কিংবদন্তি ভাষা সংগ্রামী মমতাজ বেগম (কল্যাণী রানী ওরফে মীনু)
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২২:৪১
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে মমতাজ বেগমের নাম কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকালে এ সাহসী নারী ছিলেন নারায়ণগঞ্জ মর্গ্যান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। আন্দোলনে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। তিনি কোন পর্যায়েই আপস করেননি। এর ফলে তাকে স্বামীকে হারাতে হয়েছে, নানা রকম কুৎসা ও গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। তিনি কোনো কিছুর কাছে মাথা নত করেননি। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রমের মাধ্যমে নারীদের মধ্যে একটি নবজাগরণেরও সূচনা ঘটেছিল-অবরুদ্ধ সমাজের বাইরে প্রগতির পথে নারীদের রাজপথে বেরিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি করে। মমতাজ বেগম সে ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের দায়ে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করার উদ্যোগ নিলে ক্ষুব্ধ জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাকে গ্রেপ্তার করার খবর ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র ও নাগরিক সমাজ নারায়ণগঞ্জ আদালতের সামনে হাজির হয়। বিনা শর্তে তার মুক্তির দাবি করে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনি দিতে থাকে তারা।
মহকুমা হাকিম ইমতিয়াজী তখন বাইরে এসে বলেন, ‘মমতাজ বেগমকে স্কুলের তহবিল তছরুফের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাথে তার গ্রেপ্তারের কোন সম্পর্ক নেই।’ কিন্তু জনতা তা বিশ্বাস করে না। তারা বলতে থাকে, মমতাজ বেগম নারায়ণগঞ্জে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কর্মী বলেই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। সুতরাং তাকে বিনা শর্তে মুক্তি না দিলে তারা আদালত প্রাঙ্গণ ছেড়ে যাবে না। পুলিশ তখন লাঠিপেটা করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিকেলে পুলিশ মোটরযোগে মমতাজ বেগমকে নিয়ে ঢাকা রওনা হলে চাষাঢ়া স্টেশনের কাছে জনতা বাধা দেয়। তাতে পুলিশ ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ লাঠিপেটা করে। ফলে উভয় পক্ষে ৪৫ জন আহত হয়। মমতাজ বেগমকে গ্রেপ্তার সম্পর্কে রাজনীতিবিদ ভাষাসৈনিক অলি আহাদ বলেন:
২৯ ফেব্রুয়ারি মর্গান স্কুল হতে যুবলীগ নেতা সামসুজ্জোহার বাড়ি হীরামহল গমনকালে পথি মধ্যে পঁচিশ হাজার টাকা তহবিল তসরুফের মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগে পুলিশ বাহিনী মিসেস মমতাজ বেগমকে গ্রেপ্তার করে। তাকে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয় ও তার পক্ষে জামিন প্রার্থনা করা হলে তা নামঞ্জুর হয়। এমনকি ভাষা আন্দোলনের সমর্থক কয়েকজন সহৃদয় ব্যক্তি নগদ দশ হাজার টাকা মহামান্য আদালতের নিকট জামিন হিসেবে তৎক্ষণাৎ জমা দিতে চাওয়া সত্ত্বেও মিসেস মমতাজ বেগমকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়নি। পুলিশের আক্রমনে নিরস্ত্র বিদ্রোহী জনতা এক পর্যায়ে রেলওয়ে রাস্তার পাথরগুলোকে পুলিশের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। পুলিশ-জনতার সংঘর্ষে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ অফিসার জনাব দেলওয়ার হোসেন আহত হন। ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা রাজপথের উভয় পার্শ্বস্থ গ্রামগুলো হতে হাজার হাজার জনতা আন্দোলনে শরিক হন। তাছাড়া চাষাঢ়া হতে পাগলা পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় মাইল রাস্তায় একশ ষাটটি বটগাছ কেটে ঢাকামুখী পথকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। বেগতিক অবস্থাকে আয়ত্তে আনার নিমিত্তে কর্তৃপক্ষ শেষমেশ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসকে তলব করে। ....কারাগার হতে বন্ড সই করে মুক্তি ক্রয় করতে অস্বীকার করলে মিসেস মমতাজ বেগমকে তার স্বামী তালাক দেন। এভাবে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে যোগ দেয়ার অপরাধে মমতাজ বেগমের সংসার তছনছ হয়ে যায় (জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে’৭৫, অলি আহাদ: ঢাকা, ১৯৮২)।
অগ্নিনেত্রী মমতাজ বেগমের বিরুদ্ধে সরকার তখন নানা অপপ্রচার চালায়। স্পষ্টত মুসলিম লীগ সরকারের মুখপত্র দৈনিক আজাদ পত্রিকায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদ সংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েট প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি)’-এর মাধ্যমে ‘মমতাজ বেগমের বিচিত্র জীবন’ প্রচার করা হয়। ১৯৫২ সালের ২ মার্চ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়:
"নারায়ণগঞ্জ মর্গান উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষায়িত্রী বেগম মমতাজ মুনাফ সম্পর্কে গতকল্য (শনিবার) আরও কতকগুলো তথ্য অবগত হওয়া গেছে। গত শুক্রবার মমতাজ বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তা নিয়ে গতকল্য সন্ধায় নারায়ণগঞ্জে ভীষণ গোলযোগের সৃষ্টি হয়। উক্ত বিদ্যালয়ের সেক্রেটারী কর্তৃক তার বিরুদ্ধে আনীত তহবিল তসরুপের এক অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ প্রধান শিক্ষয়িত্রীর জীবন বৈচিত্র্যপূর্ণ। পূর্বে তিনি হিন্দু ছিলেন এবং তার নাম ছিলো কল্যাণী রানী, ডাকনাম ছিল মীনু। মিঃ সতীন্দ্রনাথ সেন এমএলএ-র ভ্রাতুস্পুত্র মিঃ সুবোধকুমার সেনগুপ্তের সহিত তার (মীনুর) পূর্বে বিবাহ হয়েছিল। কলকাতা থাকাকালে মীনু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জনাব মুনাফকে বিবাহ করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি পূর্ববঙ্গে আসেন এবং পুনরায় হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন। দু’বার তার বিবাহবিচ্ছেদ হয় এবং পূনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি মর্গান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষায়িত্রী হন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি হতে তিনি জনাব ওসমান আলী এমএলএ-র গৃহে অবস্থান করেছিলেন এবং গতকল্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়"।
৬ মার্চ একই পত্রিকায় আরো প্রকাশ করা হয়:
"নারায়ণগঞ্জের জনতা কর্তৃক পুলিশের হাত হতে মিসেস মমতাজ বেগমকে ছিনিয়ে লওয়ার চেষ্টা উল্লেখ করে জনাব দোহা বলেন যে, এ সম্পর্কে যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের মধ্যে ৩৭ জন হিন্দু যুবক। আশ্চর্যের বিষয় এরা সকলেই অল্প দিন পূর্বে কলকাতা হতে নারায়ণগঞ্জ আসে। গ্রেপ্তারের সময় এরা সকলেই মুসলমানি লেবাস পরিহিত ছিল। আরও লক্ষ্য করার বিষয় এ সময় গড়ে প্রতিদিন ২ হাজার জন হিন্দু পূর্ববঙ্গে প্রবেশ করতে থাকে"।
এরই মধ্যে মমতাজ বেগমের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে সোচ্চার সে রকম দুজন ছাত্রীসহ ১১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কোর্টে তার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে বিক্ষোভ চরম আকার ধারণ করে। মমতাজ বেগমকে কারাগারে আটক করা হলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বের করে আনার জন্য তার উপর চাপ প্রয়োগ করা হতে থাকে। কিন্তু তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মুচলেকা দিয়ে মুক্তি কেনার বিরুদ্ধে অবিচল থেকে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ১৯৫২ সালের মে মাসের চতুর্থ সপ্তাহের প্রথম দিকে মমজাত বেগম জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। এরপর কিছুদিন তিনি নারায়ণগঞ্জ পৌর এলাকায় কিছুটা গোপনভাবে অবস্থান করছিলেন।
উল্লেখ্য, মমতাজ বেগম ১৯১৬ সালের ২০ মে ভারতের ভোপাল রাজ্যে হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তখন তার নাম ছিলো কল্যাণী রানী ওরফে মীনু। কলকাতায় থাকা অবস্থাতেই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জনৈক মুনাফকে বিয়ে করেন। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ছিল রক্ষণশীলতার যুগ। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে তখন পর্দাঘেরা ঘোড়াগাড়ি ও রিকশায় নারীরা চলাফেরা করতেন। এই রক্ষণশীলতার মধ্যেও মমতাজ বেগম শহরের নারীদের, বিশেষ করে ছাত্রীদের আন্দোলনে শরীক করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এতে নারায়ণগঞ্জ মহাকুমা প্রশাসন তার উপর ক্ষিপ্ত হয়। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে তার সুন্দর সাজানো সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। জীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ, অনিশ্চয়তা। তা সত্ত্বেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ, অকুতোভয়, আপসহীন এই ত্যাগী নারী আন্দোলনের মাঠ থেকে এক চুল সরে দাঁড়াননি, নিজেকে বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। ১৯৬৭ সালের ৩০ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র: বায়ান্নর ৫২ নারী, সুপা সাদিয়া