সুপ্রিয়া দেবী: বাংলার রূপালি পর্দায় ব্রহ্মদেশের বেণু

প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০১৮, ০১:৫২

বাংলা চলচ্চিত্রের দিকপাল এক অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবী, চলচ্চিত্রে পদচারণা ৫০ এরও অধিক সময়। বাংলা সিনেমায় মহানায়ক যখন নক্ষত্রের মত চলচ্চিত্র জগতে উজ্জ্বল, তখন তাকে ঘিরে যে নায়িকা বলয় তার প্রথম দুই নাম অবশ্যই সুচিত্রা সেন এবং সুপ্রিয়া দেবী। পাশাপাশি আসবে মাধবী মুখোপাধ্যায় এবং সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের নাম। তবে শুধু নায়ক হিসেবে পর্দায় নয়, ব্যক্তি উত্তমকেও যিনি কাছ থেকে পেয়েছিলেন তিনি সুপ্রিয়া দেবী। 

জন্ম ও শৈশব
ব্রহ্মদেশ তথা বর্তমান মিয়ানমারের সুন্দর-দুর্গম এলাকা কাচিন প্রদেশ৷ সেখানের রাজধানী মিয়িৎকিনা শহরে ৮ জানুয়ারি ১৯৩৫ সালে জন্ম নেন এক ব্রহ্মকন্যা। আসল নাম কৃষ্ণা এবং ডাকনাম বেনু। পর্দায় যিনি সুপ্রিয়া দেবী। পিতা গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় একজন বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংস্কৃতিবান। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা যখন চারদিকে, তখনই ব্রহ্মদেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন সুপ্রিয়া দেবী। নাচ খুব পছন্দ করতেন তিনি, পুরস্কৃতও হয়েছিলেন। কলকাতায় আসার পর গুরু মুরুথাপ্পান এবং পরবর্তীতে গুরু প্রহলাদ দাসের কাছে নাচের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। 

কর্মজীবন
অভিনয় শুরু হয়েছিল নাটক দিয়ে। বাবার নির্দেশনায় মাত্র সাত বছর বয়সে দুটি নাটকে কাজ করে অভিনয়ের জগতে পা রাখেন তিনি। প্রথম চলচ্চিত্র নীরেন লাহিরী পরিচালিত ‘নাগপাশ’, প্রথম নায়ক অসিতবরণ। সেই চলচ্চিত্রে দেয়া তার প্রথম ডায়লগ ছিল ‘দাদা, ইনিই সে দিন আমাকে গুন্ডার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।’ 

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিয়া দেবী এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন,‘কত অসংখ্য ডায়ালগ আমাকে দিয়ে বলানো হয়েছে। কিন্তু ওটার চেয়ে প্রিয় ডায়ালগ আমার খুব কমই আছে।’ যদিও চলচ্চিত্রটি শেষপর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।  

১৯৫২ সালে নির্মল দে’র পরিচালনায় সুপ্রিয়া দেবীর প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, নাম ‘বসু পরিবার’। চলচ্চিত্রে চরিত্রটির নাম ছিল সুজাতা, আর ভাই হিসেবে ছিলেন উত্তমকুমার। এ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে পরিচিতি পান তিনি। এ চলচ্চিত্রেই সর্বপ্রথম তার নাম পরিবর্তন করে সুপ্রিয়া দেবী রাখা হয়। ১৯৫৯ সালে উত্তমকুমারের বিপরীতে ‘সোনার হরিণ’ তাকে তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তারপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’ চলচ্চিত্রে ‘দাদা আমি বাঁচতে চাই’- এই আকুতি সুপ্রিয়া দেবীর অভিনয় দক্ষতায় এক অনন্য মাত্রা যোগ করে। এছাড়া তিনি সোনার হরিণ, শুন বরনারী, উত্তরায়ন, সূর্য্যশিখা, সবরমতী, মন নিয়ে, শেষ ঠিকানা, দেবদাস, কাল তুমি আলেয়াসহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করেন। আপ কি পরিছাঁইয়া, দূর গগন কি ছাঁও মে, বেগানা, লাল পাথর নামে হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন তিনি।

পারিবারিক জীবন
১৯৫৪ সালে সুপ্রিয়া দেবী বিশ্বনাথ চৌধুরীকে বিয়ে করেন এবং পরবর্তীতে তাদের একমাত্র কন্যা সোমা জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু এই দাম্পত্য জীবন বেশিদিন টিকেনি। দীর্ঘ ১৭ বছর তিনি এবং উত্তম কুমার একসাথে বসবাস করেন। উত্তম কুমারের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার পাশে ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী।

মৃত্যু
২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি, ভারতের ৬৯ তম প্রজাতন্ত্র দিবসের ভোরে নিজ বাসভবনে ৮৩ বছর বয়সে মারা যান বাংলা চলচ্চিত্রের অত্যন্ত বর্ণময় এক চরিত্র, সুপ্রিয়া দেবী। তিনি দীর্ঘদিন যাবত বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। তার মৃত্যুতে টালিগঞ্জে শোকের ছায়া নেমে আসে। 

পশ্চিমবঙ্গের নন্দিত এই অভিনেত্রী সুপ্রিয়া চৌধুরীর (দেবী) মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। গার্ড অব অনার জানানোর মাধ্যমে সম্পন্ন এই শেষকৃত্যে অংশ নেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্ত্রিসভার সদস্য ও টলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ সুপ্রিয়ার ভক্ত-শুভানুধ্যায়ীরা। 

সুপ্রিয়ার মরদেহ তার বাসভবন থেকে কেওড়াতলা মহাশশ্মানের জন্য মহাপ্রস্থান যোগে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় ৪ কিলোমিটার পথের এ মহাপ্রস্থানে পা মেলান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ রাজ্যের মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, টলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ সাধারণ মানুষ।

সবার প্রিয় সুপ্রিয়া দেবী

সুপ্রিয়া দেবীকে প্রয়াণে প্রতিক্রিয়া জানান তার সহশিল্পীরা। সমসাময়িক অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সুপ্রিয়া দেবীর প্রয়াণে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, দীর্ঘ ৬০ বছরের বন্ধুকে হারালাম। আজ আমার বলার ভাষা নেই।

এ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর লিখেছেন, একটা দিদির মতো মায়া ছিল ওর মধ্যে! উনি শান্তিতে থাকুন। মনটা খারাপ হয়ে গেল আজ!

সুপ্রিয়া দেবী মৃত্যুর খবর পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বাংলার কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুপ্রিয়া চৌধুরির (দেবী) মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। তার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমরা তাকে ভালোবাসার সহিত স্মরণ করবো। তার পরিবার ও বন্ধুদের জন্য সমবেদনা। 

অভিনীত চলচ্চিত্র ও চরিত্র

সুপ্রিয়া দেবী অর্ধশতক ধরে অভিনয় জীবনে যেসব চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো
দ্য নেমসেক (২০০৬) ... আশিমার দাদী
একটী নদীর নাম (২০০২)
শেষ ঠিকানা (২০০০) ... শ্রীরধার দাদী
হানিমুন (১৯৯২)
ইমান কল্যাণ (১৯৮২)
কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (১৯৮১)
মন নিয়ে (১৯৮১)
দেবদাস (১৯৭৯) ... চন্দ্রমুখী
দুই পুরুষ (১৯৭৮) ... বিমলা
সন্ধ্যা রাগ (১৯৭৭)
সন্ন্যাসী রাজা (১৯৭৫)
যদি জানতেম (১৯৭৪) ... সুজাতা
বাঘবন্দী খেলা (১৯৭৫)
বনপলাশীর পদাবলী (১৯৭৩) ... পদ্ম
চিরদিনের (১৯৬৯)
চৌরঙ্গি (১৯৬৮) ... করবী গুহ
তিন অধ্যায় (১৯৬৮)
কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬) ... ডাঃ লাবণ্য সরকার
শুধু একটি বছর (১৯৬৬)
আপ কি পরিছাঁইয়া (১৯৬৪) ... আশা
দূর গগন কি ছাঁও মে (১৯৬৪) ... মীরা
লাল পাত্থর (১৯৬৪)
বেগানা (১৯৬৩)
সূর্য শিখা (১৯৬৩)
কোমল গান্ধার (১৯৬১) ... আনস্যু
মধ্য রাতের তারা (১৯৬১)
মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০) ... নীতা
নতুন ফসল (১৯৬০)
শুন বর নারী (১৯৬০)
বসু পরিবার (১৯৫২) ... সুখেনের বোন।

পুরস্কার ও সম্মাননা

দক্ষ অভিনয়, অনবদ্য কৌশল এবং তার মুন্সিয়ানার জন্য অসংখ্য পদক আর সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি।  তিনি ২০১১ সালে বঙ্গভূষণ পুরস্কার অর্জন করেন, যা পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ অসামরিক উপাধী। ২০১৪ সালে বাংলা চলচ্চিত্রে তার অবদানের জন্য ভারত সরকার সুপ্রিয়া দেবীকে, ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার “পদ্মশ্রী” তে ভূষিত করেন।

তথ্যসূত্র

১। "50 years of Supriya Devi"
২। "Biography for Supriya Choudhury"
৩। আনন্দবাজার পত্রিকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত