'মাথায় পচন নাই, শরীরের ঘা-টা আমরা শেষ করতে পারব'
প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০১৭, ০০:২২
বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’এর অনুসন্ধান অনুযায়ী বিশ্বের তৃতীয় সৎ নেতা হওয়ার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমি মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে, জীবনকে বাজি রেখে বাংলার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। আমি টাকা-পয়সা আছে কিনা তা কখনও চিন্তাও করি না। ওটা নিয়ে আমার কোনো দুশ্চিন্তা নাই। এমন দিনও যায় যেদিন সাড়ে তিন ঘন্টার বেশি ঘুমাতেও পারি না।’
২২ নভেম্বর (বুধবার) জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম সম্পূরক প্রশ্নে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে একথা বলেন তিনি।
এর আগে ফখরুল ইমাম তার প্রশ্নে ওই প্রতিষ্ঠানের গবেষণার বিস্তারিত তুলে ধরেন।
এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কি পেলাম, কি পেলাম না, সেই হিসাব মিলাতে আমি আসিনি। সেই হিসাবটাও আমার নাই। আমার একটাই হিসাব এই বাংলাদেশের মানুষ তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের কতটুকু কাজ করতে পারলাম সেটাই আামার কাছে বড়।’
তিনি বলেন, ‘আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই যাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে তাদের দেশে জনসংখ্যা কত? আর আমার দেশের জনসংখ্যা কত? এটা যদি তারা একটু তুলনা করতেন তাহলে হয়তো অন্য হিসাব আসতো।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের এই ছোট্ট ভূখণ্ডে ৫৪ হাজার বর্গ মাইলের মধ্যে ১৬ কোটির ওপর মানুষ বসবাস করে। আমাদের দেশের পরিবেশটা তো আলাদা। ১ নম্বর ২ নম্বর বা ৪ নম্বরে যারা আছেন তাদের বাবা-মা, ভাই-বোন হারাতে হয়নি বা নির্যাতিতও হতে হয়নি। জেলে যেতে হয়নি। মিথ্যা মামলার মুখোমুখি হতে হয়নি। এমনকি বার বার মৃত্যুর মুখে দাঁড়াতে হয়নি। এখানে একজনকেও কিন্তু আমার মতো গ্রেনেড হামলার শিকার হতে হয়নি। আমার জীবনের ওপর বার বার হামলা এসেছে। এরকম যদি এদের ওপর একবারও হতো তাহলে অনেকেই ঘরে বসে থাকতো।’
তিনি বলেন, ‘আল্লাহ জীবন দিয়েছেন, জীবন তো চলেই যাবে। আমাদের দেশে যে প্রতিকূলতা, সেই প্রতিকূলতার মধ্যে তাদের যেতে হয়নি। আমাদের দেশে গণতন্ত্র ছিল না। তা ফিরিয়ে এনে দেশ পরিচালনা করতে হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘১২ বা ১৪ ঘন্টার হিসাব নাই। অনেক সময় সাড়ে সাড়ে তিন ঘন্টার বেশি ঘুমাতেও পারি না। যখনই কাজ আসে তখনই কাজ শুরু করতে হয়। এই কাজগুলো করি আমি মনের টানে। কারণ আমার বাবা দেশটাকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। তার একটা স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়বেন। আমার একটাই চ্যালেঞ্জ যে কাজটা আমার বাবা করে যেতে পারেননি সেই কাজটা আমি সম্পন্ন করব।’
ওই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী সরকারের কিছু দুর্নীতির কারণে শেখ হাসিনা পিছিয়ে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে দেশে মিলিটারি ডিক্টেটরশিপ চলে, অবাধ গণতন্ত্রের অভাব থাকে। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অভাব থাকে; সেই দেশে দুর্নীতিটা শিকড় গেড়ে যায়। সেই শিকড় উপড়ে ফেলা কঠিন হয়ে যায়। ৭৫ এর পর থেকে একুশটা বছরই কিন্তু আমাদের দেশে এই অবস্থা বিরাজমান ছিল। এরপর আবার ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত এই অবস্থা। অর্থাৎ আমার লিগেসিটা কী? আমি উত্তরাধিকার সূত্রে কি পেয়েছি? পেয়েছি স্বৈরশাসন, অনিয়ম, অবিচার, অত্যাচার। যার কারণে এই দুর্নামের এখনও ভাগীদার হলাম।’
তিনি বলেন, ‘আমি নিজে সততার সঙ্গে দেশ চালাতে চেষ্টা করছি। আমার স্পিকার একটি কথা মনে রাখবেন মাথায় পচন ধরলে সারা শরীরেই ধরে। যেহেতু মাথায় পচন নাই, শরীরে কোথাও একটু আধটু ঘা-টা থাকে সেগুলো আমরা শেষ করতে পারব।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘ওই রকম যদি দুর্নীতি হতো বাংলাদেশের জিডিপি ৭ দশমিক ২৮ ভাগ হতো না। বড় বড় দুর্নীতি যদি হতো মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ ডলারে উন্নীত হতো না। এত বড় বড় জিনিস অল্প সময়ে তৈরি করা সম্ভব হত না। এই দুর্নীতিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে কিন্তু আমরা পদ্মা সেতু তৈরি করছি।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘ধন-সম্পদ চিরদিন থাকে না। মানুষ মরণশীল। সব রেখে চলে যেতে। তবুও মানুষ অবুঝ। ধন সম্পদের লোভে অস্থির হয়ে পড়ে। এটা মানুষের একটা প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তিটাকে যে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সেই পারে দেশকে দিতে। জনগণকে দিনে। আমরা এখানে দিতে এসেছি। এজন্য জীবন বাজি রেখেছি বাংলাদেশটা যেন স্বাধীন থেকে বিশ্ব দরবারে মাথা উচু করে চলে। এই রিপোর্টে আমার মর্যাদার চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের মর্যাদা উন্নত হয়েছে। এটাই আমার কাছে বড় পাওয়া।’
উল্লেখ্য, বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’ ৫ টি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেতৃত্বের সততার মান বিচার হয়েছে।
প্রথম প্রশ্ন ছিল, সরকার/রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে তিনি কি তার রাষ্ট্রের বাইরে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করেছেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, ক্ষমতায় আসীন হবার পর তার ব্যক্তিগত সম্পদ কতটুকু বেড়েছে?
তৃতীয় প্রশ্ন ছিল, গোপন সম্পদ গড়েছেন কিনা।
চতুর্থ প্রশ্ন ছিল, সরকার/রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ আছে কিনা।
আর পঞ্চম প্রশ্ন ছিল, দেশের জনগণ তার সম্পর্কে কী ভাবেন?
এই ৫ টি প্রশ্নের উত্তর নিয়ে পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স ১৭৩ টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করেছে। এই গবেষণায় সংস্থাটি এরকম মাত্র ১৭ জন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান পেয়েছেন যারা শতকরা ৫০ ভাগ দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
১৭৩ জন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও সৎ সরকার প্রধান হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল। ৫ টি প্রশ্নে মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে তিনি পেয়েছেন ৯০। ৮৮ নম্বর পেয়ে সৎ সরকার প্রধানদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থান পেয়েছেন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লং। ৮৭ নম্বর পেয়ে এই তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছেন বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮৫ নম্বর পেয়ে বিশ্বে চতুর্থ সৎ সরকার প্রধান বিবেচিত হয়েছেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইরনা সোলাবার্গ। আর ৮১ নম্বর পেয়ে এই তালিকায় পঞ্চম স্থানে আছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি।
পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্সের গবেষণায় দেখা গেছে, শেখ হাসিনার বাংলাদেশের বাইরে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। সংস্থাটি গবেষণায় দেখেছে, বেতন ছাড়া শেখ হাসিনার সম্পদের স্থিতিতে কোনো সংযুক্তি নেই। শেখ হাসিনার কোনো গোপন সম্পদ নেই বলে নিশ্চিত হয়েছে পিপলস অ্যন্ড পলিটিক্স। তাদের জরিপ বলছে, বাংলাদেশের ৭৮ ভাগ মানুষ মনে করেন শেখ হাসিনা সৎ এবং ব্যক্তিগত লোভ লালসার উর্ধ্বে। তবে, তার সরকারের বিরুদ্ধে কিছু দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে বলে সংস্থাটির গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।