সমাজের হুইসেল!

প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০১৬, ১৮:০৬

ঘটনাটা আমার নিজ চোখে দেখা এবং খুব বেশি হলে দিন পনেরো আগের ঘটনা। গুলশান দুই নম্বরের পার্কে গিয়েছিলাম। হাঁটতে। দুপুরের পরপর। চারদিক সবুজ হয়ে আছে। শেষ শরতে চারদিক সবুজ আর সতেজ। পার্কটা খুব সুন্দর। গুলশান সোসাইটির অর্থায়নে করা। জগিং এর জায়গা, বাঁধানো রাস্তা, লেক, লেকের উপর ছোট্ট একটা ব্রিজ, গাছের ফাঁকে ফাঁকে বেঞ্চি পাতা। দুয়েকটা জুটি বসে আছে। বসে আছে কিন্তু খুব দুরত্ব রেখে। একটা জুটিকে দেখলাম একটু ঘন হয়ে বসেছে, কি জানি হয়তো দুয়েকটা চকিত চুমু খেয়েছে কি না রীতিমতো গগনবিদারী হুইসেলের শব্দে ওরা তো বটেই আমি শুদ্ধ কেঁপে উঠলাম। কি হয়েছে? না গার্ড খুব কড়া ভাষায় বলল, ফাঁকা হয়ে বসেন, দূরে সরে বসেন। প্রেমিক যুগল দ্রুত সরে বসল। ফেরার সময় দেখলাম, পার্কে অবস্থানের নিয়মাবলী। তার মধ্যে দুটি খুবই কৌতুহল উদ্দীপক। একটি, দৃষ্টিকটু পোশাক পড়া যাবে না এবং সমাজবিরোধী আচরন এবং দৃষ্টিকটু কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়া যাবে না।
 
অসামাজিক কার্যকলাপ কি? কাউকে প্রশ্ন করার মতো পেলাম না। ভাবছি, গুলশান সোসাইটির কারো ফোন নম্বর খুঁজে আমি ফোন করে জানতে চাইবো অসামাজিক কার্যকলাপ কি? অসামাজিক কার্যকলাপ কি প্রেমিক-প্রেমিকার চুমু খাওয়া? অসামাজিক কার্যকলাপ কি নারী-পুরুষ হাত ধরাধরি করে হাঁটা? আর দৃষ্টিকটু পোশাক-আশাক কি? শালীন পোশাক কোনটা? লম্বা হাতা কামিজ কি শালীন পোষাক আর গেঞ্জি বা হাতকাটা কিছু পড়া কি অশালীন? আপনি বলতেই পারেন, এই নির্দেশনা শুধুই নারীর জন্য তা তো বলা নাই। ঠিক। তা বলা নাই। হাফপ্যান্ট পড়া কয়েকজন পুরুষকে দেখলাম অশালীন কিছু মনে হলো না। আমার ধারনা হাফপ্যান্ট পরা কোন নারী যদি পার্কে ঢুকতেন নিশ্চিত তাকে হুইসেলের ঝারি খেতে হতো।
 
সারাদেশ পাঁচবছরের শিশুটির জন্য কষ্ট পাচ্ছে। দেশের অনেক পুরুষ যে পিডোফাইল সেটা এখন জানা যাচ্ছে। ব্র্রেকিং দ্যা সাইলেন্সে কথা বলে জানলাম, আমরা অনেককিছুই নতুন জানছি। পিডোফাইল পুরুষের অভাব কোনদিনই ছিল না এদেশে। বলা হতো না। প্রথম যখন এ বিষয়ে কাজ করা হতো, তখন নাকি স্কুলগুলো থেকে বলা হতো এসব পশ্চিমা দেশগুলোর সমস্যা, আমাদের না। তারপর অভিযোগ বক্স লাগানোর পর সেটা ভরে উঠতে লাগলো। যৌনতাকে সবসময় ট্যাবু করে রাখলে, যৌন সম্পর্কর মধ্যে অন্যায় এবং অনৈতিকতা সবসময় দেখতে পেলে, প্রেমিক-প্রেমিকা চুমু খেলে যদি হুইসেলের সাবধানবানী শুনতে হয় তবে সেদেশে বা সমাজে হাজার হাজার পিডোফাইল বের হবে, শিশুরা নির্যাতনের শিকার হবে এটা কি খুব অস্বাভাবিক? সঠিক যৌনশিক্ষা এদেশে কন্যাশিশু ছেলেশিশু কাউকেই কি দেওয়া হয়?

আবার দেখেন সাইফুল্লা যে পিডোফাইল তাও না। মনোরোগ চিকিৎসক এর সাথে কথা বলে জানলাম, সাধারণত এ ধরনের রোগীদের বউ-বাচ্চা বা যৌনসঙ্গী থাকে না। সাইফুল্লার এই সবই আছে। আমরা যে বারবার বলি, ধর্ষণ শুধুই যৌন ইচ্ছা মেটানো নয়, এইটা অনেকটা সামাজিক। এই সত্য অস্বীকার করেন অনেক পুরুষ। সেদিনই একজন লিখেছেন, এটা বিকৃতি আর বিকৃত নারীও অনেক আছেন। আমি যতই বলি দুচারটা উদাহরন দেন যে, ধর্ষণ করতে না পেরে কোন নারী ছেলে শিশুর পুরষাঙ্গ কেটে ফেলেছে, ধর্ষণ করে কোন নারী ছেলেশিশুকে হলুদ ক্ষেতে, পাটক্ষেতে বা যাবতীয় ক্ষেতখামারে ফেলে রেখেছে, চলন্ত বাস বা গাড়িতে রেপ করেছে, আটকে রেখে রেপ করে হাত কেটে ফেলেছে তলোয়ার দিয়ে-একটা দুটো উদাহরণ দেন। ভদ্রলোক বিকৃতি যে নারীর ভেতর আছে তার বিশাল গবেষণাপত্র হাজির করলেন। উন্নত দেশের উন্নত গবেষণাপত্র। বিষয়টা যে সামাজিক, গায়ের জোরের, পুরুষতন্ত্রের সেইটা মানতেই রাজী না ভদ্রলোক। আর এইটাই হলো দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের গুলশান সোসাইটির পার্কে লেখা থাকে, শালীন পোশাক পড়ার কথা, আমরা পাঁচ বছরের শিশু ধর্ষিতা হলে, সঙ্গে সঙ্গে নারীও ধর্ষণ করতে পারে এই তত্ত্ব হাজির করে ফেলি। ক্ষতিগ্রস্থ আর নির্যাতিত হওয়াটা কি করে রোধ করা যায় তা ভাবি না। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিই কিন্তু অনেক অপরাধের উস্কানিদাতা। গুলশান সোসাইটির কর্ণধার, ওই ভদ্রলোক আর সাইফুল আসলে দেখেন একই সুতোয় গাঁথা। এখানে স্বাভাবিক যৌনসম্পর্ক থাকতে পারবে না, অস্বাভাবিকতা চলবে এবং অস্বাভাবিক যা কিছু ঘটবে তাকে খণ্ডন করার জন্য একটা তত্ত্ব বের করা হবে।
 
আমাদের সমাজে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য অবদমন বাড়ছে। আর এই অবদমনকে পিঠ চাপড়ানি দেয় গুলশান সোসাইটির মতন নানান ধরনের সোসাইটি। ওদিকে শিশু ধর্ষক, নারী ধর্ষক আর নানান কিসিমের নিপীড়ক বের হয়। অন্তত: আমাদের সমাজে তাই। উন্নত বিশ্বের দেশে এরকম বহু ঘটনার উদাহরণ দেয়া যায়, যেখানে সঠিক যৌনশিক্ষা আছে, তবু সৎ বাবার দ্বারা কন্যা আর মেয়ের বয়ফ্রেন্ডের কাছে নারীকে ধর্ষিতা হতে হয়। এখন সঠিক যৌনশিক্ষা থাকার পরেই যখন এই অবস্থা তখন যেখানে এসবের বালাই নেই সেখানে কি হবে?

রেইপ করার আগে সাইফুল্লার মনে তাই কোন হুইসেল বাজে না। কিন্তু শিক্ষিত প্রেমিকজুটিকে হু্ইসেল খেতে হয় যারা রেপ এর মতো কোন অপরাধ করতে যায়নি পার্কে, এবং এরকম অবদমিত সমাজ নিয়ে আমরা যতই এগুতে চাই ততই আমাদের শিশুরা ক্ষতবিক্ষত যোনী নিয়ে পড়ে থাকবে হলুদক্ষেতে এইটাই হয়তো বাস্তবতা।

লেখক: সাংবাদিক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত