তোমার রসিকতা ও আমার রাগ, হে পুরুষ...

প্রকাশ : ০৭ মে ২০১৭, ০১:২৪

শুরুতেই একটা গল্প বলি। এক নবাবের সভায় সবচেয়ে ধারালো অস্ত্রের প্রতিযোগিতা চলছে। অনেক লোক প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছে। কেউ হাতের তলোয়ার দিয়ে লোহা কাটছে, কেউ বর্শা দিয়ে গাছের গুড়ি এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। তো এরকম এক ওস্তাদ, তার সামনে এক পালোয়ানকে দাঁড় করিয়ে তরোয়াল ঘোরালেন, পালোয়ানটিকে তখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওস্তাদ বললেন, বেয়াদব, সেলাম করো। পালোয়ানটি যেই ঝুঁকলো ওমনি তার মাথা খসে পড়ে গেল। নবাব বাহবা দিয়ে ওস্তাদকে পুরস্কার দিতে যাবেন এমন সময় এক রোগা হাড় জিরজিরে লোক ছুটে এলো তার পুরো মুখ ঢাকা বউকে নিয়ে। জাঁহাপনা, সব চাইতে ধারালো অস্ত্র দেখে নিন, বলেই বউয়ের মুখের কাপড় খুলে দিল সে। লম্বা জিভ বের করে দিল বউ। ব্যস পুরস্কার নিয়ে গেল রোগা লোকটাই। মেয়েদের জিভের চাইতে ধারালো অস্ত্র হয় নাকি?

আমাদের সমাজের পুরুষদের অধিকাংশ রসিকতাই নারীকেন্দ্রিক। অথবা এভাবেও বলা যায়, আমাদের সমাজ নারীদের নিয়ে রসিকতা করতে খুব পছন্দ করে। নারীদের হেয় করে, তাদের নিয়ে রঙ্গরস করে আলাপ না করলে আমাদের সমাজের পুরুষদের আড্ডা জমে না। শুধু কি আড্ডা! সোশ্যাল মিডিয়ায়ও নারীদের নিয়ে নিম্নমানের রসিকতা রীতিমত ট্রল করা হয়। এবং ওই ট্রল পেজগুলোতে হাজার হাজার লাইক কমেন্ট উপচে পড়ে।

এই ফেসবুকেই বিভিন্ন পোস্টে প্রায়শই চোখে পড়ে নারীদের নিয়ে চটুল জোকস্। বউরা কান ঝালাপালা করে সর্বক্ষণ, তাদের কথার খোঁচায় পুরুষের মন নাকি সর্বদা জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হচ্ছে! অবশ্য অঙ্গার হওয়ারই তো কথা। নারীর কথায়, প্রতিক্রিয়ায়, রাগে, প্রতিবাদে কান দিতে নারাজ পুরুষদের 'তুমি থামো' বলে ধমক দেওয়াটাই যে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এটাই যে রীতি।

সেদিন এক পোস্টে দেখলাম একজন লিখেছে, "যদি দেখেন বিয়ের রাতে বিনা রক্তপাতে যুদ্ধ হয়ে গেছে, তবে ভাববেন দেশ অনেক আগেই স্বাধীন হয়ে গেছে" - হাসি মস্করার সেই পোস্ট দেখেও অবাক হইনি। কারণ আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষদের কাছে বিয়ের আগে সেক্স অ্যাডভেঞ্চার আর বিয়ের পর ঘরের নিরামিষ রেখে মাঝেমধ্যে বাইরের পোলাও বিরিয়ানি খাওয়া দোষের কিছু নয়। অথচ একই কাজ তার স্ত্রী করলে, তাকে কুলটা, বেশ্যা উপাধিতে ভূষিত করতে পিছপা হয় না সে। আমাদের সমাজের পুরুষের কাছে বিয়ে মানেই ভার্জিন যোনী। অবাক করা বিষয় হলো, এই পুরুষেরাই বিয়ের আগে সেক্সের অভিজ্ঞতার জন্য চায় ভার্জিন যোনি, বিয়ের জন্যও খুঁজে ভার্জিন যোনি, বিয়ের পর মাঝে মধ্যে 'বিরিয়ানি' খেতেও খুঁজে ভার্জিন যোনী। তা সে নিজে যতই ভার্জিন না হোক! যৌনতার ক্ষেত্রে পুরুষের ধ্যানজ্ঞান ভার্জিন যোনীময়। হাত চালিয়ে বিশেষ অঙ্গে কড় পড়ে যাওয়া পুরুষ ও তাদের পতাকাবাহী নারীরা বিয়ের আগে বের হয় 'সতী' নারী খুঁজতে!!

তো যা বলছিলাম, যেকোনো পাবলিক প্লেস, সে হোক ঘরোয়া আড্ডা, বন্ধুদের আড্ডা, ফেসবুক, হোয়াটসআপ, ইন্টারনেট, রাস্তা, বাস, প্রতিনিয়ত পুরুষরা নারীদের নিয়ে এরকমই নীচুমানের জোকস্ বলে এক ধরণের সুতীব্র সুখ অনুভব করে। শুধু যে মজা বা তামাশা করার জন্য এসব বলা হয় তা কিন্তু নয়, এসবের মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি বিদ্বেষও ফুটে উঠে। এবং পুরুষের এহেন বিকৃত রসবোধে ক্ষেত্রবিশেষে বিব্রত হতে হয় নারীদেরই। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করি প্রতিবাদ করার পরিবর্তে কিছু সংখ্যক নারীও ওইসব মজায় গা-ভাসান। কারণ বুঝি, পুরুষতন্ত্র তাদের মাথায় জন্মের সময় থেকে ঠেসে গুজে দিয়েছে 'ভালো মেয়ের' সংজ্ঞা। 'ভালো মেয়েরা' মুখ বুজে সব সহ্য করে, 'ভালো মেয়েরা' প্রতিবাদ করে না, 'ভালো মেয়েরা' এহেন বিব্রত হওয়াকে খুব সহজে হজম করে ফেলে। অন্যায়কে মেনে নেওয়ার শিল্পটা পুরুষতন্ত্র বেশ ভালো করিয়েই রপ্ত করিয়েছে তাদের।

তাইতো পুরুষের এহেন নোংরা রসবোধের প্রতিবাদে তারা কুন্ঠা বোধ করে। কারণ এই সমাজ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে প্রতিবাদী নারী মানে কুলটা, অভদ্র, ঝগড়ুটে। আমাদের সমাজে প্রচলিতই আছে, "পুরুষ রাগলে হয় বাদশা, আর মেয়েমানুষ রাগলে হয় বেশ্যা"। আর এসব উপাধি থেকে বাঁচার জন্য, নিজেকে তথাকথিত 'ভালো মেয়ে' সাজিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা করে যায় তারা। কিন্তু আর কত??

এই যে আমার বোকসোকা, ভালো মেয়েরা, দিদিরা, বোনেরা, বন্ধুরা, তোমাদেরই বলছি... আর কতো?? শোনো, তোমাদের সম্মান রক্ষায় তোমরা যদি ক্ষেত্রবিশেষে কিছুটা প্রতিবাদী হও, তোমরা কিন্তু মোটেই কুলটা, ঝগড়ুটে হয়ে যাবে না! বরং যারা তোমাদের এইগুলো বলতে আসবে, জেনে রেখো তারা তোমাদের সাহস আর শক্তিকে ভয় পাচ্ছে বলেই মরিয়া হয়ে তোমাদের দমানোর শেষ চেষ্টা করছে ওই উপাধিগুলো দিয়ে। তাই নিজের সম্মান রক্ষার্থে প্রতিবাদ করতে শেখো এহেন নোংরা রসিকতার।

আর আমার পুরুষ বন্ধু, প্রেমিক, দাদা, ভাই, বন্ধুদের বলছি, এবার সময় এসেছে সংযত হওয়ার। নিজেদের এহেন রসবোধকে নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করুন। নিজেদের বিকৃত রসবোধ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া, অথবা অন্যান্য জায়গায় নারীকে অস্বস্তিতে ফেলা বন্ধ করুন। আর না হলে, যেদিন আমরা রসিকতায় নামব, সেদিন পালানোর পথ খুঁজে পাবেন না। তাই সময় থাকতে সংযত হোন!!

সুমনা চৌধুরীর ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত