আসমা জাহাঙ্গীর: নারী অধিকার ও গণতন্ত্রের অন্যন্য যোদ্ধা
প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০০:০৪
আসমা জিলানী জাহাঙ্গীর পাকিস্তানের একজন বিশিষ্ট মানবাধিকার আইনজীবী। পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও তিনি। পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। মূলতঃ পাকিস্তানে আইনজীবীদের ঐতিহাসিক আন্দোলনে তার ভূমিকার জন্য তিনি অধিক পরিচিত।
জন্ম ও শৈশব
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি লাহোরে এক সমৃদ্ধশালী, রাজনীতি সক্রিয় এবং মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার পরিবারে আসমা জাহাঙ্গীরের জন্ম। বাবা মালিক গুলাম জিলানী সরকারী চাকুরীজীবি ছিলেন। অবসর শেষে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন ও বেশ কয়েক বছর কারাভোগ করেন। এছাড়াও, সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ করায় গৃহে অন্তরীণ ছিলেন ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করায় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন।
মা সহ-শিক্ষানুক্রমিক মহাবিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন ও স্বল্পসংখ্যক মুসলিম নারী হিসেবে উচ্চতর শিক্ষালাভে সক্ষমতা দেখিয়েছেন। এছাড়াও তিনি প্রাচীন ধ্যান-ধারণার বিপক্ষে লড়াই করেন। স্বামীর কারাভোগের ফলে ১৯৬৭ সালে নিজস্ব কাপড়ের ব্যবসা পরিচালনা করেন।
শিক্ষাজীবন
আসমা লাহোরের কিন্নাইর্দ কলেজ থেকে স্নাতক ও ১৯৭৮ সালে আইনে স্নাতকধারী হন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রী পান। এছাড়াও, সুইজারল্যান্ডের সেন্ট গালেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রীসহ কানাডার কুইন্স ও কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী লাভ করেন।
কর্ম ও সংগ্রাম জীবন
পাকিস্তানে নারী অধিকার, সংখ্যালঘু ও শিশুদের ধর্মীয় অধিকার তথা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে আসমা জাহাঙ্গীর তার দীর্ঘ কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। তিনি হুদুদ অধ্যাদেশ ও পাকিস্তানে ইসলামীকরণের বিষয়ের অংশ হিসেবে জেনারেল মুহাম্মদ জিয়া-উল-হকের ব্লাসফেমি আইনের কড়া সমালোচক ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনেরও একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং পরবর্তীতে ঐ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮০ সালে তিনি তার বোন হিনা জিলানি ও অন্যান্য আইনজীবীদের সাথে নিয়ে পাকিস্তানের প্রথম নারীদের আইন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সে বছরেই তিনি ওইম্যান অ্যাকশন ফোরাম (WAF) প্রতিষ্ঠা করেন যা কিনা পাকিস্তানের সাক্ষ্য আইন [একজন নারীর সাক্ষী সমান দু'জন পুরুষের সাক্ষী] এবং হুদুদ অর্ডিন্যান্স- যেখানে ধর্ষণের শিকার নারী নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে না পারলে শাস্তিভোগ করতে হতো; তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে।
১৯৮৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের পাঞ্জাবে নারী আইনজীবী সংস্থা এই সাক্ষ্য আইনের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ এর আয়োজন করে। আসমা জাহাঙ্গীর এর নেতৃত্বে ছিলেন। এই সমাবেশে আসমা জাহাঙ্গীর ও তার সংস্থা (WAF) এর সদস্যরা পুলিশি নির্যাতন ও গ্রেপ্তার এর শিকার হন।
একই বছর সাফিয়া বিবি নামে ১৫ বছরের এক অন্ধ কিশোরী পাকিস্তানে তার কর্মক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হন এবং এর ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়েন। কিন্তু প্রমাণের অভাবে সাফিয়াকেই 'জেনা'র অভিযোগে দোররা মারা হয় এবং জরিমানা সহ ৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এই ঘটনার পর আসমা জাহাঙ্গীর ও তার সংস্থার নারীরা প্রথমবারের মতো এককভাবে রাস্তায় প্রতিবাদে নামেন। আসমা জাহাঙ্গীর সাফিয়ার হয়ে আপিল করলেও নানা চাপে তা খারিজ হয়ে যায়।
সামরিক শাসক জিয়াউল হকের আমলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে গিয়ে ১৯৮৩ সালে তিনি কারাবন্দি হন।
১৯৮৬ সালে আসমা জাহাঙ্গীর তার বোনকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানে প্রথম একটি বিনামূল্যে আইন সেবা কেন্দ্র খুলেন। এখানে একইসাথে নির্যাতিত নারীদের জন্য 'দস্তক' নামে একটি আশ্রকেন্দ্রও খোলা হয়। আসমা জাহাঙ্গীর পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের জন্যও কাজ করেন এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তর এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।
১৯৯৬ সালে লাহোর কোর্ট পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মুসলিম নারীরা বিয়ে করতে পারবেন না এই মর্মে আদেশ জারি করলে অনেক নারী যারা নিজেরা জীবনসঙ্গীকে পছন্দ করেছিলেন তাদের বিয়ে বাতিলের জন্য চাপ সৃষ্টি হয়। এসময় আসমা জাহাঙ্গীর তাদের পক্ষে আইনী লড়াই লড়েন।
১৯৯৮ থে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত এবং ২০০৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কীয় জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে তিনি কাজ করেন।
২০০৭ সালে পাকিস্তানে আইনজীবীদের ঐতিহাসিক আন্দোলেন আসমা জাহাঙ্গীরের সক্রিয় ভূমিকার কারণে তাকে গৃহবন্দী করা হয়।
২৭ অক্টোবর, ২০১০ তারিখে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম নারী সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি।
২০১৭ সালের আগস্টে তিনি সাঈদ জামান খান বনাম পাকিস্তান ফেডারেশন এর আদালতে সামরিক ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড দেয়া অনেক আসামীর পরিবারকে উপস্থাপন করে পুনর্বিচারের দাবী জানান। কিন্তু আদালত সামরিক আদালতের বিচারকেই সমর্থন জানায়।
তিনি সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক নওয়াজ শরীফকে অভিশংসিত করার বিপক্ষেও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে সংঘটিত বর্বরতার জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ক্ষমা চাওয়ানোর দাবিতে সোচ্চার ছিলেন আসমা জাহাঙ্গীর।
বাংলাদেশে দুই যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর নিয়ে পাকিস্তান সরকারের ‘দ্বৈতনীতির’ সমালোচনা করায় অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাকিস্তানিদের রোষের মুখেও পড়েছিলেন তিনি।
লেখালেখি
অসংখ্য প্রকাশনার পাশাপাশি আসমা জাহাঙ্গীর দুটি বই রচনা করেছেন: ‘দ্য হাদুদ অর্ডিন্যান্স: এ ডিভাইন স্যাঙ্কশন’ (১৯৮৮,২০০৩) এবং ‘চিলড্রেন অব এ লেজার গড’ (১৯৯২)
পুরস্কার ও সম্মাননা
আসমা জাহাঙ্গীর বেশকিছু পুরস্কার লাভ করেছেন। তন্মধ্যে, ২০১৪ সালে রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড, ২০১০ সালে ফ্রিডম পুরস্কার, হিলাল-ই-ইমতিয়াজ, সিতারা-ই-ইমতিয়াজ, রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে মার্টিন এনালস ও ইউনেস্কো/বিলবাও পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও, ফ্রান্স থেকে অফিসার ডি লা লিজিও ডি’অনার পুরস্কার পেয়েছেন। ১০০০ উইম্যান ফর পিস পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ২০০৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়। তিনি ২০১০ সালে ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড ও ২০১৪ সালে রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড পান।
মৃত্যু
২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ৬৬ বছর বয়সে আসমা জাহাঙ্গীর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লাহোরে মৃত্যুবরণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত ও এক সন্তান এবং দুই কন্যার জননী। তার কন্যা মুনিজাই জাহাঙ্গীর সাংবাদিক ও সুলেমা জাহাঙ্গীর আইনজীবী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।