জাকাত ও দান খয়রাত

প্রকাশ : ১২ জুন ২০১৬, ১৮:১৯

যারা মনে করেন জাকাত নামক দান খয়রাত করার কথা শুধু মাত্র ইসলাম ধর্মে বলা বা লেখা আছে, তাদের ধারনা ভুল। জাকাত একটি ইসলামিক টার্ম মাত্র। প্রতিটি ধর্মই বলে গেছে অন্যদের সাহায্য করার কথা। আমরা ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মের দান বিষয়ক বানীগুলো জানি না বলে বড় গলায় বলতে থাকি, ইসলাম দান বা জাকাতের কথা বলে গেছে। আর ইসলাম আসছে ১৪০০ বছর আগে পৃথিবীতে। তার আগে কি দান খয়রাত ছিলনা এই পৃথিবীতে? ইসলাম ধর্মটি পৌত্তলিক, প্যাগান, জরাষ্ঠ্রুবাদ আর আব্রাহামিক ধর্মের অনুসরণকারী মাত্র। সুতরাং ভাবার কোন কারণই নেই ইসলাম একমাত্র ধর্ম যেখানে জাকাত ও দান খয়রাতের কথা বলে গেছে আর অন্যরা বলেনি।

এবার আসি কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতার কথায়। জার্মানী, সুইজারল্যান্ড আর স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশগুলোতে কোন মুসলিম দান খয়রাতে করতে যান না। পুরোনো কাপড় চোপড়ও রেড ক্রসের বাক্সে ফেলে আসেন। খুব কাছের বন্ধু ছাড়া কাউকে পুরোনো ব্যবহৃত কাপড় চোপর বা জিনিষপত্র তারা দান করেন না; এমন কোন প্রতিষ্ঠানে দান করে আসেন, যেখান থেকে লোকজন নামে মাত্র সেই পোশাক বা জিনিষটি কিনে নিয়ে ব্যবহার করতে পারে। একটি দেশের জীবন ধারার মানের উপর নির্ভর করে দান-খয়রাত আর জাকাতের ব্যাপার গুলো। এই দেশগুলো গণতন্ত্রে বিশ্বাসের পাশাপাশি সোশ্যাল বা সমাজতন্ত্রের কিছু আদর্শ মেনে চলে। যেমন: যারা এখানে বাস করছে মানে তার এই দেশ গুলোতে বাস করার পার্মানেন্ট রেসিডেন্স পারমিট বা নাগরিকত্ব আছে, সেই লোকটি যদি কোন ভাবে কাজ করতে অক্ষম হয় তখন কি সে ভিক্ষা করবে? পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় যাবে? রাস্তায় ঘুমাবে? না, এই দেশ গুলো ভিক্ষার অনুমতি দেয় না, সঙ্গে দেয় না রাস্তায় বাসের অধিকার বা অনুমতি। এই দেশগুলোর সোশ্যাল সিস্টেম অনুযায়ী প্রতিটি মানুষের মাথার উপর ছাদ থাকতে হবে। যদি কোন ব্যাক্তি নিজের ছাদের ব্যবস্থা না করতে পারে তাহলে এখানকার সরকার বাধ্য থাকবে তার বা তাদের জন্য থাকার ব্যাবস্থা করার। 

এছাড়া যতদিন পর্যন্ত পরিবারের প্রধান অর্থ্যাৎ বাবা-মা চাকরী পাচ্ছে না ততদিন তাদের জন্য এবং তাদের সন্তানদের জন্য একটি মিনিমাম ভাতার ব্যবস্থা করা হয়। সেই সঙ্গে বাড়ি ভাড়াও দেন সরকার। ধরে নিলাম, কোন মহিলা গর্ভবতী হলো, তার জন্য রয়েছে আলাদা সুবিধা। সন্তান জন্মদানের বহুদিন পর্যন্ত মা চাকরী করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে এই দেশ গুলোতে সন্তানের খরচের জন্য সরকার একটি নির্দিষ্ট ভাতা দেন। সন্তান বয়স আঠারো বছর হওয়া পর্যন্ত সরকার এই ভাতা চালিয়ে যান। এতে একটি পরিবার সন্তান গ্রহণ করতে উৎসাহ পেয়ে থাবে। তাই সেই দরিদ্র পরিবারগুলো অন্যের দান-খয়রাত বা জাকাতের উপর নির্ভর করে বসে থাকে না। বা কোন বিশিষ্ট ধনী ব্যাক্তিকে দান করতে হয় না এই মানুষগুলোকে বাঁচাতে। এই দেশগুলোর প্রতিটি মানুষ যে উপার্জন করছে, তারা ট্যাক্স ফাঁকি দেয় না বরং নিয়মিত ট্যাক্স দিচ্ছে। আর সেই ট্যাক্সের অর্থ থেকে, এই সব কাজের জন্য অক্ষম মানুষদের পথে না বসিয়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাতা দেন এই দেশগুলোর সরকার। সঙ্গে যার যোগ্যতা অনুযায়ী একটি কাজও খুঁজে দেন যাতে পরিবারটির সদস্যদের মনে না হয় তারা অন্যের দয়ায় বেঁচে আছে। এমনকি পরিবারের সবার হেলথ ইন্সুরেন্সের ব্যবস্থা রাখছে যাতে অসুখে বিসুখে বিনা চিকিৎসায় কাউকে ভুগতে না হয়। কিন্তু তারপরও কিছু লোক আছে যারা ভিক্ষা করে, এমনকি এরা রাস্তায় ঘুমায়। বললে বিশ্বাস করবেন না, সরকার এদের প্রত্যেকের জন্য একটি বিছানা ও ঘরের ব্যবস্থা করছে, এমনকি এদের পিছনে ৩ জন ডাক্তার ও হেলথ ইন্সুরেন্সের ব্যবস্থা রেখেছে। এরা অ্যালকোহল কনজিউম করে বা অন্য কোন ভাবে নেশাগ্রস্থ মানুষ। এরা রাস্তায় থাকাকে নিজেদের অধিকার মনে করে এবং এরা পরিবার ও সমাজ থেকে পালানো মানুষ। কারো সঙ্গে এদের মেলে না। একসঙ্গে মদ খেয়ে আবার একে অন্যকে লাথি মারা মানুষ এরা। এখানকার সরকার বৎসরে দুবার এদের বিভিন্ন থেরাপিতে পাঠানোর চেষ্টা করে। তারা থেরাপি গ্রহণ করে আবার ফিরে এসে রাস্তায় বসে মদ খায় এবং আবারো রাস্তায় বসবাস করে।

আরো কিছু লোককে ইদানিং দেখা যায়, যারা রাস্তায় ভিক্ষা করছে। সাংবাদিকতা মানে পেশাগত কারনেই এসব লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। তাদের কাছ থেকে জানতে পারি, তাদের বাড়ি রোমানিয়া বা তার আশে পাশের দেশগুলোতে। এই দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা বর্তমানে যাচ্ছে তাই অবস্থা। কোটি কোটি মানুষ বেকার। রোমানিয়া থেকে অনেক মানুষকে কিছু অসৎ ব্যাবসায়ী চাকরীর কথা বলে জার্মানিতে বা ইউরোপের অন্যান্য দেশে নিয়ে আসে। পুরুষ এবং নারীদের দিয়ে এরা ভিক্ষা করায়, বা পকেটমার পেশায় নিযুক্ত করে আবার কখনো সরাসরি যৌনকর্মী হিসেবে নিয়োগ করে। ''ক'' নামের একজন যৌনকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, তার আসলে আর অন্য কোন উপায় নেই। সে যে পড়ালেখা করেছে, তা ইউরোপের অন্যান্য দেশ গুলোতে সার্টিফাইড বা স্বীকৃত নয়। তাই, অন্যের বাড়ির ময়লা পরিস্কার করার চেয়ে তার বা তাদের কাছে অর্থের বিনিময়ে অন্যের শরীর গ্রহণ করাকেই সহজ মনে হয়। আর এরা মৌসুমি কর্মী। ইউরোপের উন্নত দেশ থেকে কম সময়ে অধিক অর্থ উপার্জন করে দেশে ফিরতে চান, পরিবার পরিজনকে সাহায্য করতে চান। আর আমি এমন কোন মানুষ দেখিনি সে যে ধর্মেরই হোক না কেন; তাদের ব্যাবহার না করে শুধু দান-খয়রাত বা জাকাতের নামে এসব মানুষকে সাহায্য করে বলেছেন, যাও আমি তোমাকে এত টাকা দিলাম। তুমি দেশে গিয়ে একটা ব্যাবসা করো, এই পেশা তোমার জন্য না। আর ব্যাতিক্রম সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই আছে। একজন দুজন মানুষ কখনো উদাহরণ বা নির্দিষ্ট ধর্মের উদাহরণ হতে পারে না।

একটি দেশের যখন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক বেশি উচু ও নীচু তলার শ্রেনীভেদ তৈরী করে, তখনই তারা অন্যের অর্থের দিকে তাকায় এবং তারা দান-খয়রাত আর জাকাতের উপর নির্ভর করে। একটি দেশে যখন সরকার পুরো পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট ভাতার ব্যবস্থা করে দেবে অল্প কিছু কাজের বিনিময়ে তখন আর মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিতে নামবে না। তখন সেই আর্থিকভাবে অসহায় ব্যাক্তিটি আর তাকিয়ে থাকবে না পাশের বাড়ির ধনী ব্যাক্তি বা আত্মীয়ের দিকে সাহায্যের আশায়। সে জানে তার বিপদে দেশের সরকারই তার পাশে দাঁড়াবে। 

আর জাকাত - দান খয়রাতকে যত ভালই বলি না কেন, আর সেটা যে ধর্মের আওতাধীনই হোক না কেন তা শুধু মানুষে মানুষে ব্যাবধান বাড়ায় আর ভিক্ষাবৃত্তিকেই উৎসাহ দেয়। হ্যাঁ, পৃথিবীর সবাই ক্যাপিটালিজমেই বিশ্বাস করে, সে জন্যই মার্কসের বা মাওদের সমাজতন্ত্র টেকেনি। কিন্তু একবার ভাবুন, এই কাফের দেশগুলো কিন্তু সমাজতন্ত্র আর ধর্মের সেই ভাল দিক গুলো নিয়ে কাজ করে নিজেদের দেশের নাগরিকদের অর্থনৈতিক সামঞ্জস্যতা দিচ্ছে; যেখানে অন্যের জাকাতের উপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে না কাউকেই। আমাদের দেশের সেই পরিবর্তনের আশা কি আমরা করতে পারি না? হ্যাঁ, বহুদূর যেতে হবে, বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। তবেই সম্ভব এই জাকাত আর দান খয়রাত নামের ভিক্ষাবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেয়া প্রথা বন্ধ করা। যতদিন মানুষের মাঝে এই সামঞ্জস্যতা আসবে না ততদিন তা চলতেই থাকবে। আর সেই সঙ্গে এক শ্রেণী অহংকার করতেই থাকবে এত টাকা দান করেছি। আর অন্যদিকে একদল মানুষ সারা জীবন ধরে শোষিত হতেই থাকবে।

লেখক: প্রবাসী বাঙালি ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত