ধর্ষণ সাংবাদিকতা: নৈতিক ও আইনি কাঠগড়া প্রশ্নে
প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০১৬, ১৬:০৩
উত্তরবঙ্গের পার্বতীপুর বার কয়েক গিয়েছি আমি, ঘুরে বেড়িয়ে সেখানকার বিস্তীর্ণ সবুজ দেখেছি। কিন্তু হঠাৎ সেই সবুজে পড়ে থাকে মৃতপ্রায় কোনো এক শিশু! বাঁচার জন্য ছটফট করে। ঢাকায় বসে পত্রিকার পাতা যেন ভয়ার্ত অসহায় চিৎকারে ফেটে পড়ছে। মানসিকভাবে ভীষণ চাপ অনুভব করতে করতে আমিও অন্য সকলের মতো আবেগ তাড়িত হয়ে একটি ফেসবুক শেয়ার দিয়ে দিলাম। ব্যাস এটুকুই? নিজের প্রতি এক আত্মজিজ্ঞাসা। সংবাদটি পড়তে গিয়ে মনে হতে লাগলো এই নৃশংস ঘটনার সাথে আরো কিছু নৃশংসতা গভীরভাবে মিশে আছে।
ফের বহুল প্রচলিত পত্রিকাটির পাতা উল্টালাম; সংবাদটির অনলাইন ভার্সন ও পত্রিকাটির সামাজিক মাধ্যমও দেখলাম। শিরোনাম – এ কেমন বর্বরতা। সংবাদটি আরও বার দুয়েক পড়তে গিয়ে আমার মনে হতে লাগলো – আবারো কেনো এমন বর্বরতা, বারবার কেনো এমন বর্বরতা? হ্যাঁ স্বয়ং সংবাদটি বর্বর হয়ে উঠেছে, সাংবাদিক-ফটোসাংবাদিক, বার্তা সম্পাদক, সম্পাদক সকলেই হয়ে উঠেছে বর্বর। শিশুটি যেন একবার ধর্ষিত হয়নি। সংবাদে ব্যবহৃত ছবিতে, সংবাদ বর্ণনায়, শব্দ প্রয়োগে, অনলাইনে কিংবা সামাজিক মাধ্যমে বারবার ধর্ষিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে শিশুটির নাম, গ্রাম, পিতৃ-মাতৃ পরিচয় সব। শুধু কী তাই? শিশুটির ছবি প্রকাশ থেকে শুরু করে শরীরী ক্ষত বিক্ষতের বিবরণ সব কিছু বিস্তারিতভাবেই উপস্থাপন হয়েছে প্রকাশ্যে, নির্বিচারে। এতে কোনো প্রকার সাংবাদিক নৈতিকতার নূন্যতম কিছু অবশিষ্ট ছিল না, বরং সংবাদটি হয়ে উঠেছে গুরুতর অপরাধের আরেক দৃষ্টান্ত।
সাংবাদিকতার অন্যতম প্রধান ভিত্তি হল নৈতিকতার প্রতি আদর্শিক অবস্থান। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকতায় প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাও ওয়াকিবহাল থাকেন। সে হিসেবে একটি বহুল প্রচলিত জাতীয় দৈনিকের সংবাদকর্মী বা সম্পাদক মহলেরা নীতি নৈতিকতা সম্পূর্ণ দায়িত্বশীলতা নিয়ে পালন করবেন এটাই তাদের প্রধান কর্তব্য হবার কথা। তাই নয় কী? কিন্তু প্রকাশিত ঐ ধর্ষণ সংবাদের পরতে পরতে আমরা যা দেখলাম তাতে সংবাদ সংগ্রাহক থেকে শুরু করে সংবাদ সম্পাদক পর্যন্ত প্রত্যেকের বোধহীন নৈতিকতায় জোড়ালো প্রশ্ন ওঠে। এই প্রশ্নটি নৈতিকতা বিবর্জিত গুরুতর অপরাধের সাথে স্বেচ্ছাচার সম্পৃক্ততারই অবস্থান। ধর্ষণের মতো নৃশংস নির্যাতনের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীর ছবি, নাম পরিচয় প্রকাশ করা সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতা বহির্ভূত কাজ। এছাড়াও ঘটনার বিবরণ সমৃদ্ধ এমন সংবাদ পাঠক মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে যার দায় দায়িত্ব সংবাদ মাধ্যমের কর্তাদের উপরই বর্তায়। ঠিক একই সংবাদের আরেকটি প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকে আপডেট দেখে আরও হতাশ হলাম; শিরোনাম ছিল ‘ধর্ষণের শিকার শিশুটির প্রজনন অঙ্গে সংক্রমণ’ (আপডেট: ১৬:৪৯, অক্টোবর ২৬, ২০১৬)। সংবাদের ভেতরের অংশে দেখি শরীরে ছিল কামড়ের দাগ, ঊরুতে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়ার ক্ষত কিংবা শিশুটির প্রজনন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো বিবরণের আপডেট। এই সংবাদের আগের আপডেটেও একইভাবে ঐ শব্দগুলো ব্যবহার হয়েছে (আপডেট: ০১:২৭, অক্টোবর ২৬, ২০১৬) আদতে নৈতিক প্রশ্নে ঐ শব্দগলো বিস্তারিতভাবে প্রকাশ কতটা জরুরী ছিল?
সুস্থ সাংবাদিকতায় আমাদের জবাবদিহিতা কোন পর্যায়ে? তা ভাবতে গিয়েই চোখ পড়ল আরেকটি সংবাদে, সেটি ছিল সম্প্রতি এক সরকারি কর্মকর্তা ইউনিলিভারের বিরুদ্ধে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগ এনেছেন এবং এই অভিযোগের শুনানিতে ইউনিলিভারকে তাদের বিজ্ঞাপনের সত্যতা প্রমাণের নির্দেশ দিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আরেক সংবাদে দেখতে পাই, মডেল নায়লা নাঈমের সাথে ক্রিকেটার সাব্বিরের বিজ্ঞাপনের প্রচার বন্ধ। যেখাবে বিসিবি শর্তেই বলা আছে এমন কোনো বিজ্ঞাপন করা যাবে না যা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিসিবি’র কাছে বিজ্ঞাপনটি আপত্তিকর মনে হওয়ায় এই নির্দেশ। আর সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে বয়ে গেছে হাল্কা, মাঝারি থেকে ভারি ঝড়। এই দুটি প্রসঙ্গ টেনে আনার কারণ হলো জবাবদিহিতার চাওয়ার প্রতি তথাকথিত সচেতন মহলেরা যদি যৌক্তিকভাবে আন্তরিক হন তবে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব।
কিন্তু আমি এই লেখাটি যখন লিখছি ততক্ষণ পর্যন্ত উক্ত ধর্ষণ সংবাদ নিয়ে তেমন কোনো জোড়ালো সমালোচনা চোখে পড়েনি। না সচেতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণী থেকে, না কোনো গণমাধ্যম বোদ্ধা সম্প্রদায়ের কাছ থেকে! অনেকে দেখেছি ফেসবুকে সংবাদটি শেয়ার করে আবেগ উগড়ে দিয়েছেন, কিন্তু পুরো সংবাদজুড়ে যে অনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা দেখেছি বা পড়েছি তা নিয়ে তেমন কেউ বিক্ষুব্ধ হননি। শুধুমাত্র সামাজিক মাধ্যমে ঐ সংবাদপত্রের ফেসবুক পেইজে প্রচারিত সংবাদটিতে একজনের মন্তব্য পাওয়া যায় যেখানে তিনি এমন নৃশংসতার শিকার হওয়া শিশুটির ছবি বাদ দিতে বলেন। কিন্তু এরপরও ছবিটি সরিয়ে নেওয়া হয়নি।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ – এর নারী ও গণমাধ্যম অংশে উল্লেখ আছে তাহল, ‘নারীর প্রতি অবমাননাকর, নেতিবাচক, সনাতনী প্রতিফলন এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধের লক্ষ্যে প্রচারের ব্যবস্থা করা’। নারী উন্নয়নের এই নীতিকে সংবাদ প্রচারে কতটুকু সম্মান দেখানো হয়েছে তা নিয়ে বলার কিছু অবশিষ্ট নেই। কিন্তু আইনের চোখে বিষয়টি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ সনের ৮ নং আইনে সংবাদ মাধ্যমের বাধা নিষেধ এবং অপরাধের শাস্তির বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে নির্যাতিতা নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধা-নিষেধ অংশটি হল – ১৪। (১) এই আইনে বর্ণিত অপরাধের শিকার হইয়াছেন এইরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তত্সম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদ পত্রে বা অন্য কোন সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাইবে যাহাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়।
(২) উপ-ধারা (১) এর বিধান লংঘন করা হইলে উক্ত লংঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকে অনধিক দুই বত্সর কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।
এমন কঠোর আইন থাকা স্বত্ত্বেও সংবাদের বিজ্ঞ পরিচালকেরা নিশ্চয় না বুঝার ভান ধরে অপরাধটি করে ফেলেন। তাই নয় কী? কেননা আমাদের দেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিডিয়া ওয়াচ হয়না। এমন গুরুতর অপরাধ কেউ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না। নৈতিক দায়-দায়িত্বের প্রশ্নে যেন অধিকাংশই তথাকথিত বোদ্ধা শ্রেণী ভাবলেষহীন। এই ভাবলেষহীনতা কী অনেকটা ব্যক্তি-সংবাদ মাধ্যমের প্রতি এবং সংবাদ মাধ্যম সংবাদ মাধ্যমের প্রতি পারস্পরিক সম্প্রীতি কিংবা সৌহার্দের বহিপ্রকাশ নয়?
সম্প্রীতি-সৌহার্দ যাই হোক, যৌক্তিকভাবে সমালোচনা অবশ্যই সুস্থতারই প্রকাশ। সাংবাদিকতায় নীতি নৈতিকতা চর্চাকে অনেকে কমন সেন্সের তকমা লাগিয়ে হাল্কা অবস্থানে নিয়ে যান। বিষয়টি মোটেই হাল্কা কিছু নয়। বরং সাংবাদিকতার নৈতিকতা হল রাষ্ট্র, সমাজ কিংবা জনমানুষের প্রতি সঠিক পথ নির্দেশের আবশ্যিক দায়িত্ব। আমি এই লেখাটির যখন একেবারে শেষ পর্যায় তার আগেই পুলিশ অপরাধীকে ধরে ফেলেছে এমনটাই খবর পেয়েছি। আর এ অপরাধ প্রকাশ করতে গিয়ে যে বা যারা নৈতিকতা বিবর্জিত অপরাধ করেছেন কিংবা সম্পৃক্ত হয়েছেন সেটির সাজা কী আদৌ আমাদের কানে পৌঁছুবে?
লেখক: ভিজ্যুয়াল জার্নালিস্ট, বিবিসি এমএ