২০ বছরেও পাওয়া যায়নি কল্পনা চাকমার খোঁজ!
প্রকাশ : ১২ জুন ২০১৬, ১৯:১৬
কল্পনা চাকমার নাম শুনলেই আজকের দিননে অনেকেই চোখ কপালে তুলে জানতে চাইবে উনি কে? কল্পনা চাকমা একটি মশালের নাম। যে মশালের আলো পাহাড়ের আনাচকানাচে ছড়িয়ে পড়েছে।
বর্তমানে পাহাড়ি নারীরা জাতিগত নিপীড়নে পাহাড়ি নারীরা যেমন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তেমনি পারিবারিক ও সামাজিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া কিছু অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও পাহাড়ি নারীরা সজাগ হচ্ছেন, যেভাবে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন কল্পনা ছিলেন এই নারীদেরই অন্যতম বারুদের নাম।
১৯৯৬ সালের ১১ জুন মধ্যরাতে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাইল্যাঘোনার নিজ বাড়ি থেকে অস্ত্রের মুখে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়। আঞ্চলিক সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
রাজনীতি, আন্দোলন ও নেতৃত্বে স্বল্প সময়ের মধ্যেই দক্ষ নেত্রী হিসেবে পরিচিত হওয়া কল্পনা চাকমাকে অপহরণ ঘটনা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলে। তাঁকে অপহরণের পরদিন কল্পনা চাকমার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা বাদী হয়ে স্থানীয় থানায় একটি মামলা করেন।
কল্পনা অপহরণের প্রতিবাদে ও তাঁকে উদ্ধারের দাবিতে হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও তৎকালীন পাহাড়ি গণপরিষদ ২৭ জুন ১৯৯৬ তারিখে বাঘাইছড়িতে সড়ক অবরোধের ডাক দেয়। অবরোধের সময় মিছিল বের করা হলে সেই মিছিলে হামলা চালানো হয় এবং রূপন চাকমা, মনতোষ চাকমা, সমরবিজয় চাকমা ও সুকেশ চাকমাকে গুম করে হত্যা করা হয়। গুলিতে নিহত স্কুলছাত্র রূপন চাকমার লাশ রাস্তা থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে গুম করা হয় এবং বাকিরা গুচ্ছগ্রামের পাশ দিয়ে প্রাণভয়ে পালানোর সময় তাঁদের ধরে নিয়ে গুম করে দেওয়া হয়। ২৭ জুনের পর থেকে এই চারজনকে আর কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সে সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল জলিলকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কমিশন ৯৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেও এ অপহরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি। তবে সরকার সেই তদন্ত প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশও করেনি। মামলা দায়েরের ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে মামলাটির প্রথম চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
১৪ বছর তদন্তাধীন থাকার পর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আসামিদের অজ্ঞাতনামা উল্লেখ করে তা দাখিল করা হয়। বাদী ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে নারাজি দিলে পরবর্তী সময়ে অধিকতর তদন্তের জন্য আদালত মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করেন। সিআইডি দুই বছর সময় নিয়ে অবশেষে ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে। সব মিলিয়ে এ ঘটনার তদন্ত হয়েছে ৩ বার। এর মধ্যে ২ বার তদন্ত করেছে সিআইডি। তাতে ২ বারই নারাজি আবেদন করে কল্পনা চাকমার পরিবার।
সর্বশেষ রাঙামাটির পুলিশ সুপার আমেনা বেগমের দেয়া তদন্ত রিপোর্টও প্রত্যাখ্যান করে মামলার বাদী। অপহরণের পর থেকে মামলার বাদী ও পাহাড়ি সংগঠনগুলো অপহরণের জন্য এক সেনা কর্মকর্তা লে. ফেরদৌস ও ৩ জন ভিডিপি সদস্যকে দায়ী করে। কিন্তু দীর্ঘ ১৮ বছরের একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের নাম না আসায় ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবী জানিয়ে নারাজি আবেদন দিয়ে যাচ্ছেন মামলার বাদী। বর্তমানে কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি রাঙামাটি জেলা পুলিশ সুপারের অধীনে পুনঃতদন্তাধীন।
রাঙামাটির বর্তমান পুলিশ সুপার সাইদ তারিকুল হাসানের কাছে এ মামলার তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি আবারো বলেন, ‘মামলাটি তদন্তাধীন। আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্ত কাজ চলছে। আদালত যে সকল বিষয়ে আলাদা আলাদা করে অবজারভেশন নিয়ে তদন্ত করতে বলেছে আমরা সেগুলো তদন্ত করছি। এটি অনেক পুরাতন মামলা। তাই সময় লাগছে’।
কল্পনা চাকমার অপহরণের তদন্ত নিয়ে যেমন দীর্ঘসূত্রিতা হয়েছে। তেমনি জিইয়ে থাকার সুযোগে একটি মহল এই মামলাকে সামনে রেখে গত ২০ বছর ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী ও সেনাবাহিনীর অবস্থান নিয়ে দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রপাগাণ্ডা চালিয়েছে যার বেশিরভাগই মিথ্যা।
কল্পনা চাকমার বন্ধুরা এ বিষয়ে বলেন, চলতি বছর জুন মাসের শুরু থেকে পাহাড়ীদের বিভিন্ন ওয়েব সাইট ও ফেসবুক পেইজে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কল্পনা চাকমার বিচার দাবীতে বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির লক্ষে ‘ফটো একশন’ নামে একটি ক্যাম্পেইন চালু করেছে। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের লোগোসহ কল্পনা চাকমার ছবি হাতে নিয়ে তা পাঠাতে বলা হয়েছে। কিন্তু এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইট খুঁজে এ ধরনের কোনো ক্যাম্পেইনের খবর পাওয়া যায়নি।
বিগত ২০ বছর ধরেই এখনো কল্পনার বন্ধু সহ অনেকের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, কোথায় আছেন কল্পনা চাকমা? তিনি কি সেনাবাহিনীর সদস্য কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন? তিনি কি বেঁচে আছেন? বেঁচে থাকলে কোথায় আছেন? আদৌ কি খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁকে? ২০ বছরেও কোন খবর মেলেনি উইমেনস ফেডারেশন নেত্রী কল্পনা চাকমার।
সুত্র: পার্বত্য নিউজ