একবছরে ২০ হাজার ধর্ষণ, ১২ হাজার যৌন নির্যাতন
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৭:৫৪
ভারতে ২০১৬ সালে ধর্ষিত হয়েছে প্রায় ২০ হাজার শিশু বা কিশোরী। ধর্ষণ ছাড়াও প্রায় ১২ হাজার কন্যাশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার। ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যানে তেমনটাই উঠে এসেছে।
শিশুদের অধিকার নিয়ে সারা দেশ জুড়েই কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ক্রাই। সেখানে কর্মরত সমাজকর্মীরা বলছেন, ভারতে শিশুদের উপরে যৌন নির্যাতনের প্রকাশিত পরিসংখ্যানটি মোট ঘটনার কিছু অংশমাত্র।
সংগঠনটির পূর্বাঞ্চলীয় ডিরেক্টর অতীন্দ্রনাথ দাস বলেন, শিশুদের উপরে যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে গত প্রায় এক দশক ধরে। কিন্তু গত তিনবছরে সংখ্যাটা লাফিয়ে বেড়েছে। তার অর্থ এই নয় যে, এরকম ঘটনা আগে হত না। কিন্তু হঠাৎ করে সংখ্যাটা বেড়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। সাম্প্রতিক সময়ে এমন বেশ কিছু শিশু ধর্ষণের ঘটনা সামনে এসেছে, যা রীতিমতো শিহরন জাগানো।
২০১৫ সালে দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কর্ণাটকে আট বছরের একটি কন্যা শিশুকে অপহরণ করার ছবি ধরা পড়ে সিসিটিভির ফুটেজে। পরে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়, তার মুখে প্লাস্টিক গুঁজে দিয়ে চুপ করিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল।
কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দীক্ষার প্রধান পারমিতা ব্যানার্জী বলেন, কোনও না কোনোভাবে যৌন হেনস্থা হয় নি, এমনভাবে বোধহয় ভারতের কোনও মেয়েই বড় হয় না। সেটা ভিড় বাসে শরীরে হাত দেওয়া থেকে শুরু করে আরও গুরুতর কিছু - যাই হোক না কেন। আগে আমরা মেয়েরা মুখ খুলতাম না - ভয়ে, লজ্জায়, কিন্তু এখন মুখ খুলতে শুরু করেছে একটু একটু করে।
নারী আন্দোলনের কর্মী অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষও বলছিলেন, অ্যাবসলিউট নাম্বারে যৌন নির্যাতন বেড়েছে তো বটেই, কিন্তু এখন বিষয়গুলো সামনে আসছে আগের থেকে অনেক বেশী। শিশু সুরক্ষা সম্বন্ধে অভিভাবক থেকে শুরু করে পুলিশ - সকলেরই সচেতনতা বেড়েছে। যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে মুখ খুলতে অনেকে সাহস পাচ্ছেন এখন।
যৌন নির্যাতনের শিকার অর্ধেকই ছেলেশিশু
সমাজকর্মীরা বলছেন একটা বিরাট সংখ্যক পুত্রশিশু বা কিশোররাও নিয়মিত যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে ভারতে। এ প্রসঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রাজকের প্রধান দীপ পুরকায়স্থ বলেন, ছেলেদের ওপরে যৌন নির্যাতনের পরিসংখ্যান খুব একটা পাওয়া যায় না। একমাত্র ঐ ২০০৭ সালের সংখ্যাটা ছাড়া। আমরা যারা এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করি, তাদের একটা ধারণা ছিলই যে কী সংখ্যায় ছেলেদের উপরে যৌন নির্যাতন চলে। আর সরকারী তথ্যে দেখা যাচ্ছে মোট যত শিশুর উপরে যৌন নির্যাতন হয়, তার প্রায় অর্ধেক পুত্রশিশু বা কিশোর। তার পরে আর কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই।
শিশু ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার কারণ কী
শিশু ধর্ষণ বা তাদের উপরে যৌন নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার কারণ রয়েছে একাধিক।
কেউ বলছেন ইন্টারনেটে পর্ণোগ্রাফি সহজলভ্য হয়ে যাওয়া। কারো মতে বিকৃত যৌন চাহিদা মেটানোর সব থেকে সহজ টার্গেট হয়ে উঠছে শিশুরা। কারণ তারা অরক্ষিত আর তাদের উপরে কী ঘটছে, সেটা তারা বুঝতে অক্ষম। এইসব নানা কারণেই শিশু ধর্ষণ বা শিশুদের উপরে যৌন নির্যাতন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
কলকাতায় যৌন হেনস্থার ব্যাপারে শিশুদের সচেতন করে তোলার কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দীক্ষা। তার প্রধান পারমিতা ব্যানার্জীর কথায়, অনেকগুলো কারণ আছে। এর মধ্যে পিডোফিলিয়া নিশ্চিতভাবেই মানসিক বিকৃতি। কিন্তু বাসে-ট্রামে মেয়েদের শরীর ছোঁয়ার মতো যেসব ঘটনা ঘটে, সেগুলো কিন্তু ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য। এর বাইরে একটা কারণ হল, ছোটবেলায় যেসব পুরুষ হেনস্থার শিকার হয়েছেন কোনো না কোনোভাবে, তাদের একটা অংশ পরবর্তীতে নিজেরা হেনস্থা করছেন মেয়েদের।
ক্রমবর্ধমান হারে শিশুদের যৌন লালসার শিকার বানানোর পিছনে রয়েছে কুসংস্কারও। অন্তত দেড়শো বছর আগের ছাপা বটতলার বই নামে পরিচিত তথাকথিত অশ্লীল সাহিত্যেও এই কুসংস্কারের উল্লেখ আছে। যেখানে বলা হয়, কন্যাশিশু অথবা কুমারী নারীদের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করলে নানা যৌন রোগ নিরাময় হয়।
নিউ লাইট স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রধান উর্মী বসু বলেন,আমরা যৌন কর্মী এবং তাদের সন্তানদের নিয়ে কাজ করি। আমাদের সঙ্গে যারা আছেন, তাদের অনেকেরই বয়স ৬০/ ৬৫ এমনকি ৭০। তাদের কাছ থেকেই জেনেছি, বহু মানুষ এটা মনে করেন যে কুমারী নারী বা শিশুদের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করলে তাদের নিজেদের শরীরে বাসা বেঁধে থাকা যৌনরোগ নিরাময় হয়। ভারতের বহু প্রদেশে এই ধারণা প্রচলিত রয়েছে।
সমাজকর্মী পারমিতা ব্যানার্জীও এইডস আক্রান্তদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। শিশুদের উপরে ক্ষমতা প্রদর্শন সহজ, তেমনই যৌন লালসা মেটানোর পরে ভয় দেখিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে রাখা আরও সহজ।
স্কুল ও পরিবার থেকে শিক্ষা
অনেক স্কুলেই আজকাল ছোট-বয়স থেকেই মেয়েশিশুদের শেখানো হচ্ছে কোন স্পর্শ বা আদর করাটা ভাল, কোনটা খারাপ। কোনটা গুড টাচ, কোনটা ব্যাড। আর কেউ খারাপভাবে ছুঁলে যে সেটা মাকে বলতেই হবে, সেটাও বোঝানো হচ্ছে শিশুদের।
পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী বলছিলেন, ভালো স্পর্শ আর খারাপ স্পর্শ নিয়ে পাঠ দেওয়াটা এখনও মূলত অভিজাত স্কুলগুলিতেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু সরকারী স্কুলেও যাতে এগুলো শেখানো হয়, তার জন্য আমরা স্কুল সিলেবাস কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছি। তারা আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে বিষয়টা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করবেন বলে কথা দিয়েছেন।
শুধু মেয়েদের শেখালে তো চলবে না, ছোট ছেলে বা সদ্য কিশোরদেরও এই পাঠটা দেয়া দরকার। মেয়ে মানেই শুধু শরীর নয় - সে সব অর্থেই ছেলেদের সমান। অথচ উল্টোটাই মনে করে বহু ছোট ছোট ছেলেরাও। বদলাতে হবে এই মানসিকতা-বললেন শাশ্বতী ঘোষ।
শিশু ধর্ষণ মামলার দীর্ঘসূত্রিতা
শিশুদের ধর্ষণ বা তাদের ওপরে যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলার অন্যতম একটা কারণ হল- বিচারবিভাগের দীর্ঘসূত্রিতা। নির্যাতনকারীরা অনেক সময়েই অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়। যেটা দেখে ঐ রকম ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত হয় আরও অনেকে।
পরিসংখ্যানও বলছে, শিশুদের উপরে যৌন নির্যাতনের ঘটনার বিচার সময়মতো শেষ হয় না। জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর তথ্যেই দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৫৭ হাজারেরও বেশী শিশু ধর্ষণের মামলা ভারতের নানা আদালতে চলছে। অভিযুক্তদের শাস্তি পাওয়ার হারও মাত্র ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে শিশুদের ওপরে যৌন নির্যাতন বা হেনস্থার ঘটনা ধরা হয় নি।
কলকাতা হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ভারতী মুৎসুদ্দি বলেন, এইধরনের মামলা তো শুধু নয়, ভারতের আদালতে লক্ষ লক্ষ মামলা ঝুলে আছে। একটা সাধারণ ব্যাখ্যা হল বিচারকের সংখ্যা অপ্রতুল।
মিসেস মুৎসুদ্দি আরো বলেন, শিশুদের যৌন নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে যে পকসো আইন হয়েছে, সেখানে কিন্তু যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যেমন এই মামলার বিচার পৃথক আদালতে এক বছরের মধ্যেই শেষ করার কথা রয়েছে। কিন্তু কোনও জায়গাতেই আলাদা কোর্ট হয় নি, একবছরে মামলাও শেষ করা হয় না। পৃথক পুলিশ টিম তৈরি করার কথা বলা হয়েছে আইনে, সেটাও মানা হয় না। তাই অন্য মামলার সঙ্গেই শিশুদের উপরে যৌন নির্যাতনের মামলা একই আদালতে চলতে থাকে আর বছরের পর বছর ঝুলে থাকে।
ধর্ষকের শাস্তির বিধান
এই বিতর্কও রয়েছে যে শিশুদের ধর্ষক বা নির্যাতনকারীদের কতটা শাস্তি দেওয়া হবে, তা নিয়ে। কেউ মনে করেন তাদের মৃত্যুদণ্ডই দেওয়া উচিত।
কিন্তু এই প্রশ্নও রয়েছে যে দিল্লির বাসে গণ-ধর্ষিতা ও খুন হওয়া নির্ভয়ার ধর্ষকদেরও তো চরম শাস্তি দিয়েছে আদালত - তারপরেও কি ধর্ষণ কমেছে?
নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ বলছিলেন, আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী নই। যদি ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়, তাহলে ফাঁসি হওয়াই উচিত। তবে তখন ধর্ষক ভাববে, মেয়েটিকে বাঁচিয়ে রাখলে তাকে তো ফাঁসিতে ঝুলতেই হবে। সেই আশঙ্কা থেকেই হোক আর যা-ই হোক না কেন, ভারতে অনেক কন্যা-শিশুর সঙ্গে বাস্তবিকই সেটাই ঘটছে। ধর্ষণের পরে তাকে হত্যা করা হচ্ছে যাতে কোনো প্রমাণ না থাকে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা