নারী বনাম পুরুষ : প্রসঙ্গ যৌনতা এবং ভালোবাসা

প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২২:০২

একবার এক বন্ধু জানতে চেয়েছিল, “পুরুষের মত সুযোগ সুবিধা যদি নারী পেতো, তাহলে কি তারা ব্রোথেল বা অন্য কোনো উপায়ে যৌন চাহিদা মেটাতো?” হ্যাঁ। তারাও মেটাতো। কেননা, অন্য আট দশটি চাহিদার মত যৌনতাও একটি। মৌলিক চাহিদাও বলা যেতে পারে। এটি একটি ক্ষুধা। অথবা তৃষ্ণাও বলা যেতে পারে। আমরা যেমন খিদে পেলে ভাত, রুটি ইত্যাদি খাই। তৃষ্ণা পেলে চা, পানি পান করি। যৌনতাও তেমন। এরও ক্ষুধা আছে, আছে তৃষ্ণাও। তৃষ্ণা বা ক্ষুধা যদি মানুষ যেকোনো উপায়ে নিবারণ করে, একই ভাবে যৌন খিদে বা তৃষ্ণা কেন নিবারণ করবে না?  

তবে, ব্রোথেল বা অন্য কোনো উপায়ে যৌন চাহিদা মেটানোর সুযোগ নারীদের থাকলে, তা অবিবাহিত নারীর তুলনায় বিবাহিত নারীরাই সুযোগটা গ্রহণ করতো বেশি। কেননা, আমাদের বাঙালি সমাজে শতকরা ৮০ ভাগ (ধারণা) নারীই স্বামী দ্বারা তৃপ্ত নন। অর্থাৎ নারী অপেক্ষায় পুরুষ দুর্বল। অনেক নারী আছেন, বছরের পর বছর অতৃপ্ত থেকেও মুখ বুজে সংসার করে যাচ্ছেন। স্বামীর যৌন বাসনা বিরক্ত, যন্ত্রণাদায়ক হলেও, বাধ্য হয়ে বিছানায় যাচ্ছেন, শুতে হচ্ছে। লোকলজ্জার ভয়ে টু শব্দটিও করছেন না। ব্যতিক্রমও কেউ কেউ হয়তো আছে।

অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে যৌনকার্যে নারীর কাছ থেকে একজন পুরুষ ঠিকই ষোলআনা বুঝে নেন, তৃপ্ত হন। কিন্তু তৃপ্ত হওয়া এই পুরুষটিই একটিবারের জন্যও ভেবে দেখে না, তার সঙ্গীটি তৃপ্ত হল কিনা! যা স্বার্থপরতার চরম সীমানা। সব থেকে বড় কথা হচ্ছে নারীকে যুগ যুগ ধরে অজ্ঞতার অন্ধকারে রাখা হয়েছে। যৌনতা কি, কিভাবে এর স্বাদ নিতে হয়? জানতে দেয়া হয় নি। যার কারণে বাঙালি সমাজে অধিকাংশ নারীরই জানেন না ‘অরগাজম’ কি? তবে, কালেভদ্রে কোনো নারী অরগাজম পেলেও তা কিন্তু নিয়মিত নয়; এমন সংখ্যা অজস্র।

তবে পুরুষের মত সুযোগ সুবিধা নারী পেলেও ব্রোথেল বা অন্য কোনো উপায়ে যৌন চাহিদা বহুল সংখ্যক নারী সেভাবে মেটাতো না। কারণ, তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যৌনতার স্বাদ পেতেই হবে (?) এমন মনোভাব সম্পন্ন নারীর সংখ্যা খুবই কম। তারা যৌনতার জন্য কাতর হয়ে থাকা পুরুষের মত না। তাদের যৌন চাহিদা আছে ঠিকই, তাই বলে যার তার সাথে! ভালোবাসাহীন পৌরুষ স্পর্শও নারী কামনা করে না। ব্রোথেল কিংবা অন্যত্র যৌন চাহিদা হয়তো মেটানো যাবে, কিন্তু সেখানে কি ভালোবাসা মিলবে? নারী প্রথমত ভালোবাসা চায়। ভালোবাসার মধ্য দিয়েই যৌনসুখ কামনা করে, অন্যত্র নয়।

অথচ পুরুষের ক্ষেত্রে আমরা কি দেখি? নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা পুরুষের সংখ্যা একদমই তলানিতে। যার কারণে তারা, ঘর এবং বাইরে, দু’দিকেই যৌন চাহিদা মেটাতে উদগ্রিব থাকে। সুযোগ পেলে নারী দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেও দু’বার ভাবে না। আবার স্বভাবেও অনেক পুরুষ লালায়িত হয়ে থাকে। অনেকটা ভাদ্র মাসের কুকুর এর ন্যায়। আর ভাদ্রমাসি কুকুরের ন্যায় যে পুরুষগুলা, মূলত তারাই ধর্ষণকাণ্ড ঘটায়, অবলিলায়।

বীর্যবান, বলবান পুরুষ, তাদের এক নারীতে পোষায় না, এক নারী তৃপ্ত করতে পারে না, বছরের পর বছর তারা অতৃপ্ত থাকে, যার জন্য ঘরে স্ত্রী রেখে বাধ্য হয়েই ব্রোথেল বা অন্যত্র যৌনকার্যে লিপ্ত হয়! এমন ভাবনা যদি কেউ ভেবে থাকেন, তবে ভুল। এটা স্বভাব দোষ। চোখের নেশা। মনের নেশা। নতুন গন্ধের নেশা। নতুন শরীর পাওয়ার নেশা। তবে ব্যতিক্রমও আছে।

যৌনতা দোষনীয় বা নিন্দনীয় নয়। এই চাহিদা সবারই রয়েছে। মেটানোর উপায়ও আছে। কথায় আছে, যে জিনিসের চাহিদা আছে, সে চাহিদা পূরণেরও ব্যবস্থা থাকে। একমাত্র নারীর ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়। ভাবটা অনেকটা এমন, নারীর যৌন ইচ্ছে থাকতে নেই, উচিতও নয়! যৌন চাহিদা একমাত্র পুরুষেরই থাকবে। যখন ইচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছে তারাই এই চাহিদা মেটাবে! নারী কেবল জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে যাবে! পুরুষতন্ত্র এমন বিধানই বেঁধে দিয়েছে নারীকে। যার জন্য একজন নারীকে শৈশবে পিতা, ভাই, পরিণত বয়সে প্রেমিক, স্বামী, বৃদ্ধ বয়েসে এসে পুত্রর নিয়ন্ত্রণে থাকতে হচ্ছে। নিজের ইচ্ছে, অনিচ্ছের কোনো মূল্যই নেই। মূল্যায়িতও করা হচ্ছে না তাদের চাওয়াটাকে। ভেবে দেখা হচ্ছে না, তারা কি চায়। কোথায় তাদের অপূর্ণতা?

একপেশি সমাজ ব্যবস্থার জন্য ঘরে-বাইরে, সর্বত্রই নারীকে কোণঠাসা করে রাখার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে কখনোই মানুষ ভাবে না। সমাজের দৃষ্টিতে নারী যৌন সম্ভোগের বস্তু, সন্তান উৎপাদন যন্ত্র, সেবাদাসী, রান্নাবাটি নিয়েই তার কাজ। বিনিময়ে তিন বেলা খাবার, একটু স্নো-পাউডার-আলতা, ব্যাস! এর বাইরে এই সমাজ নারীকে অন্য কোনো দৃষ্টিতে কি কখনো দেখেছে? সমাজ কি বদলেছে তার দৃষ্টিভঙ্গি?

তুখোড় প্রতিবাদি অনেক নারীকেও একটা সময় ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যেতে হয়। মুখ বুজে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। মানিয়ে নিতে হয় নীতি বিরুদ্ধ অনেক কিছুর সাথে। কারণ একটাই, নারী ‘স্বার্থপর’ হতে পারে না। সে এককভাবে তার ভালোটা বুঝে নিতে চায় না। সে ভাবে তাকে ঘিরে থাকা মানুষগুলোর কথা। যার জন্য সমাজের চাপিয়ে দেয়া অনেক কিছুই একটা সময় মুখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য হয়। যা ভালোবাসার প্রতিদান। নিজেকে উৎসর্গ করে সংসার, বাবা-মা, ভাই-বোন, ছেলে-সন্তানের জন্য।

ঠিক একই রকম কাজ পুরুষের ক্ষেত্রে হয় উল্টোটা। সে আগে ভাবে তার কথা। পরে ভাবে তাকে ঘিরে থাকা মানুষের কথা। সর্বপোরি একজন পুরুষ নিজের ভালোটা ছাড়া অন্যের ভালোটা খুবই কম ভাবে। মোদ্দা কথা, একজন পুরুষের কাছে ‘যৌনতা’ অপেক্ষা ‘ভালোবাসা’ নস্যি। কিন্তু নারীর কাছে আগে ভালোবাসা, পরে যৌনতা। নারী আর পুরুষের মধ্যে পার্থক্য বলতে এটুকুই। অন্য কোথাও পার্থক্য দেখি না। এক কথায় পুরুষ ভোগে বিশ্বাসী, নারী ত্যাগে। এ জন্যই নারী কন্যা, জয়া, জননী। তবে, নিজ প্রাপ্যটুকু নারীরও বুঝে নেয়া দরকার। 

লেখক: ব্লগার

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত