সেই রক্তাক্ত ৬ মার্চ, আমরা কি ভুলে গেছি?
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০১৭, ১২:২২
দিনটি ছিল ৬ মার্চ ১৯৯৯। যশোর টাউন হল মাঠে 'আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে' স্লোগানটিকে প্রতিপাদ্য করে চলছিল উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলন। ৪,৫,৬ মার্চ তিনদিন ব্যাপি হাসি, গান, আনন্দ, সাংগঠনিক তৎপরতার পর শেষদিন ঢাকা ও অন্যান্য দূরদূরান্তের জেলার শিল্পী কর্মীদের বিদায় দেবার পর মাঠভর্তি সহস্রাধিক মানুষ আরাম করে লোকজ গান শুনছিলেন। রাত প্রায় ১২:৪৫। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম বোমা হামলা। একসাথে এত হতাহত মানুষ, এত চিৎকার, গোঙ্গানি, এতো রক্ত, মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাত, পা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ- বাংলার মানুষ কোনদিন দেখেনি। ভুলবেও না কোনদিন। এই জঘন্যতম হত্যাকান্ডের মাধ্যমে মৌলবাদীরা তাদের পেশীশক্তির জোর দেখাতে শুরু করলো।
স্তব্ধ যশোরবাসী শোক বিহ্বল থাকতে পারলো না। আহতের আহাজারির সাথে স্বজনের মাতম আর বাঁচানোর চেষ্টা। বাহন যোগাড় করা, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, রক্ত যোগাড়, চলতে থাকে ছোটাছুটি। মোবাইল ফোনের যুগ নয়, তাই পথে থাকা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ খবর পান না। ভোরে ঘরে ঢোকা মাত্রই বজ্রাহতের মত শোনেন স্বজন হারানোর এই অবিশ্বাস্য দুঃসংবাদ! কয়েক ঘন্টা আগে যারা হাসি মুখে বিদায় দিলো তারা ক্ষত বিক্ষত নিথর! শুরু হয় আবার ছুটা। প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ, হেলিকপ্টার যোগাড়। যশোর ফিরে যাওয়া তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় খুলনা ও ঢাকায় আহতদের স্থানান্তর। ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করানো, বিনা খরচে চিকিৎসা চালানো। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহ করে জার্মানি থেকে নকল পা আনিয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সেগুলো পা কাটা পড়া আহতদের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। উদীচী সেদিন দেখেনি কে তার কর্মী, কে নয়। সকলকে সমানভাবে চিকিৎসা দানের ব্যবস্থা করেছে।
প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে প্রায় মাসাধিক কাল অতিবাহিত হয়ে যায়, উদীচী আইনের আশ্রয় নেয়ার, মামলা করার কথা ভুলেই যায়। পরে রাষ্ট্র বাদী হয়ে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা যশোরের তরিকুল ইসলামকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করে। শুরুতেই সরকার তাদের রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য দুর্বল মামলা সাজায়। তাই বিচারের তেমন অগ্রগতি হয় না। পরে জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতায় এলে এক সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন। যা বিচারপতি নবী কমিশন নামে পরিচিত। নবী কমিশন তরিকুল ইসলামকে খালাস দিয়ে উদীচীর নেতৃবৃন্দকে অভিযুক্ত করে রিপোর্ট দেয়। উদীচী সে রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে। পরে মুফতি হান্নান এ বোমা হামলার দায় স্বীকার করে। কিন্তু তড়িঘড়ি তার শাস্তি দেয়ায় মূল হোতাদের নাম অন্ধকারেই থেকে যায়। সেই যে নবী কমিশনে মামলার খাতা বন্ধ হলো, আজ পর্যন্ত সেই মামলার কোন অগ্রগতিই ঘটেনি। প্রতি বছর উদীচী মামলার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে, আশ্বাস পায়, কিন্তু কাজ হয় না।
এই বিচারহীনতার ফলেই রতন, বুলু, রামকৃষ্ণ, সন্ধ্যার মৃত্যু মিছিল আরো দীর্ঘ করে সিপিবির পল্টন বোমা হামলার শহিদরা, রমনা বটমূলে নিহতরা, একুশে আগস্টের আইভি রহমান ও আরো অনেকে। প্রতিদিন বাড়ছে মৌলবাদের নতুন নতুন আস্ফালন। নতুন দল। প্রকাশ্যে সাহস প্রদর্শন। সংখ্যা বৃদ্ধি। শাস্তি না হওয়াতেই তারা সাহস পায় লেখক, শিল্পী, পুরোহিত, ফাদার প্রমুখের টার্গেট কিলিং এর।
সেদিন যদি সঠিক বিচার করে এদের সমূলে উৎপাটন করা যেতো তবে আর আজ হেফাজতের প্রেসক্রিপশনে পাঠ্যপুস্তক প্রণিত হয় না। শিশুদের শৈশব কাটতো না হিজাবের আড়ালে। খুন হতো না মুক্তচিন্তার মানুষ। এখনো সময় আছে, মৌলবাদের জুজুর ভয় থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে সংঘবদ্ধভাবে এই অপশক্তি নির্মূলের প্রতিজ্ঞা করি।
জয় হোক মানবতার।
জয় উদীচী।
লেখক: সহ-সাধারণ সম্পাদক, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