কল্পনা চাকমা অপহরণের ২০ বছর, জানা-অজানা কিছু তথ্য

প্রকাশ : ১২ জুন ২০১৬, ২৩:২৪

পপেন ত্রিপুরা

১.

কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার সর্বশেষ খবর হলো, চলতি মাসের ৮ তারিখটি (মে, ২০১৬) ছিল রাঙামাটি পুলিশ সুপার কর্তৃক আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্ধারিত দিন। কিন্তু পুলিশ সুপার তারিকুল হাসান আদালতে কোনো ধরণের প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে কালিন্দি কুমার চাকমার আইনজীবী এ্যাড. জুয়েল দেওয়ান জানিয়েছেন। ২০ বছরে আদালত এ নিয়ে ৩০বার তারিখ নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র এখনো কল্পনা চাকমাকে খুঁজে পায়নি এবং অভিযুক্ত অপরাধীদের চিহ্নিত করতে পারেনি। এমনকি সংশ্লিষ্ট মামলায় গঠিত কোনো তদন্ত কমিটি আদালতে নিরপেক্ষ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি।
আদালত ফের পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেছেন চলতি বছরের ১২ জুলাই।

 

২.
১২ জুন, ১৯৯৬ থেকে ১২ জুন, ২০১৬। ২০ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই ২০ বছরে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য আদালত কমপক্ষে ৩০বার তারিখ নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু ৩০বারেও প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তদন্ত কমিটি, বাঘাইছড়ি থানা ও সিআইডি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলেও তা নিরপেক্ষ হয়নি বলে বাদীর নারাজি আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত প্রতিবেদনগুলো গ্রহন করেনি।

 

৩.
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের ১২ জুনে(১১ জুনের দিবাগত রাত একটার দিকে) সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক সাত ঘন্টা পূর্বে বাঘাইছড়ির নিউ লাইলাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে দুই বড় ভাইসহ অপহৃত হন কল্পনা চাকমা। ভাইয়েরা পালাতে সক্ষম হলেও পারেননি কল্পনা চাকমা।
পরিবারের অভিযোগ রয়েছে, বাঘাইছড়ির কজইছড়ি সেনা(১৭ ই.বি. রেজি.) ক্যাম্পের তত্‍কালীন কমান্ডার লে. ফেরদৌস কায়ছার খান, ভিডিপি'র পিসি নুরুল হক ও ভিডিপি সদস্য সালেহ আহমেদ'র নেতৃত্বে ১০-১২জনের পরিচিত-অপরিচিত সশস্ত্র সেনা-ভিডিপি'র জওয়ান ২৩ বছর বয়সী নারী নেত্রী কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

