নারী নিরাপদ তো?

প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০১৭, ১৯:০৯

জোহরা শিউলী

এসো হে বৈশাখ... এসো এসো...। লাল-সাদা আর খোঁপায় ফুলের মালায় সেজে নগরে নারীরা বর্ষবরণের প্রস্তুতি নেন। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বর্ষবরণে রমনায় মেতে উঠে আপামর জনসাধারণ। এটি একটি সর্বজনীন উৎসব। প্রাণের উৎসব। এই প্রাণের উৎসবে প্রাণের সঙ্গে প্রাণ মিলিয়ে বর্ষবরণ করি আমরা। উচ্ছলতায় নিজেকে সাজিয়ে এত দিন বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে শামিল হতেন সবাই। কিন্তু ১৪২২-এর পহেলা বৈশাখের পর এই দিনের আনন্দ উদযাপন নিয়ে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে সবার মনে। বিশেষ করে নারীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে। তারা এখন আগের মতো স্বতঃস্ফূর্ত নন, এই পহেলা বৈশাখ বরণে। এর কারণ নববর্ষে নারীদের যৌন হয়রানি। ১৪২২-এর ১ বৈশাখে টিএসসি এলাকায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে ৯টার মধ্যে হাজার হাজার মানুষের উপচেপড়া ভিড়ে উচ্ছৃঙ্খল কিছু তরুণ মেয়েদের হয়রানি করে। এ ঘটনায় পরদিন শাহবাগ থানার এসআই আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশ্লিট ধারায় অজ্ঞাত পরিচয় কিছু যুবকের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন।

পহেলা বৈশাখের ওই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও টিএসসি এলাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছিল। এসব অনুষ্ঠানে সারা ঢাকা শহর থেকে হাজার হাজার লোক ওই এলাকায় জড়ো হয়। ওই সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও টিএসসি এলাকা থেকে লোকজন বের হওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য এলাকায় প্রচণ্ড ভিড়ের সৃষ্টি হয়। এই ভিড়ের মধ্যে সংঘবদ্ধ একদল তরুণ ঘটনাস্থলে নারীদের হয়রানির চেষ্টা করে। নারী লাঞ্ছনাকারীরা ভিড়ের মধ্যে কিছু নারীর শাড়ি ধরে টান দেয়।
 
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে যখন সবাই বের হচ্ছিল, তখন গেটে থাকা বহিরাগত ওই যুবকরা নারীদের যৌন হয়রানি করে। ২০-২৫ জন যুবক এক নারীর শ্লীলতাহানি ঘটানোর সময় বাঁচাতে গিয়ে আহত হন প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন। তাদের উদ্ধার করতে গেলে ওই যুবকরা উদ্ধারকারীর ওপর চড়াও হয়। তাদের ধাক্কাধাক্কিতে আহতরা পড়ে যান। পড়ে গিয়ে উদ্ধারকারীরা আহত হন। 

প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে আট-দশজন দুষ্কৃতকারী মামলায় বর্ণিত ঘটনাটি ঘটিয়েছেন বলে তদন্তে তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলের লোকজনকে কয়েক দফা লাঠিপেটা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসেন। সাক্ষ্য-প্রমাণ ও ঘটনার পারিপাশ্বিকতায় এই মামলার অভিযোগটি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। 

পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে যৌন হয়রানির মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান জানান, যেসব অজুহাতে পুলিশ এ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে, সেটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি বলেন, আমাদের গোয়েন্দারা অনেক চৌকস। তারা অনেক গোপন আস্তানা থেকে আসামি ও জঙ্গিদের বের করে নিয়ে আসেন। এক্ষেত্রে অপরাধীদের ছবিসহ তারা দেশের অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তাও নিতে পারেন।

এমন নৃশংস ঘটনার পর এই সর্বজনীন উৎসবটিতে কী নারীরা পারবেন তাদের মতো করে বাইরে আনন্দ-উৎসবে যোগদান করতে? দ্বিধাদ্বন্দ্ব-ভয় মনের কোণে এখনও সারাক্ষণ। পহেলা বৈশাখ আনন্দের জায়গায় এখন ভর করেছে আতঙ্ক। তবে কী জনসাধারণ এই আনন্দে শামিল হবে না? এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্র জানায়, এবার ঢাকার ৭০টি স্থানে বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বাংলা বর্ষবরণের নানা আয়োজন রমনা, সোহরাওয়ার্দী 

উদ্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক হলেও এবার সারা ঢাকায় থাকছে নজরদারি। যেসব স্থানে অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি ডিএমপি কর্তৃক দেওয়া হয়েছে সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রার নিরাপত্তায় মাঠে থাকবে মহানগর গোয়েন্দার (ডিবি) ও স্পেশাল উইপন্স অ্যান্ড ট্যাকটিক্স (সোয়াট) টিম। দেশে প্রথমবারের মতো এ স্পেশাল টিম বর্ষবরণের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। এ ছাড়াও বর্ষবরণের এ মঙ্গল শোভাযাত্রার সামনে, পেছনে, মাঝে এবং দু'পাশে পুলিশি পাহারা থাকবে। পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে। ১৯টি ওয়াচ টাওয়ার দিয়ে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। সে অনুযায়ী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হবে। এ ছাড়াও এসব স্থানে ঢুকতে পৃথক প্রবেশ ও বাহির গেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের আর্চওয়ে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে। ভেতরে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে দেহ তল্লাশি করা হবে।

ডিএমপির নির্দেশনা অনুযায়ী, উন্মুক্ত স্থানে যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে সেগুলোতে বিকেল সাড়ে ৪টার পর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। ৫টার মধ্যে সেসব অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে। তবে সংরক্ষিত স্থানে ইনডোরে ৫টার পরও অনুষ্ঠান করা যাবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, বিএনসিসি এবং বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। পহেলা বৈশাখের দিন রাজধানীর বেশ কয়েকটি জায়গায় অতিরিক্ত জনসমাগম হবে। জনসমুদ্রে পরিণত হবে রমনা বটমূল আর টিএসসি। এই ভিড়ে যাতে কোনো শিশু না হারিয়ে যায় তাই তাদের পকেটে ঠিকানা, ফোন নম্বর সংবলিত একটি চিরকুট রাখতে পারেন।

সূত্র: সমকাল, ০৯ এপ্রিল ২০১৭

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত