিশাল জনপ্রিয়তা এবং একই সাথে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ হওয়া ইত্যাদি নানা কারণেই এই সফল ও সমৃদ্ধ এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জীবনকাহিনীও ঘটনাবহুল ও বৈচিত্র্যময়।
জন্ম ও শৈশব
১৯৪৮ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি মাইসোরের মেলুকোটে তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয় জয়ললিতার। তারা বাবা জয়রমন এবং মা ভেদাভাল্লি। মাইসোরের যে দুটি বাসায় তার পরিবার থাকতো তার একটির নাম ছিল জয় বিলাস, আরেকটি ললিতা বিলাস। সেখান থেকেই তার নাম রাখা হয় জয়ললিতা। মাত্র দুই বছর বয়সে বাবাকে হারান জয়ললিতা। মা ভেদাভেল্লি তখন বাপের বাড়ি ফিরে আসেন। জয়ললিতার মাসী পদ্মাভেল্লি তখন মাদ্রাজে থাকতেন এবং ছদ্মনামে নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন। জয়ললিতার মাও মাদ্রাজ গিয়ে নিজের বোনের সাথে থাকতে শুরু করেন এবং একসময় নিজেও চলচ্চিত্রে ছদ্মনামে অভিনয় করতে শুরু করেন।
জয়ললিতা বেঙ্গালুরের বিশপ কটন গার্লস স্কুলে পড়াশুনা করেন। মাসী পদ্মাভেল্লির বিয়ের পর চেন্নাই চলে এসে সেখানে মায়ের সাথে থাকতে শুরু করেন। স্যাক্রেড হার্ট ম্যাট্রিকুলেশন স্কুলে পড়াশুনা করার সময় তিনি সরকারি বৃত্তি পান। দশম শ্রেণীতে পুরো তামিলনাড়ুতে প্রথম হওয়ায় গোল্ড স্টেট অ্যাওয়ার্ড পান তিনি। তিনি তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালায়লাম সহ বেশ ক'টি ভাষা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলতে পারতেন।
চলচ্চিত্রে পদার্পন
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নৃত্যে দক্ষতা অর্জন করার পর ১৯৬১ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। এপিস্টল নামে একটি ইংরেজি ছবিতে প্রথম শুটিং শুরু করেন। এরপর কন্নড় ও হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেন। ১৯৬৪ সালে কন্নড় ছবি ‘চিন্নাদা গোম্বে’-তে প্রথম মুখ্যচরিত্রে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৬৫ সালে তামিল ছবি ‘ভেন্নিরা আদাই’-তে প্রথম মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেন জয়ললিতা। একই বছরে তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে জয়ললিতার রাজনৈতিক গুরু এম জি রামচন্দ্রনের বিপরীতে প্রথম অভিনয় করেন। এরপর জয়ললিতা-রামচন্দ্রনের দু’যুগের রঙীন সম্পর্কের সূচনা হয়।
১৯৭৩ সালে একসঙ্গে ২৮টি ছবিতে অভিনয় করার পরে পার্টি কর্মীদের চাপে এমজিআর জয়ললিতার সঙ্গে অভিনয় করা বন্ধ করে দিলেন। ১৯৮০ সালে তিনশ’র বেশী ছবিতে অভিনয় করার পরে জয়ললিতা নিজেকে সিনেমার জগৎ থেকে সরিয়ে নিলেন।
রাজনৈতিক জীবন
১৯৮২ সালে রাজনীতির জগতে প্রবেশ করেন। এম জি রামচন্দ্রনের এইআইডিএমকে পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালে এইআইডিএমকে’র প্রচারসচিব হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৯৮৪ সালে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে সংসদে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সাংসদ ছিলেন। ১৯৮৭ সালে রামাচন্দ্রন মারা যাওয়ার পর দলের কর্তৃত্ব নেন তিনি। তবে বাধা আসে রামাচন্দ্রনের স্ত্রী জানকি রামাচন্দ্রনের কাছ থেকে। এই বছরেই এমজিআরের মৃত্যুর পরে পার্টি দু’ভাগ হয়ে যায়। একদল সমর্থক রামচন্দ্রনের স্ত্রী জানকীর সঙ্গে চলে যান, আর অন্য দলটি জয়ার সঙ্গে। তবে শেষমেষ জয় জয়ললিতারই হয়, দলের প্রতীক ‘জোড়া পাতা’ দখলে রাখতে পারেন তিনি।
এমজিআর-এর মৃত্যুর পরেই অবশ্য জয়ললিতা মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেননি। তামিলনাড়ুর ২১ দিনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হলেন জানকী। কেন্দ্র রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করায় সরকার ভেঙে গেল। ১৯৮৯ সালে জয়ললিতা প্রথম বিধানসভায় নির্বাচিত হলেন। কিন্তু সরকার গড়তে পারলেন না। সরকার গড়ল ডিএমকে। ফেব্রুয়ারিতে জয়ার নেতৃত্ব মেনে নিয়ে এআইডিএমকে-এর দুই গোষ্ঠী এক হয়ে গেল। এরপর নির্বাচনে তামিলনাড়ুর রাজ্য বিধান সভায় প্রথম নারী হিসেবে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন জয়ললিতা। ১৯৯১ সালে বসেন তামিলনাড়ুর ক্ষমতায়, রাজনীতিতে দ্যুতি ছড়িয়ে সমর্থকদের মধ্যে পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘আম্মা’ হিসেবে।
১৯৯১ সালে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হলেন জয়ললিতা। ২৩৪টি আসনের মধ্যে ২২৫টি আসনে জয়ী হল তার দল। ১৯৯২ সালে পালিত পুত্র সুধাকরণের বিয়েতে প্রচুর টাকা খরচ করে বিতর্কের মুখে পড়েন তিনি। এছাড়াও আর্থিক বেনিয়মের বহু অভিযোগে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ১৯৯৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে হেরে গেলেন জয়া।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মেয়াদে দুর্নীতির অভিযোগে জয়ললিতার বিরুদ্ধে মামলা করেন বর্তমানে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা সুব্রামানিয়াম স্বামী। তার অভিযোগ ছিল, প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে জয়ললিতা মাত্র এক রুপি বেতন নিতেন। কিন্তু ওই সময়ে পাঁচ বছরে তিনি কমপক্ষে ৬৬ কোটি রুপির মালিক হয়েছেন। ডিসেম্বরে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হলেন। প্রায় এক মাস কাটালেন জেলে।
২০০১ সালে এআইডিএম-কে আবার ক্ষমতায় আসে। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি মামলার কারণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় নির্বাচনে লড়তে পারলেন না। কিন্তু দলীয় বিধায়করা জয়াকেই মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন করেন। শেষে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সরতে হয় তাকে। ২০০৩ সালে মাদ্রাজ হাইকোর্টে ক্লিনচিট পেয়ে নির্বাচনে জিতে আবার মুখ্যমন্ত্রী হলেন জয়ললিতা।
২০০৭ সালে পরের নির্বাচনে ডিএমকে জিতলে, বিরোধী দলনেতার পদে বসলেন জয়া। ২০১১ সালে তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হলেন জয়ললিতা। ২০১৪ সালে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি মামলায় জয়ার চার বছরের জেল এবং ১০০ কোটির জরিমানা। এক মাস জেলে কাটিয়ে জামিন পান তিনি। ২০১৫ সালে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি মামলায় জয়াকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়।
এ বছর আবার মুখ্যমন্ত্রী হন জয়া। ৩২ বছরে এই প্রথম পরপর দু’বারের জন্য কেউ মুখ্যমন্ত্রী হলেন তামিলনাড়ুতে।
মৃত্যু
এই বছর সেপ্টেম্বর মাসে নানা জটিলতায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন জয়ললিতা। ৪ ডিসেম্বর ২০১৬, রবিবার রাতে জয় ললিতার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে তাকে চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। সেখানে লাইফ সাপোর্টে রাখার পর ৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ দিবাগত রাতে সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে ৭ দিনের শোক ঘোষণা করে তামিলনাড়ু রাজ্য। তামিলনাড়ুর চারবারের এই মুখ্যমন্ত্রীর অন্ত্যষ্টিক্রিয়া পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। মঙ্গলবার বিকালে চেন্নাইয়ের মেরিনা বিচে এই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও অংশ নেবেন।