পতিতা প্রথা: অবক্ষয় টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার
প্রকাশ : ২৯ জুন ২০১৭, ২২:২৭
অনেকেই ভেবে থাকেন, পতিতালয় নির্মাণ করা অথবা পতিতালয়ের সংখ্যা বাড়ানোর মাধ্যমে আমাদের সমাজে ধর্ষণ, ইভ টিজিং সহ নারীর প্রতি অন্যান্য যৌন হয়রানি কমে যাবে। কামুক পুরুষেরা তাদের কাম যথাযথ জায়গায় গিয়ে মিটিয়ে নিলেই একটা সুস্থ স্বাভাবিক সুন্দর সমাজ আমরা পেয়ে যেতে পারি। তাছাড়া যারা এই পেশায় নাই, তাদেরকে রাস্তায় 'রেট কত' টাইপের অবাঞ্ছিত কথা শুনে বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে না।
প্রথমে বলে নেই, কোন মেয়ে স্বেচ্ছায় পতিতাবৃত্তিতে যায় না, কোন বাবা মা-ই তাদের সন্তানকে বড় করে এই পেশায় কাজ করুক চায় না, এই পেশায় রাতারাতি অল্প সময়ে বিশাল টাকার পাহাড় বানানো যায়- এটা এই পেশায় লেলিয়ে দেওয়ার জন্য মিথ্যা আস্ফালন বাণী। যদি টাকার পাহাড় গড়া যেতো তবে, পতিতালয় ভেঙ্গে দিলে তারা রাস্তায় রাস্তায় ঘরবাড়ি বিহীন ঘুরে বেড়াতো না। এতো বেশি টাকার পাহাড় হলে বাবা মা সন্তানদের পড়ালেখা না শিখিয়ে কামসূত্র আর পতিতাবৃত্তি শিক্ষা দিত।
কামুক পুরুষেরা যারা সাধারণত পতিতালয়ে যায়, তারা কিন্তু সবাই অবিবাহিত অথবা সঙ্গীবিহীন জীবনযাপন করে না। অবিবাহিতদের চেয়ে বিবাহিতদের সংখ্যাই বেশি। তারা কেন যাচ্ছে? তাদের সবারই ঘরে কাম নিবারণের জন্য সঙ্গী থাকার পরও যাচ্ছে। কারণ টাকার বিনিময়ে নিরাপদ জায়গায় নিরাপত্তার সাথে ভিন্ন নারীর সঙ্গ পাওয়া যাচ্ছে। এটা শুধু কাম নিবারণ বললে ভুল হবে, কাম নিবারণ তো মাস্টারবেশন করলেও হয়ে যায়। এর সাথে পুরোপুরিভাবে সম্পৃক্ত বিষয় হলো নারীকে আস্ত যৌন-সামগ্রী ভাবার রীতি।
কাম নারীর নেই? আছে। কিন্তু নারী কখনো পুরুষকে আস্ত একটা যৌন সামগ্রী ভাবে না। যৌনতার বস্তুর বাইরে পুরুষ নিজেদের বের করে নিয়ে এসেছে ঠিকই, পক্ষান্তরে নারীকে বিভিন্ন উপায়ে যৌন-বস্তু বানিয়ে রাখার সব রকমের কৌশল ব্যবহার করে রেখেছে।
মূল সমস্যাটা এখানে, ভাবনার গঠনে।
কোন ভাই কোন বাবাই যেমন চান না তার বোন তার মেয়ে এই পরিচয়ে পরিচিত হোক। তেমনি কোন মেয়েই চায় না তারা এই এই নামে অভিষিক্ত হোক। অন্যদিকে কারোর না কারোর বোন মেয়ে এই পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছে। শুধু পার্থক্য হল সমাজ তার বাবা ভাইয়ের জন্ম-পরিচয়টা অস্বীকার করে তাদের জন্য আলাদা বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে। সেখানে অন্য কোন মেয়ের বাবা ভাইরা নিয়মিত যাতায়াত করছে। এই মেয়ের বাবা ভাইও যাচ্ছে, অন্য কোন পতিতার কাছে।
টাকা দিয়ে নারীর শরীর কেনা যায় এই ভাবনাটা মানুষকে মানুষ না ভেবে পশুর স্তরে নামিয়ে নিয়ে আসে। খুব বেশি টাকায় আস্ত গরু পাওয়া যায়, কম টাকায় কেজি দরে গরুর মাংস পাওয়া যায়। গরুকে হালচাষ থেকেও মাংসের আধার হিসেবেই বিবেচনা করা হয় বেশি। তেমনি নারীকে কম অথবা বেশি টাকায় রেট বিবেচনা করে পাওয়া গেলে যতই পতিতালয়ের সংখ্যা বাড়ানো হোক না কেন, দিনশেষে নারী কিন্তু যৌনতা নিবারণের সামগ্রী ছাড়া আর কিছু নয়।
নারীকে টাকা দিয়ে কিনতে পাওয়া সস্তা যৌন সামগ্রী ভাবার প্রধান ইফেক্ট হলো, পুরুষেরা নিজের স্বজন নারীদেরকেও এমন সস্তা ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। এটা এক ধরনের মূল্যবোধের অবক্ষয়। অবক্ষয় এই সেন্সে--আপনার ঘরের ছেলেটি কারোর খপ্পরে পরে পাঁচশো টাকায় বিক্রি হতে পারে এটা আপনি ভাবতে পারেন না বা ভাবেনও না। যখনই ভাববেন তখনই অবক্ষয়ের শুরু। নারীকে যৌন বস্তু হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত রাখার প্রধান অবলম্বন হলো পতিতাবৃত্তি টিকিয়ে রাখা। পতিতা-প্রথা হলো এই অবক্ষয় টিকিয়ে রাখার প্রধান ও প্রথম হাতিয়ার। যার দরুণ নারীকে মানুষ হিসেবে সসম্মানে মূল্যায়ন আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
হাজারো অজুহাত দিয়ে পতিতালয় স্থাপন বাড়ালে, ঘরে ঘরে পতিতালয় গড়ে তুলেও আমার আপনার মা বোন মেয়েকে পুরুষের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন না, যতদিন না নারীর শরীর আপনার কাছে পয়সায় বিক্রি বন্ধ হচ্ছে। মানে যতদিন না আপনি কেজি দরে নারীর শরীর কেনার ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলছেন।
লেখক: প্রবাসী লেখক