নারী শুধুই একটা ভোগের বস্তু!

প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২০:০৮

(১) 
কি জিনিস যে কখন আপনাকে ইমোশনাল করে ফেলবে আগে থেকে সেটা টের পাওয়া যায় না। কয়েকদিন আগে আমার ছোটবোন লিমা এসেছে আমার বাসায়। (লিমার পোশাকি নাম ফারিসা মাহমুদ, আপনারা অনেকেই ওকে চেনেন। হাসন রাজার জীবনের কিছু ঘটনা নিয়ে চমৎকার একটা উপন্যাস লিখেছে- 'চন্দ্রাহত হাসন') এই কথা সেই কথা ঘুরে কথা উঠেছে রিজিয়া রহমান প্রসঙ্গে। লিমা রিজিয়া রহমানের কোন বই পড়েনি, সম্প্রতি রক্তের অক্ষর উপন্যাসটি নাম শুনেছে, আমার কাছে কি রিজিয়া রহমানের রক্তের অক্ষর আছে? এইটুকুতেই ইমোশনাল হয়ে পড়ি- আহারে, সেই কবে ছোট বেলায় রক্তের অক্ষর পড়েছি, প্রথমে বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায়, পরে বই আকারে, সে কি আজকের কথা!

রিজিয়া রহমানের রক্তের অক্ষর বইটা আমার কাছে থাকার কথা। আমি নিশ্চিত বইটা আমার পিতা কিনেছিলেন আর তার মৃত্যুর পর তার বইয়ের একটা বড় অংশ আমার কাছে চলে এসেছে। বিশেষ করে এই বইখানির কথা মনে আছে কারণ এই বইটি যখন আমাদের বাসায় এসেছিল তখন আমার মনে হয়েছিল কি দরকার ছিল এইটা কিনার, এইটা তো আমরা বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায়ই পড়ে ফেলেছি। মুক্তধারা থেকে প্রকাশ করেছিল এই বইটা (যতদূর মনে পড়ে)। খোঁজাখুঁজি করেও বইটা আর পেলাম না বাসায়। বোনকে কথা দিয়েছি বইটা আমি ওর জন্যে জোগাড় করে দিব। আমার সবকিছুতেই একটু দেরি হয়ে যায়, কিন্তু কাজটা ঠিক ঠিকই করি। বই আসছে।

রক্তের অক্ষরের কথা এখন মনে পড়লো কেন সেটা বলি। উপন্যাসটা একটা পতিতালয়ের ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে। সেখানে ইয়াসমিন নামে একটা মেয়ে থাকে। ইয়াসমিন পড়ালেখা করা মেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, বই পড়ে। ওর কাছে গ্রাহকরা খুব বেশী যেতে চায় না। ইয়াসমিন রঙ ঢং জানে না। কাঠের মতো শক্ত হয়ে থাকে, ব্যাটারা ওকে পছন্দ করবে কেন? তাছাড়া ইয়াসমিন আবার মেয়েদের অধিকার নিয়েও মাঝে মাঝে কথা বলতে চায়। ফলাফল হয় যে উপন্যাসের শেষে ইয়াসমিন খুন হয়। খুব হওয়ার সময় ইয়াসমিন একটি বই পড়ছিল। যে গুণ্ডাটা ইয়াসমিনকে খুন করে, সে বইয়ের একটি পাতা ছিঁড়ে নেয় ছুরি থেকে রক্ত মোছার জন্যে। রক্ত মুছে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া বইয়ের পাতাটিতে সেই লাইনটি ছিল, মানুষ জন্ম নেয় স্বাধীন হয়ে বটে, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত।

রুশোর এই কথাটি, man is born free and everywhere he is in chain, এই কথাটি প্রসঙ্গেই বইটির কথা আজ দুপুর থেকে মনে পড়ছে।

(২) 
ডিবিসি টেলিভিশনে মেয়েদের অধিকার, নারীবাদ ইত্যাদি নিয়ে একটা টক শো হয়। গেল শনিবার দিন সকালে সেই শোতে একজন আলোচক, মিতি সাঞ্জানা নামে একজন ব্যারিস্টার, তিনি একটা কথা বলছিলেন শুনতে গিয়ে খট করে আমার কানে লেগে গেল। ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েয় মিতি বলছিলেন, এমনিতে যেখানে যত পার্থক্য বা বৈষম্যই থাকুক না কেন, এই একটি যায়গায় সকল নারীরাই সমভাবে হতভাগা। সেইখানে একজন ব্যারিস্টার মিতি সাঞ্জানা খান আর একজন রূপা প্রামাণিক এর মধ্যে কোন ফারাক নাই।

কথাটা খুবই সত্যি। দুইটা কথাই। সাধারণভাবে সকল মানুষই কোন না কোনোভাবে শৃঙ্খলিত থাকে। আর নারীদের ক্ষেত্রে শৃঙ্খল থাকে দুইটা। একটা তো এমনিই মানুষ হিসাবে সকলের মতো শৃঙ্খল। আরেকটা হচ্ছে নারী হিসাবে পুরুষের পরানো শৃঙ্খল। এবং নারীর পায়ে এই যে পুরুষবাদের শৃঙ্খল এটা কিন্তু সকল নারীর পায়েই আছে। সে নারী যেই হোক না কেন। এমনকি যে নারীটা শ্রেণীগত অবস্থানের দিক দিয়ে বুর্জোয়া বা শোষক শ্রেণীর অংশ, তার পায়ে শ্রেণীগতভাবে শোষণের শিকলটা না থাকলেও লৈঙ্গিক শোষণের শিকলটা ঠিকই আছে। সেখানে একজন পোশাক শ্রমিক আর পোশাক কারখানার নারী মালিক একই সমতলে।

মিতি এই কথাটা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন বলেই ঠিক কথাটি বলেছেন বটে, কিন্তু সকল নারী কি একইভাবে এই শৃঙ্খলটা টের পায়? পাওয়ার তো কথা, পায় ঠিকই, পায়ে যে শিকলটা সেটা তো টের না পাওয়ার কথা না। কিন্তু নারীদের একটা বড় অংশ শিকলটাতে অস্বস্তি বোধ করে না। করে না তার কারণ হচ্ছে ওরা এই দাসত্বে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, দাসেদের মধ্যে উত্তম দাস হওয়াটাকেই ওরা সাফল্য মনে করে- এবং যেহেতু ওরা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর নারীকে পুরুষের দাসী হিসাবেই তৈরি করেছেন, গায়ে ওরা দাসের চিহ্ন বহন করে বেড়াতে একটুও অস্বস্তি বোধ করেন না। কেননা ওদের মনে দাসীর জীবনই ঈশ্বর প্রদত্ত জীবন, দাসত্ব যাপন করাই তাই ইবাদত ইত্যাদি।

আর পুরুষরা? পুরুষরা কি সকলেই জানেন যে নারীর যে লৈঙ্গিক রাজনীতির শিকল, সেটা হচ্ছে মালিকানার শিকল? না, এইরকম রাজনৈতিক ভাষায় সকলে ভাবেন না বটে- কিন্তু এটাই পুরুষের চিন্তা। এই যে আমরা শব্দগুলি ব্যাবহার করি- নানাপ্রকার রাজনৈতিক দার্শনিক টারমিনলজি, এগুলো পুরুষের গভীরে প্রোথিত এইরকম মালিক মালিক ইন্সটিক্টটাকেই শব্দে বর্ণনার চেষ্টা মাত্র।

(৩) 
এবং পুরুষরা যে সকলেই এই ব্যাপারটা জানে, যে নারী হচ্ছে পুরুষের ভোগের বস্তু, এবং এই কথাটা যে মানে সেটা কিন্তু গোপন কিছু না। আপনার আশেপাশে পুরুষদের কথাবার্তা লক্ষ্য করেন, নারী প্রশ্নে ওদের প্রতিক্রিয়া দেখেন, দেখবেন এই যে 'পুরুষ নারীর মালিক' আর 'নারী শেষ বিচারে ভোগের মাল মাত্র' এই কথাগুলিকে ওরা অন্যায় মনে করেন না। হয়তো মিষ্টি করে বলেন, কিন্তু এইই হচ্ছে পুরুষের চোখে নারী ও পুরুষের বৈধ সম্পর্ক।

আমি পদে পদে দেখি, আর এই পঞ্চাশ পার হয়ে যাওয়া জীবনে যে কতবার কতভাবে দেখেছি! কি? না, নারী তো ভোগের বস্তু মাত্র, সেই হিসাবে আসলে নারী আর মেওয়ার মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নাই। মেওয়া বা ফল যেমন- মনে করেন আমাদের আম- কড়া আম, বাত্তি আম, পাকা আম, রসালো আম, পচা আম এইরকম নানারকম হয়, আমরা নারীকেও একইভাবে দেখি। হয়তো আপনি নিজেও এইরকম করেছেন, এইরকম ভেবেছেন- কিশোরী নারীই নাকি সবচেয়ে সুস্বাদু, আর মধ্য কৈশোর- ষোল বছর- তখনই নাকি নারী স্বাদের চূড়ান্তে থাকে।

ষোড়শীর স্বাদ, টেক্সচার এইসব নিয়ে কাব্য ইত্যাদি তো আছেই, এমনিই সাধারণ পুরুষের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন। দেখবেন সকল পুরুষই এই বিষয়ে কথা বলতে গেলে জিভ থেকে সুরুত করে লালা টেনে গিলে ফেলবে কথা বলার আগে। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ মনে মনে। আর নারীকে এই যে ভোগের বস্তু মনে করা, হালুয়া বা রসগোল্লা বা মেওয়া যাই বলেন, এই ব্যাপারে সকল পুরুষই এক- হোক সে শোষক শ্রেণীর শোষিত শ্রেণীর।

এবং এই ব্যাপারটা কি আমি আমার জীবনে নানাভাবে দেখিনি? দেখেছি তো। দুইটা ঘটনা বলি, উদাহরণ হিসাবে। ডেমো দেই আরকি।

(৪) 
তখন আমার বয়স তেইশ কি চব্বিশ। সিনেমায় কাজ করার চেষ্টায় আছি, সিনেমা বানাবো। গুলিস্তান কাকরাইল আর এফডিসিতে ঘোরাঘুরি করি। একদিন দুপুরের পর গেছি এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে, খিলগাঁয় ওর বাপের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে বসে বন্ধুটি। উদ্দেশ্য বিকালে একটু ফরিদপুর ম্যানশনে যাবো দুইটা সিনেমা কোম্পানির অফিসে। বন্ধুটি বলে যে আজ বিকালে সে নারায়ণগঞ্জ যাবে, আজকে ওর পক্ষে ফরিদপুর ম্যানশনে যাওয়া যম্ভব না। নারায়ণগঞ্জ কেন? একটু দুষ্টু হাসি হেসে সে জানায়, টানবাজার যাবে, সেখান থেকে রুবেল খবর পাঠিয়েছে যেতে, অনেকদিন যাওয়া হয় না। আমাকেও খোঁচা দেওয়ার স্টাইলে জিজ্ঞাসা করে, যাবি নাকি? খোঁচা দেওয়ার কারণ হচ্ছে বন্ধুটি জানে যে আমি এইপ্রকার ভোগে আনন্দ পাই না।

কি মনে করে আমিও ওর সাথে রওনা দিই- যাই না, দেখে আসি।

টানবাজারে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানায় রুবেল। রুবেল নারায়নগঞ্জেরই ছেলে। আমাদের বয়সীই। কমবয়সে টানবাজারে ঢুকে একজন যৌনকর্মীর সাথে ওর প্রেম হয়ে যায়। ওকে বিবাহ করে সে এখন টানবাজারের ভিতরেই বসবাস করে। আমাদেরকে সে তার ঘরের কাছেই একটা চায়ের দোকানের মতো জায়গায় আপ্যায়ন করে কেরু কোম্পানির পানীয় দিয়ে। আমার বন্ধুটি জানায় আমার এইসবে আগ্রহ নেই, রুবেলের বিশ্বাস হলো কিনা জানি না, সে একটু সরু চোখ করে আমার দিকে তাকায়। আমার হাতে একটি গেলাস ধরিয়ে দিয়ে আমার বন্ধুটিকে আশেপাশেরই কোন একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে রুবেল আবার ফেরত আসে।

সারা গায়ে একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি নিয়ে আমি বসে থাকি। আমার কাছে সবকিছুই ঘিনঘিনে নোংরা লাগতে থাকে। চারপাশে কথাবার্তা ভেসে আসে, কখনো একটা দুইটা চিৎকার, একজন পুলিশ হেঁটে যায় ওর হাতে একটা কাগজের ঠোঙা। আমার হাতের গেলাসটিকে মনে হয় ময়লা যেন ওটার গায়ে লেগে আছে অদৃশ্য চটচটে আঠালো ময়লা। রুবেল তেলতেলে হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে, চোখ সরু করে তাকায় আমার দিকে, কথা জমাবার চেষ্টা করে আমার সাথে। আমার কাছে রুবেলকে মনে হয় একটি ময়লার মূর্ত রূপ, যেন ওর হাত থেকে সিগারেট নিলেও সেখানে থেকে আমার হাতে লাগবে ময়লা। যে চেয়ারটা বসে আছি, যে টেবিলটা- ঘিনঘিনে।

আমার বন্ধুটি ফেরত আসেন খানিকক্ষণ পরে। রুবেল জানতে চায়, কেমন ছিল! আগে থেকে তো জানিয়ে আসিনি আমরা, আগে জানিয়ে আসলে বা একটু সময় নিয়ে আসলে সে কিনা আরও উত্তম ব্যবস্থা করতে পারতো। আমার বন্ধুটি জানায়, না না, ঠিক আছে সেরকম খারাপ না, কাজ চলে, তবে এর পরেরবার যদি একটু কচি ধরনের একটা...। রুবেল আশ্বস্ত করে, পরেরবার উত্তম কচি ইয়ের ব্যবস্থা হবে। গেলাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে, শূন্য গেলাসটা সতর্কতার সাথে টেবিলে রাখতে রাখতে সিগারেটে কড়া একটা টান দিয়ে উদাসী দার্শনিকের মতো রুবেল উপসংহার টানে, 'আরে কি আছে, বাত্তি নিবাইয়া কাপড় খোলার পর সবই এক- শাবানা ববিতা জ্যোৎস্না আর সখিনা। মাইয়ামানুষ তো মাইয়ামানুষই'। পরের কথাগুলি ছিল একটু গ্রাফিক ধরনের।

(৫) 
তার বছর বিশেক পর। ততদিনে আমি উকিল হয়ে গেছি, পেশাগতভাবে খানিকটা প্রতিষ্ঠাও পেয়েছি। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যাবসায়ি বন্ধু দাওয়াত দিয়েছেন ওর বাসায়। অনেক লোকই আমন্ত্রিত। গুলশান দুই নম্বরে তার বাড়ী, সেবাড়ীর তিনতলায় পার্টি, উত্তম খানাপিনা আর অতি উত্তম সিগার। আমি কি সিগার চাই? আমি মিনমিন করি, যে কোন একটা হলেই চলবে, রোমিও জুলিয়েট বা...। আমাদের হোস্ট হাসেন। আরে রোমিও জুলিয়েট তো সবসময়ই খান, আসেন আপনাকে একটা ভাল সিগার খাওয়াই। তিনি একটা সিগার দিলেন, মাথাটা কেটে দিলেন, আগুন ধরাতেও সাহায্য করলেন। একমুখ সুগন্ধি ধোঁয়া ছেড়ে, আমি সিগারটার লেবেল দেখতে চেষ্টা করি। না, হাভানার সিগার না, হন্ডুরাসে তৈরি- আসলেই আমার চাখা সবচেয়ে উত্তম সিগারগুলির মধ্যে একটা। উম।

সিগারটা কায়দা করে হাতে ধরে বারান্দায় যাই, বাগানের মতো করে সাজানো বারান্দা। কয়েকটা আরামদায়ক আসন ছড়ানো, মাঝখানে ছোট একটা টেবিল, আর টেবিলের পাশে রাখা একটা ছোটখাটো টেলিস্কোপ। টেবিলে রাখা হরেক সাইজের, হরেক রঙের গেলাস আর মাঝখানে একটা ছাইদানি। স্লিম ফিট একটা স্যুট পরে সেবক ধরনের এক যুবক দশ মিনিট পরপর এসে ছাইদানি পাল্টে দিচ্ছে আর খালি গেলাস দেখলেই নিয়ে যাচ্ছে আবার ভরে নিয়ে আসবে বলে।

টেলিস্কোপ দেখে আগ্রহ লাগে। আর বারান্দার সেই আড্ডাটিতে আমাদের একজন সাবেক জনপ্রিয় ক্রিকেটার ছিলেন, তিনিও ডাকলেন, ইমতিয়াজ ভাই, কি সিগারেট ধরিয়েছেন, আসেন আমার কাছে আসেন, গন্ধটা বড় সুন্দর। আমি যাই। টেলিস্কোপটা নিয়েই কথা হচ্ছে, হাসি ঠাট্টা হচ্ছে আমাদের হোস্টকে নিয়ে- ভাই, আপনার আবার কবে থেকে চাঁদ তারা দেখার শখ হইল হা হা হা হি হি হি। একজন খানিকটা 'হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলাম' স্টাইলে বললেন, আরে, ও কি চাঁদ তারা দেখার জন্যে টেলিস্কোপ কিনছে? এইটা দিয়া সে আশেপাশের বাসার মেয়ে দেখে, হা হা হা। খেয়াল করে দেখলাম, টেলিস্কোপটা আসলেই সেইভাবেই সেট করা। চেয়ারে বসে টেলিস্কোপে চোখ রেখে সেটা ডানে বাঁয়ে ঘুরান যায়, উপরে নিচে না। আর ডানে বামে ঘুরালে শুধু রাস্তার ওপারে বাসাগুলির বারান্দা দরজা জানালা এইসব দেখা যায়।

গৃহকর্তা স্বীকার করলেন, চাঁদ তারায় উনার বিশেষ আগ্রহ নাই, বারন্দায় বসলে প্রতিবেশীদের ঘরে উঁকি দেওয়ার জন্যেই তিনি টেলিস্কোপটা ব্যাবহার করেন বেশী, আর মাঝে মাঝে দূরবর্তী কিছু...। আমার কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলেন, আপনি যদি চাঁদ তারা এইসব দেখতে চান, চলে আসেন ফ্রি থাকলে, আই হ্যাভ ফেয়ারলি গুড কালেকশন অব ড্রিঙ্ক, সিগার এন্ড...।

গৃহকর্তার বাল্যবন্ধু ধরনের একজন এতক্ষণ টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে আসলেই আশেপাশের বাড়ীর দরজা জানালা বারান্দায় দেখছিলেন। টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে তিনি বললেন, দোস্ত, তুমি এইসব কি দেখ, সারভেন্টস বাথরুম কয়েকটা দেখা যায়, আর তো বিশেষ কিছু দেখলাম না। আবার হাসির রোল ওঠে। হা হা হা হি হি হি। গৃহকর্তা একটু চাপা গলায় বললেন, ইয়েস ইয়েস ইয়েস, কাজের বেটিদের বাথরুমই দেখি, আরে কাপড় খুলে ফেললে হোয়াট ইজ দ্যা ডিফারেন্স বিটুইন আ মেইড সারভেন্ট এন্ড হার মেমসাব। আ বডি ইজ আ বডি, হা হা হা, হোয়াট ডিফারেন্স ডাজ ইট মেক হোএদার ইটস আ মেইড ওর হোয়াটএভার হা হা হা।

(৬) 
এইটাই হচ্ছে নারীর শৃঙ্খল। এইটাই হচ্ছে লিঙ্গরাজনীতি। এইটাই হচ্ছে পুরুষতন্ত্র। শেষ বিচারে পুরুষের চোখে নারী শুধুই একটা ভোগের বস্তু। শুধুই মাংসের পিণ্ড। অনেকদিন আগে ইন্ডিয়ান একটা টেলিভিশন চ্যানেলে নিজের ঘরে নারীর যৌন নির্যাতন নিয়ে একটা শো দেখছিলাম। এক মা এসেছেন, তার স্বামী ধর্ষণ করেছে তার নিজের কন্যাকে। মহিলা প্রতিবাদ করেছেন, ধর্মের দোহাই দিয়েছেন, প্লিজ এটা তোমার নিজের মেয়ে। পাষণ্ড পিতা নাকি যুক্তি দেখিয়েছে, আমার গাছের ফল, তাকে আমি আগে চেখে দেখব তাতে অন্যায় কি আছে।

ঐভাবেই আমরা নারীকে দেখি। মেওয়া, ফল, রসালো বা রসকষহীন, কিন্তু মেওয়া মাত্র। ঐ যে দেখেন না, শাহজালাল ইউনিভার্সিটির এক ছেলে ফেসবুকে লিখেছে, মেয়ের যদি সেক্স এপিল না থাকে তাইলে তাকে কেউ কেন ধর্ষণ করবে? নারীর শরীরই দায়ী নারীরই ধর্ষণের জন্য। আপনারা তাকে নিন্দা করেছেন। নিন্দার যোগ্য সে বটে। আমিও আনফ্রেন্ড করেছি। কিন্তু ওর কথা তো সেটাই, পুরুষতন্ত্রের পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি- নারী তো ভোগের বস্তু, ওর আবার কনসেন্ট কি? কনসেন্ট যদি নিতে হয়, তাইলে ওর মালিকের কাছ থেকে নিতে হবে। ফলের আবার সম্মতি কি? দেখতে যদি রসালো হয়, মানে কিনা যদি ওর এপিল থাকে, তাইলে তো ওকে খাবোই।

অনেকে বলবেন, তাইলে নারী শিশু? শিশু কেন ধর্ষণের শিকার হয়? আরে ভাই, কিছু লোক তো থাকে যাদের অপরিপক্ব আম পছন্দ, কাঁচা তেঁতুল পছন্দ। এরকম কেউ কেউ নারী শিশুর মধ্যেও এপিল দেখবে- কি এমন ইয়ে আছে। আপনি যদি ফলটির মালিক হয়ে থাকেন, আপনার দায়িত্ব ফলটি দেখে শুনে রাখা, ঢেকেঢুকে রাখা। একটা বাটার মাখানো পাউরুটি উড়ে বেড়াবে হাওয়ায় হাওয়ায় প্রজাপতির মতো, আর আমি ওটাকে খেয়ে ফেললে আমার দোষ?

আমি এখন আর অবাক হই না। পুরুষ তো পুরুষ, নারীদের একটা বড় অংশকেও আমরা বুঝিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি- নারী সম্পূর্ণ মানুষ না, নারীর শরীর নারীরই না, নারীর যোনী নারীর না, নারীর জরায়ু নারীর না। ঈশ্বর এগুলি বানিয়েছেন পুরুষের ভোগের জন্যে। মালিক ছাড়া অন্য কেউ যদি নারী তোমাকে স্পর্শ করে, তাহলে তুমি এঁটো উচ্ছিষ্ট বাতিল হয়ে যাবে। তোমার যোনীটি যদি তুমি একবার সঙ্গমের জন্যে ব্যবহার করো, তুমি হয়ে গেলে সেকেন্ড হ্যান্ড, ইউজড মাল। আমাদের পুরুষদের প্রায় সকলেই দেখবেন এই মতামত পোষণ করেন। এদের ধারনা নারীকে পুরুষ এর সমান মনে করার অর্থ হলো নিজের অণ্ডকোষ কেটে ফেলে দেওয়া।

এমনকি সামাজিক বুদ্ধিজীবীরাও, পড়াশুনা করা লোকেরা, আপাত লিবারেল প্রোগ্রেসিভ লোকেরাও দেখবেন, নারী যখন নিজের শরীরে মালিকানার মতো একটি সহজ, অকাট্য ও অনিবার্য দাবীর কথা বলে, তখন এরা চমকে ওঠে, লাফিয়ে ওঠে। আপনাকে ওরা বলবে, শোন, বাড়াবাড়ি করবে না, নারীবাদ মানে বাড়াবাড়ি না, নারীবাদ মানে যথেচ্ছাচার না।

(৭) 
ওরে ভণ্ডের দল, আমার শরীরের মালিক আমি, এই কথাটির মধ্যে অস্বাভাবিক কি আছে, দোষের কি আছে বা বাড়াবাড়ির কি আছে? আর এই কথাটি অস্বীকার করারই বা কি যুক্তি আছে? নারীর শরীরে নারীর মালিকানা হবে না তো কি ওয়াকফ ট্রাস্টের হবে? এখানে বাড়াবাড়ির বা যথেচ্ছাচারের কি আছে?

থাক এখানেই থামি। নইলে মুখ খারাপ করা শুরু করতে পারি। আজকাল মেজাজ ঠিক রাখতে পারছি না।

লেখক: আইনজীবী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত