বৈশাখী ভাবনা
প্রকাশ : ১২ এপ্রিল ২০১৭, ২০:২৭
বৈশাখ এসেই গেলো দ্বারে। কত অপেক্ষা সারা বছর জুড়ে! বুঝি না বেহিসাবি মনটা কেন যেন হিসাবি হতে শুরু করে এই সময়। না চাইলেও যেন মনে এবং মগজে হিসাব-নিকাশ চলে চাওয়া পাওয়ার। ভাবনাগুলি খেলা করে আপন মনে নিজের অজান্তেই। আশা এবং আশংকা দুইটাই কাজ করে জানতে কিইবা অপেক্ষা করছে আগামীর দিনগুলিতে। এতকিছুর মাঝে মাথায় যে জিনিষটা মাথায় ঘুরে, তা হল বৈশাখী মেলা। মেলা ছাড়া বৈশাখ মাস কি কেউ ভাবতে পারে? বৈশাখ মাসের প্রচণ্ড গরম, ধুলাবালি, ঝড় কিংবা বৃষ্টি সব কিছু ভুলে গিয়েই আমরা প্রাণের উৎসবে মেতে উঠি। চোখে পড়ে শুধু চারিদিকের সাজ-সাজ রব। সাদা-লালে সেজে উঠা সবার মাঝে কি যে এক ভালবাসা আর ভাললাগার বন্ধন!
বৈশাখী মেলা! এটা ভাবতেই মনে আসে সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর রুটিন। মেলায় ঘুরতে কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিবার প্রস্তুতি কিন্তু চলতে থাকে সারা চৈত্র মাস জুড়েই। সবারই নতুন ডিজাইনের পাঞ্জাবী, জামা কিংবা শাড়ি চাই। গতবারের শাড়িটা কিংবা পাঞ্জাবীটা এবছর পড়া যাবে না, তাই নতুন একটা শাড়ি বা পাঞ্জাবী চাই। এই ব্যাপারটা ছড়িয়ে গেছে আজ সমাজের সর্বস্তরে। গত ক’বছরে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে একটা ব্যাপার। আমার স্কুলে যাওয়ার পথে বেশ কিছু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি চোখে পড়ে। বৈশাখ এখন এদের জীবনেও আনন্দ হিসেবে জুড়ে গেছে। পহেলা বৈশাখে কিন্তু এইসব শ্রমজীবী নারী-পুরুষেরা ছুটি পান না। কিন্তু আমি খুব অবাক আর খুশি হয়ে দেখি, তারা সবাই লাল-সাদা জামা কিংবা শাড়িতে সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেদের রাঙিয়েছেন। লাল-সাদা সাজে সেই দিনটা তারা ফ্যাক্টরিতে ঢুকছেন, খুশি মনে সারাদিন কাজ করে আবার বৈশাখের সন্ধ্যায় বাসার ফিরছেন। যেন বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়ানো শিউলি ফুলেরা হেঁটে বেড়ায় সেদিন! আমার মুগ্ধ দৃষ্টি সরে না তাদের থেকে।
আর সাধারণ আমরা তো নিজেরাই নানান অনুষ্ঠান সাজিয়ে ফেলি বরাবর। সেদিন কোথায় কোথায় যাব, কি কি কিনব, কি কি খাব, ইত্যাদি ভাবনার যেন শেষ নেই। মাথায় ঘুরতেই থাকে, শাড়ি কেনা হল? শাড়ি হলে তার সাথে ম্যাচিং করে ব্লাউজ, চুড়ি, টিপ, কানের দুল, নাকফুল, নোলক কিংবা নথ কত কি যে লাগে মেয়েদের! আর কি বাদ পড়ে গেলো কাঁচা ফুল? চুলে ফুল না দিয়ে কি বৈশাখী মেলায় যাওয়া যাবে? তাই সর্বশ্রেণির মাঝে কেনাকাটা শুরু হয়ে যায়। দিন বদলের গান গাইতে গাইতে আজ সত্যি সত্যি বদলে যাচ্ছে দিন। বৈশাখী মেলা জুড়ে দিচ্ছে প্রাণের সাথে প্রাণের বাঁধন, ভালবাসায় মুখরিত হচ্ছে চারপাশ। সকল অশুভ আর অমঙ্গল ভেসে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে।
পহেলা বৈশাখ আর এটা ঘিরে যে আনন্দ উৎসব তাতো হঠাৎ করে গজিয়ে উঠা কোন অনুষ্ঠান নয়। হাজার বছরের নিজস্ব ইতিহাস আর ঐতিহ্য আছে এর। সেই প্রাচীনকাল থেকেই উৎসবমুখী এই দিনটিকে ধরা হয় শুভ দিন হিসাবে। একসময় এটা ছিল বাঙালির সার্বজনীন লোকউৎসব। এর সাথে জড়িত ছিল কৃষিকাজ ও অর্থনৈতিক দেনা-পাওনার হিসাব-নিকাশ। এই দেনাপাওনার হিসাব যেখানে করা হত তাকে হালখাতা বলে। ব্যবসায়ীরা আর ভূস্বামীরা পুরানা দেনার খাতা বন্ধ করে নতুন খাতা খুলতেন আর দিনটিতে সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করতেন। গ্রামের মাঠে কিংবা বাজারগুলোতে বসত দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা। মেলায় অংশগ্রহণ করতে আসতেন দূর-দূরান্ত থেকে বহু ছোট বড় ব্যবসায়ীরা। গ্রামজুড়ে নানান রকম খাবার আর পিঠা-পুলি বানানোর ধুম পড়ে যেত। ঘরে ঘরে পায়েস, মিষ্টি কিংবা উপহার পাঠিয়ে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময় হত। সেই প্রথাই এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশ জুড়ে, পরিণত হয়েছে সাধারণের প্রাণের উৎসব হিসাবে।
কিন্তু কিছু মানুষ নামের নরপশু এতসব আনন্দের মাঝে তাদের কুৎসিত থাবা বসাতে ব্যতিব্যস্ত। ভীষণ বিষাক্ত আর কুৎসিত মনের এই মানুষ-পশুগুলি নির্মল আনন্দের মাঝে নোংরামি, ভয় আর হিংস্রতা ছড়াতে যেন বদ্ধ পরিকর। কিছু মানুষ নামের সুশীল-অমানুষদের চুলকানিও বেড়েছে এই মেলা ঘিরে। মেলার নাম শুনলেই সেইসব অমানুষরা নিজেদের বিশেষ অঙ্গের চুলকানি থামাতে পারে না। তাদের বিশেষ স্থানটি, মেলার নাম শুনলেই শক্ত হয়ে যায়। কারো কারো চোখের সামনে মনে হয় বাটি ভর্তি তেঁতুলের নাচ শুরু হয়ে যায়। লালা ঝরে ঝরে পড়ে আর ভাবে, ক্যামনে বাগে আনা যায় এতসব যৌবনবতী বেশরম, বেলাজ, উশৃঙ্খল, আর বখে যাওয়া মেয়েগুলারে। কেন এইগুলি বেপর্দা মেলায় ঘুরে? এইগুলিরে টিপা-চিপা দিয়া ভয় দেখালেই ঘরে ফেরত পাঠানো যাবে। ব্যাস, তাদের বিকৃত মনের পরিকল্পনা শুরু। শাড়ি ধরে টান দে, জামা ধরে টান দে, ওড়না ধরে টান দে, গায়ে হাত দে, জোরাজুরি কর, চান্স পাইলে রেইপ কর। এই ভয়ে বেকুব মাইয়াগুলা আবার সুড়সুড় করে ঘরে ঢুকে যাবে, বাইর হবার নাম ভুলেও নিবে না।
কিন্তু, তেঁতুল হুজুরদের জানায় কিছু ভুল আছে। যেই মাইয়াগুলান ঘর নামের খোঁয়াড় থেকে আঁচল উড়িয়ে বের হয়ে এসে খোলা বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিয়েছে সেইগুলানরে আর কিছুতেই খোঁয়াড়ে ফেরত পাঠান সম্ভব না। তার চেয়ে বরং ফ্রি কিছু টিপস রইল তেনাদের জন্য। বরং তসবি জপেন আপনেরা, আর গজবের জন্য অপেক্ষা করেন- যেইগুলা মাইয়াগো লাগি হয়। আর তেঁতুল তেঁতুল সুইট মেয়েরা, তোমাদের বলছি, যেমন খুশি তেমন সাজো, মাথায় ফুল গুঁজো, শুধু বাসা থেকে বের হবার সময় হাতে বড় বড় সাইজের সেফটিপিন খুলে রাখো দুইটা করে। ব্যাগে নাও সবচেয়ে ঝাল-লাল মরিচ মিক্স ওয়াটার স্প্রের বোতল। চাইলে বড় সাইজের নেইল কাটার ও রাখো কোমরে ঝুলিয়ে চাবির গোছার মত। কিছু ঘটে গেলেই উদাসিন প্রশাসনের ক্ষমতাবানরা তোমাদের কাপড়ে, চলায়, বলায় দোষ খুঁজে পাবে। অতএব, সময় থাকতে সাধু সাবধান। নিজের রক্ষার দায়িত্ব তোমার নিজের। লুতুলুতু আর পুতুপুতু করে, নরম শরম ভাব নিয়ে চলাফেরা করার দিন শেষ। গায়ে হাত দিবার অপেক্ষায় থাকো শংকা ভুলে। যখনি কুৎসিত হাত খানি আগাবে তোমার দিকে, সেই মূহুর্তেই জানোয়ারের বিশেষ অঙ্গে ডবল সেফটিপিন ঢুকিয়ে দাও মহা আনন্দে। আর চোখে ছুঁড়ে মারো মরিচের পানি। তাদের নৃত্য আর আকাশ কাঁপিয়ে করা চিৎকারের সাথে তুমিও গলা ছেড়ে গান ধরো,
“মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা
রসের আবেশ রাশি
শুষ্ক করি দাও আসি
আনো আনো, আনো তব প্রলয়ের শাখ
মায়ার কুঁজঝটি জাল যাক, দূরে, যাক যাক যাক
এসো এসো...
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো”
লেখক: শিক্ষক