৪.
২০ বছর পরও ঘটনার বিবরণ হুবহু তুলে ধরলেন কল্পনার বড় ভাই ও মামলার বাদী কালিন্দি কুমার চাকমা।
গত ৮ জুন(২০১৬) বুধবার মুঠোফোনে আলাপে এই প্রতিবেদকের কাছে ঘটনার বিবরণ পুনঃউপস্থাপন করেন তিনি। তাঁর বিবরণ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন কর্তৃক প্রকাশিত 'কল্পনা চাকমার ডায়েরি' থেকে জানা যায়, ঘটনার রাত একটার দিকে অপহরণকারীরা বাড়ি ঘেরাও করে তাঁদেরকে ডাকতে থাকে। ঘুমের ঘোরে ডাক শুনে কালিন্দি কুমার উঠে এসে দরজার সামনে আসতেই অপহরণকারীরা দরজার রশি কেটে প্রবেশ করেছে। কালিন্দি কুমার জানান, অপহরণকারীদের মধ্যে দুইজনের পরণে ছিল লুঙ্গি। বাকীরা কেউ খাকি, কেউ সেনা পোষাকে ছিল। এ সময় দুর্বৃত্তরা বাতি জ্বালাতে দেয়নি। অন্ধকারে বাড়ির সবাইকে বারান্দায় ডেকে জড়ো করা হয়। একে একে চোখে টর্চ লাইট মেরে নাম জিজ্ঞেস করতে থাকে। এ সময় কল্পনার সেঝো ভাই লাল বিহারী চাকমা(ক্ষুদিরাম)র মুখে টর্চ মারলে তিনি আলো ঠেকাতে থাকেন। এ সময় আলোর প্রতিফলনে ক্ষুদিরাম লে. ফেরদৌস, পিসি নুরুল হক ও সালেহ আহমেদকে চিনে ফেলেন। প্রথমে তাঁকেই বাইরে নিয়ে যায় বন্দুকধারীরা। বাইরে নিয়ে তাঁকে কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে এবং হ্রদের হাঁটু পানিতে নামায় সেনা জওয়ানরা। তারপর বড় ভাই কালিন্দি কুমার ও কল্পনাকে বাইরে নিয়ে তাঁদেরকেও চোখে কাপড় বেঁধে দেয় সেনা দুর্বৃত্তরা। এরপর লে. ফেরদৌস ক্ষুদিরামকে মারতে গুলির নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে ক্ষুদিরাম পানিতে লাফ দিয়ে পালান। সাথে সাথে তাঁকে একাধিকবার গুলি করা হলেও পানিতে ডুব দেয়ায় অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান ক্ষুদিরাম। বিবস্ত্র অবস্থায় পালিয়ে রাতে একজনের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। এদিকে, গুলির শব্দ পেয়ে তাঁর ভাইকে মেরে ফেলা হয়েছে ভেবে কালিন্দি কুমারও পালাতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পারছিলেন না। পরে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তিন বন্দুকধারী সেনাকে ধাক্কা দিয়ে পালাতে সক্ষম হন তিনিও। সকালে খবর পেয়ে গ্রামের মানুষ ছুটে যান কল্পনাদের বাড়িতে। খুঁজতে থাকে ক্ষুদিরাম ও কল্পনাকে। সকাল সাতটার দিকে ক্ষুদিরাম চলে আসেন কিন্তু কোনো হদিস পায়নি কল্পনার। তবে, ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়, আনসার-ভিডিপি'র ব্যবহৃত খাকি কাপড়ের ব্যান্ডেল ভর্তি ৩০৩ রাইফেলের গুলি ও ক্ষুদিরামের লুঙ্গি।

এ দিন সকাল ১১টায় গ্রামবাসীরা কালিন্দি কুমার চাকমাকে নিয়ে বাঘাইছড়ি থানা নির্বাহী কর্মকর্তা (টিএনও) হাসান জাহাঙ্গীর আলমের কাছে যায়। এ সময় তাঁদের সাথে ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান দীপ্তিমান চাকমা। টিএনও নিজেই কালিন্দি কুমারের জবানবন্দি লিখে নেন। জবানবন্দী দেয়ার সময় কালিন্দি কুমার ঘটনাস্থলে পাওয়া এ্যামিউনিশন পচটিও টিএনও'র কাছে জমা দেন। কিন্তু টিএনও লিখিত জবানবন্দী কালিন্দি কুমারকে পড়ে শোনাননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, ক্ষুদিরামকে নিয়ে কজইছড়ি সেনা ক্যাম্পে যান সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সাম্রাজ্য চাকমা। পরে কালিন্দি কুমার থানায় গিয়ে এফআইআর(মামলা নং ২/৯৬১, তাং ১২/৬/১৯৯৬ইং; ধারা- ৩৬৪)। কিন্তু ওসি শহিদুল্লাহ বাদীর বাদীর জমাকৃত প্রমাণাদি লোপাতসহ প্রদত্ত জবানবন্দী বিকৃতি করে অভিযুক্ত লে. ফেরদৌস, পিসি নুরুল হক ও সালেহ আহমেদদের নাম বাদ দিয়ে সাধারণ একটি এফআইআর করেন।

এ ব্যাপারে ওসি বলেছিলেন, 'টিএনও কালিন্দি কুমার চাকমার জবানবন্দী নিয়েছেন এবং তাঁকে পড়ে শুনিয়েছেন'। কিন্তু টিএনও তা অস্বীকার করে বলেছিলেন, 'কালিন্দি কুমার প্রথমে আমার কাছে এসে জবানবন্দী দিয়েছেন বটে কিন্তু তা এফআইআর আকারে রেকর্ড করা হয়নি। এবং কালিন্দি কুমারকেও পড়ে শোনানো হয়নি এটাও সত্য'।
 

৫.
ঘটনার ১৫দিন পর ২৭ জুনে কল্পনা চাকমার মুক্তির দাবিতে পাহাড়ি গণপরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন বাঘাইছড়িতে সকাল-সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। কর্মসূচি চলাকালীন রুপন চাকমা(১৫) নামে একজন এসএসসি পরীক্ষার্থীকে সেটেলার বাঙালিরা পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। অবরোধ কর্মসূচিতে অংশগ্রহন করতে যাওয়া মনোতোষ চাকমা(১৫), সমর বিজয় চাকমা(১৬) ও সুকেশ চাকমা(১৬)দের সেটেলার বাঙালিরা রাস্তায় ধাওয়া করে ধরে কুপিয়ে মেরে ফেলে।

আজও অবধি এই চারজনেরও কোনো হদিস দিতে পারেনি রাষ্ট্র। এছাড়াও ওইদিন কমপক্ষে ১৬ জন অবরোধকারী আহত হয়।
গ্রামবাসীদের অভিযোগ, কল্পনা অপহরণের আগে ১৯ মার্চ নিউ লাইল্যাঘোনার সাতটি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল লে. ফেরদৌসের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ফেরদৌসের মুখোমুখি হয়ে এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন কল্পনা চাকমা। এই ক্ষোভ থেকেই ফেরদৌস কল্পনাকে অপহরণ করে বলে অভিযোগ।

 

৬.
জাতীয় নির্বাচনের ভোটদান অনুষ্ঠানের মাত্র সাত ঘন্টা আগে একজন নারী নেত্রী অপহৃত হলেও বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করেনি। কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারের ব্যাপারেও কোনোরকম ব্যবস্থা নেয়নি। তারপর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। তারাও 'ঘটনাটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঘটেছে' অজুহাত দেখিয়ে এ ব্যাপারে গড়িমসি করতে থাকে।
অন্যদিকে, সেনাবাহিনী ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্য অপচেষ্টা চালাতে থাকে। অপহরণ ঘটনাটিকে সেনাবাহিনী 'হৃদয়ঘটিত ব্যাপার' বলে অপপ্রচার করতে থাকে। কোনো ছলচাতুরী কাজ না হওয়ায় অবশেষে কল্পনা চাকমার সন্ধানদাতাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দিয়ে হেলিকপ্টারযোগে প্রচারপত্র(লিফলেট) বিলি করতে থাকে। এছাড়াও ২২ জুলাই, ১৯৯৬ তারিখে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক চট্টগ্রাম ডিভিশন-এর মাধ্যমে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে নানা মিথ্যা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে থাকে।

৭.
দেশে-বিদেশে তুমুল প্রতিবাদে অনেকটা চাপের মুখে সরকার অবশেষে ঘটনার তিন মাস পর ৭ সেপ্টেম্বরে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়। কমিটির অন্য সদস্যদ্বয় হলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. অনুপম সেন ও তত্‍কালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন।

কমিটি ১৯৯৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ৪০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু সরকার আজও অবধি তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেনি। আইনজীবীদের মারফত জানা গেছে যে, তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, 'কল্পনা চাকমা চাকমা হয় উদ্দেশ্যমুলকভাবে নতুবা বলপূর্বক অপহৃত হয়েছেন। তবে, পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে কারা অপহরণ করেছে তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।'

এদিকে, বাঘাইছড়ি থানা পুলিশও মামলার এজাহার সূত্রে তদন্ত করতে থাকে।

ঘটনার পরের বছর ১৭ জানুয়ারি, ১৯৯৭, বাঘাইছড়ি থানার মামলাটি জেলার বিশেষ শাখায় হস্তান্তর করা হয়। আট বছর পর ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর আবার জেলা থেকে বাঘাইছড়ি থানা পুনঃ হস্তান্তর করা হয়। ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় বাঘাইছড়ি থানা পুলিশ। পুলিশের এই তদন্ত প্রতিবেদনটিও বিচারপতি আব্দুল জলিলের তদন্ত প্রতিবেদনের মতই অভিযুক্তদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রেখে করা হয়েছে বলে কালিন্দি কুমার চাকমা অভিযোগ এনে আদালতে নারাজী আবেদন করেন। বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ২০১০ সালের ২ সেপ্টেম্বর মামলা তদন্তে সিআইডি'র চট্টগ্রাম জোনকে নির্দেশ দেন। সিআইডি দুই বছর তদন্ত করে ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে। সিআইডি'র প্রতিবেদনও পূর্বের দাখিলকৃত দুটি প্রতিবেদনের মতোই। সিআইডি'র প্রতিবেদনের উপরও বাদী কালিন্দি কুমার চাকমা নারাজী আবেদন করলে আদালত ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রাঙামাটির পুলিশ সুপার(এসপি)কে তদন্তের ভার দিয়ে নির্দেশ দেন। এসপি প্রায় এক বছর তদন্তের দায়িত্ব নেয়ার পর কল্পনা চাকমার দুই বড় ভাইয়ের ডিএনএ সংগ্রহের অনুমতি চাইলে আদালত সুপারিশ করেন। কিন্তু কালিন্দি কুমার ও ক্ষুদিরাম ডিএনএ দিতে রাজি হননি। এ ব্যাপারে, কালিন্দি কুমার চাকমা বলেন, 'আমার ডিএনএ পরীক্ষার বিষয়টি একেবারে অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্র এসব পরীক্ষার কথা বলে তদন্ত কালক্ষেপন করছে'। তিনি বলেন, 'অপহৃতকে জীবিত অথবা মৃত সন্ধান পাওয়ার পর চিহ্নিত করা না গেলে না হয় ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন ছিল। রাষ্ট্র কল্পনা চাকমাকে সন্ধানই পায়নি, আমি কেন ডিএনএ পরীক্ষা করাবো?'।
 

৮.
'কল্পনা চাকমাকে ফিরে পাবার আশা না হয় ছেড়েই দিলো কল্পনার সহযোদ্ধারা। কিন্তু রাষ্ট্রের লজ্জা কোথায় ঢাকাবে? অপরাধী যেই হোক, ২০ বছরে তাঁদের কোনো হদিস বের করতে পারেনি কেন রাষ্ট্র? দেশের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল'। কালিন্দি কুমার চাকমার এই প্রশ্নগুলির উত্তর কে দিবে? তিনি প্রশ্ন করেন, 'কল্পনা চাকমা হুদু?' বা 'কল্পনা চাকমা কোথায়?'

৯.
কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনাকে একটি 'ক্লুলেস' ও 'সেনসেশনাল' কেস বলে মন্তব্য করেছিলেন তত্‍কালীন বাঘাইছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ শহিদুল্লাহ। ৩ জুলাই, ১৯৯৬ তারিখে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিনিধি দলকে ওসি জানান, তথ্যানুসন্ধানে সময় লাগবে। এটা একটা ক্লুলেস কেস। মামলাটিকে সেনসেশনাল কেস উল্লেখ করে ওসি আরো জানান, কেসটিকে নিয়ে অতি সতর্কভাবে এগুতে হবে।
তত্‍কালীন রাঙামাটি জেলা প্রশাসক শাহ আলম মামলাটি ব্যাপারে বলেছিলেন, 'Law will take it's own course. পুলিশ তদন্ত করছে, তদন্তের ফলাফল অচিরেই জানা যাবে'। জেলা প্রশাসক আরো বলেছিলেন, 'একটি বিশ্বাসযোগ্য এজেন্সি জানিয়েছে, কল্পনা চাকমা নাকি এখন রাঙামাটিতে'।

২ জুলাই(১৯৯৬) পাহাড়ি গণপরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য বিজয় কেতন চাকমা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছিলেন, ঘটনার দিন তাঁর নেতৃত্বে পাহাড়ীদের একটি প্রতিনিধি দল এসপি নুরুল আনোয়ারের সাথে দেখা করে কল্পনা অপহরণের ব্যাপারে জানালে এসপি রেগে গিয়ে তাঁদেরকে প্রশ্ন করছিলেন, 'অস্ত্র কার কাছে থাকে? সেনাবাহিনী না শান্তিবাহিনীর কাছে?'
ওইদিন পুলিশ সুপার আসকের প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছিলেন, 'সঠিক তথ্য পেলে আগামীকালও কল্পনাকে উদ্ধার করা যাবে'। তিনি আরো বলেছিলেন, 'সারা রাঙামাটি এলাকায় ১৮০টি সেনা ক্যাম্প আছে, আমরা লে. ফেরদৌসকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি'।
রাঙামাটি ব্রিগেড কমান্ডার মেজর এফ মাহবুবুর রহমান তার সাথে আসকের প্রতিনিধি দলকে দেখা করতে দেননি। তারা সেকেন্ড ইন কমান্ড'র সাথে দেখা করেছিলেন।

 

১০.
কেন্দ্রীয় হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি ও কল্পনা চাকমার সহযোদ্ধা ইলিরা দেওয়ান কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার ব্যাপারে বলেন, 'কল্পনা চাকমা অপহরণকে আমি নিছক নারী অপহরণ ঘটনা হিসেবে দেখিনা। এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং জাতিগত নিপীড়ণের কৌশল'। তিনি জানান, কল্পনা অপহৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত তত্‍কালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী অধিকার আদায়ের একমাত্র সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন। আর কল্পনা চাকমা এ সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। সাবেক নারী নেত্রী ইলিরা দেওয়ান বলেন, 'কল্পনাকে অপহরণের মধ্য দিয়ে সেই সময়ে চলমান অধিকার আদায়ের আন্দোলনের কর্মীদের মানসিক মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্যই এটি করা হয়েছে'। 'কিন্তু কল্পনার একজন সহযোদ্ধা হিসেবে আমি মনে করি, গত ২০ বছরে কল্পনার সহযোদ্ধাদের মনোবলতো ভাঙ্গতেই পারেনি বরং বর্তমান তরুন প্রজন্মও কল্পনার চেতনাকে আরো বেশি ধারণ করে কল্পনা অপহরণের প্রতিবাদ করে যাচ্ছে এবং আমাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়েছে'। বলেন, ইলিরা দেওয়ান। রোববার(১১ জুন, ২০১৬) সকালে ফেসবুক ইনবক্স চলতি লেখককে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন তিনি।

তথ্যসূত্র
১. কল্পনা চাকমার ডায়েরি- হিল উইমেন্স ফেডারেশন।
২. সংশ্লিষ্টদের সাথে ব্যক্তিগত ফোনালাপ।
৩. ব্যক্তিগত সাক্ষাত্‍কার, নিউ লাইল্যাঘোনা-২০০৫।
৪. ফেসবুকের নির্ভরযোগ্য স্ট্যাটাস।

পপেন ত্রিপুরার ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত