সুশান্ত পাল এবং সমাজের হাল!

প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০১৬, ০০:০৬

আজ বিসিএসে প্রথম হওয়া এবং তথাকথিত মেধাবী মুখ বলে পরিচিত সুশান্ত পালের নারী বিষয়ক কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হয়েছে। এরপর থেকে সোশ্যাল মিডিয়া সহ নানান মিডিয়ায় মুখরোচক খবর জুগিয়ে যাচ্ছে এই বিষয়টি। চলছে বিসিএস পরীক্ষা এবং ‘মানুষের মতো মানুষ’ হবার নতুন সংজ্ঞা দেওয়া। 

এই যে সুশান্তরা বিসিএস ফার্স্ট হয় কিন্তু নারীদের প্রতি এরকম মনোভাব নিজের ভেতরে পুষে রাখে, এসব কিছু নিয়ে আমরা চুপ করে থাকি। কেন? কারণ আমাদের শিক্ষা কাঠামোতে লৈঙ্গিক সমতাটা যে সেভাবে আসছে না, ফলে একাডেমিক মেধাবী কিংবা বিসিএস ক্যাডার হওয়া ছেলেরাও নারীদের সম্মান করতে জানে না। যে শিশুটি ‘নারী পুরুষ সমান’ বলে ঠিকই মুখস্ত করে, কিন্তু ছেলেবেলায় পড়ানো সামাজিক শিক্ষা বইয়ে বা ইংরেজি বাংলা বইয়ে মেয়েদের কাজ ঘর ঝাড়ু দেয়া, বাচ্চা মানুষ করা, বাবা অফিসে যায়, মা রান্না করে ইত্যাদি পড়া পড়ে আসে তার চিন্তাটা কেমন হয়?

মেয়ে মানেই ঘরে আটকে থাকা, সেলাই ফোঁড়াই আর প্রতিভার বশে সুকণ্ঠে গান গাওয়া, সেইসাথে নামেমাত্র শিক্ষিত হয়ে অন্যের ঘরকে আপন ঘর বলে মেনে নেওয়া- এই ধারণাটাই কি একদম শিশু বয়স থেকে একটি মানবশিশুর মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়না? 

আমি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। একদিন আগে এখানে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। সেটা হচ্ছে কয়েকজন মেয়ে সিনিয়র আপুদের গালিগালাজ করবার জন্য একটা গ্রুপ চ্যাট খুলেছিল ফেসবুক নামের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটিতে। ঘটনাচক্রে সেটি প্রকাশিত হয়ে পড়েছে এবং একজন কনিষ্ঠ শিক্ষার্থী হিসেবে আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। কারণ এই গালাগালিগুলো নিছক কারণ ছাড়াই, শুধুমাত্র বড়দের খবরদারি বা শাসন সহ্য হচ্ছেনা বলে করা। সমস্যা হচ্ছে গালির শব্দগুলি, শব্দগুলি দিয়ে বোঝা যাচ্ছে মেয়েরা ঠিক নিজেদেরকেই বা কি ভাবে, নিজেদেরকে ঠিক কি ভেবে সমাজে বড় হয়। শব্দগুলি যৌন হয়রানিকর বলে সেগুলি আর উল্লেখ করছি না। তবে এটুকু বলতে পারি, শব্দগুলি এতোই অবমাননাকর যে সেই বিষয়ে আইসিটি আইনে মানহানির মামলা পর্যন্ত নির্দ্বিধায় করা যাবে। পুরুষের বৈষম্যের কথা ছেড়েই দিচ্ছি- আমি শিউড়ে উঠেছি এটা দেখে, যে সমাজের মেয়েদের প্রতিই মেয়েদের সম্মানের জায়গা ঠিক কতোটা? দেশের টাকাগুলি খরচ করে ঠিক কতজন মানুষ হচ্ছে আর কতজন শিক্ষিত নাম্নী অমানুষ হচ্ছে? 

বিসিএস কোনো আইকিউ বা বুদ্ধির পরিমাণ নির্ণয়ের পরীক্ষা না। একটা সময় পর্যন্ত বিসিএস শুধুই একটা মুখস্তবিদ্যা এবং স্মৃতিশক্তিনির্ভর পরীক্ষা ছিল। এখন একটু রূপটা বদলেছে। সেখানে নৈতিকতা বিষয়েও কিছু প্রশ্ন থাকে! আমি জানিনা সুশান্ত পালের বিসিএস পরীক্ষাতেও সেটা ছিল কিনা! কাজেই কে সেখানে প্রথম হলো এবং মহান হয়ে গেলো তা খুব গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হলো সে কতটা মানুষ হলো। তাই সুশান্ত পালের নারী বিষয়ক নোংরামির কথা বলে বিসিএসকে উচ্চে তোলা বা মাটির নীচে পুঁতে ফেলার কিচ্ছুই নেই। 

নিজেকে সবসময় বলা দরকার- জীবনের যুদ্ধটা অনেক বড়। ভর্তিযুদ্ধ বা চাকরিযুদ্ধে জয়ী হয়ে খুব ভালো একজন শ্রমিক তুমি হতেই পারো। কিন্তু জীবনযুদ্ধে টিকে থেকে খুব ভালো মানুষ হতে পারবে তো? 
নিজেকে সবসময় মনে করিয়ে দেওয়া দরকার-
আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে,
সকল অহংকার হে আমার, ডুবাও চোখের জলে!

যে শিক্ষা প্রকৃতিকে ধন্যবাদ দিতে শেখায় না, মানব জীবন কত বিচিত্র চমকপ্রদ হতে পারে- তা ভাবতে শেখায় না, শুধুমাত্র তথাকথিত শিক্ষিত করে গড়ে তোলে একজন শ্রমসর্বস্ব মেধাহীন স্বার্থপর শ্রমিক, সেই শিক্ষা নিয়ে ভাবার মতন সময় নির্দ্বিধায় এসেছে। 

যে শিক্ষা সমতার পাঠ দিয়ে বলতে শেখায় না- ঐযে ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা, উনিও তো মেয়ে। রাশিয়ার মেয়ে। মেয়ে হয়েই মহাকাশে গিয়েছিলেন। মেরি কুরীর নাম তো সবাই জানে, যিনি তেজস্ক্রিয় মৌল ইউরেনিয়াম আর পোলেনিয়াম আবিস্কার করেছিলেন। পোলেনিয়াম নামটি এসেছিল তাঁর দেশ পোল্যান্ডের নাম থেকে। তিনিও নাম উজ্জ্বল করেছিলেন দেশের। তাঁর সম্মানে আরেকটি তেজস্ক্রিয় মৌলের নাম রাখা হয়েছিল কুরিয়াম। এই ইউরেনিয়ামের কারণেই নিজের ফুসফুসটি ক্ষতিগ্রস্ত করে বাতি জ্বালিয়েছিলেন বিজ্ঞানের, প্রগতির। 

আর হাইপেশিয়া! আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর শেষ গবেষক, তিনি তো এতই বিদুষী নারী ছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর পরের একহাজার বছরকে বলা হয় বিজ্ঞানের ইতিহাসের অন্ধকার যুগ। হাইপেশিয়ার প্রেমে তো সমগ্র বিজ্ঞান আর দর্শনরাজ্য বিভোর থাকতো। কয়েক বছর আগে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’ চাঁদের মানচিত্রের একটা অংশের নাম দিয়েছে- হাইপেশিয়া! 

এই শিক্ষা আর শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। যেন সুশান্ত পালের মতন নারীকে সম্মান না দিতে শেখা বিষবৃক্ষ তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ ট্যাগটি নিয়ে সমাজের মাথায় নারী অবমাননার ছড়িটির দড়ি ঘুরাতে না পারে। 

কারণ শ্রমিক হওয়া, জীবিকা উপার্জনে সক্ষম হওয়া আর শিক্ষিত হওয়া এক নয়! জীবনের প্রথম লক্ষ্য মানুষ হওয়া!  

লেখক: তরুণ লেখক ও সাহিত্যিক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত