সমকামীতা মানেই কি অসুস্থতা?
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০১৮, ২৩:৪১
শুরুতেই ডিসক্লেইমার দিয়ে রাখা ভালো। যা দিনকাল চলছে!! কে কখন কোথা থেকে কোন তকমা লাগিয়ে দেবে, জানা তো নেই !! সেকু, মাকু, চীনের দালাল সহ নোংরা নারীবাদী, পুরুষবিদ্ধেষী, 'খ' বর্গীয়, 'ম' বর্গীয় তকমাগুলো প্রায়শই কপালে জুটছে। দুর্ভাগ্যক্রমে নামটাও সুমনা রহমান চৌধূরী, তাই পাকিস্তান যাওয়ার হুমকিও অনেকবার পেয়ে গেছি । সুতরাং ডিসক্লেমার দিয়ে রাখা ভালো।
ডিসক্লেইমার : ক) আমি একজন মানুষ। আপনাদের ভাষায় 'মেয়েমানুষ'। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই আমি বিপরীত লিঙ্গ মানে পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট হই। সোজা কথায় Straight । কিন্তু তাই বলে আমার কোনো বন্ধু বা সহনাগরিক যদি সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়, সেটাকেও খুব স্বাভাবিক ভাবে দেখি। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম হিসাবেই দেখি। নারী-পুরুষ, লেসবিয়ান, গে, ট্রান্সজেন্ডার, ধর্ম, ভালোলাগা, প্রেম, কাম, যৌনতা এগুলোকে ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট হিসেবেই বয়ে চলি, এর জন্যে আলাদা করে কোনো গর্ব বা বিদ্বেষ অনুভব হয় না।
খ) আরেকটা জরুরী বিষয় হলো সমকামীদের অধিকার নিয়ে কথা বললেই অথবা কাজ করলেই যে নিজেকে সমকামী হতে হবে তা কিন্তু নয়। বরং একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তার পাশে থাকাকে আমি মনুষ্যত্ব বলে বিবেচনা করি। এবং বিষমকামী ব্যক্তিও সমকামী আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে, ঠিক যেরকম সাদা চামড়ার মানুষ কালো চামড়ার অধিকার আদায়ে ভূমিকা নেয়, অথবা জমিদারের ছেলে কৃষক আন্দোলনে!
তাহলে শুরু করা যাক। আসলে এই কথাগুলো ঠিক লেখার ভাবনা থেকে লেখা নয়। এই কথাগুলো ক্লাসে স্টুডেন্টদের বলেছিলাম তাদের এডোলেসেন্স (Adolecense) পিরিয়ড বুঝানোর সময়। এডুকেশন সাইকোলজি অনুসারে এডোলেসেন্স পিরিয়ডে একটা ছেলে শিশু বা মেয়ে শিশু তার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এবং এটা এই পিরিয়ডের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাদের এই কনসেপ্ট দেওয়ার সময় আমি তাদের বলেছিলাম, আরেকটা কথাও শুনে রাখ যেটা বইয়ে লেখা নেই তোমাদের, এই পিরিয়ডে শুধু যে বিপরীত লিঙ্গের প্রতিই আকৃষ্ট হবে কেউ, তা কিন্তু সবসময় নাও হতে পারে। কেউ কেউ সমলিঙ্গের প্রতিও আকৃষ্ট হতে পারে। এবং এটা খুব স্বাভাবিকও। প্রয়োজনীয় নয় তুমি ছেলে হলে তোমার মেয়ের প্রতিই আকৃষ্ট হতেই হবে! তুমি ছেলে হওয়া সত্ত্বেও তোমার যদি কোনো ছেলেকে ভালো লাগে, সেটাও খুব স্বাভাবিক। একই কথা মেয়েদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সমকাম বা সম লিঙ্গের প্রতি প্রেম তাই খুব স্বাভাবিক।
সমস্ত ক্লাসে দেখলাম অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল। এবং স্টুডেন্টদের মুখ লজ্জায় নামানো। যেন আমি অদ্ভুত অশ্লীল কোনো কথা বলে ফেলেছি। তাদের লজ্জা কাটানো হোক বা বিষয়টা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দেওয়ার উদ্দেশ্যে হোক, তাদের জিজ্ঞেস করলাম তারা সমকামী বলতে কি বুঝে? তাদের উত্তরগুলো শুনে আমার মনে হলো, এই বিষয়ে খোলামেলা কথা বলার বোধহয় এখনই প্রকৃত সময়। শুধু স্টুডেন্টদের জন্যে নয়, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্যেও।
সমকামী শব্দটা বলতেই সমাজের বেশীরভাগ মানুষ ভয়ঙ্কর রকমের বিব্রত বোধ করেন। তাদের মতে সমকামিরা হচ্ছে নোংরা স্বভাবের, কুরুচিপূর্ণ এবং মানসিক বিকারগ্রস্ত, যৌন বিকারগ্রস্ত। সমকামী সম্পর্কে শুধু শরীর প্রয়োজনীয়। সমকামী ছেলে/মেয়েরা পার্টনারকে নিয়ে বেডরুমেই পড়ে থাকে! এর বাইরে এই সম্পর্কে আর কোনো ইমোশন কাজ করে না। এতো গেল সাধারন মানুষের কথা। সমাজের উচ্চশিক্ষিত, প্রগতিশীল, আধুনিক, মানুষরাও খুব কমই ব্যাপারটিকে মন থেকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নিতে পারে। মুখে না বললেও ভিতরে ভিতরে ঠিকই মনে করে সমকামীরা হচ্ছে গা ঘিনঘিনে কৃমিকৃতি এঁদো জীব। এরা মরলেই সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতি, কৃষ্টি রক্ষা পাবে।
যাইহোক বিষয়টিকে ব্যখ্যা করা শুরু খানিকটা এভাবে -
জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১ ধারায় সকল মানুষ স্বাধীন এবং সমমর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে বলে ঘোষনা করা হয়েছে, সেহেতু লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার সহ সব মানুষ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী জীবনের অধিকার; ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার; স্বেচ্ছাচারী আটক, গ্রেফতার ও নির্যাতিত না হওয়ার অধিকার; মত প্রকাশ, সংগঠন করা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারসহ একজন মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সহজাত সকল অধিকার পূর্ণরূপে উপভোগ করার অধিকারী।
১৭ জুন ২০১১ ইং তারিখে সমকামিতার অধিকারকে বৈধতা দিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে একটি প্রস্তাব পাশ হয়েছে। প্রস্তাবটিতে যৌন প্রবৃত্তি বা লিঙ্গ পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে কোন ভেদাভেদ থাকবে না এবং লেসবিয়ান, গে, বাই-সেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডাররা অন্য লিঙ্গের মানুষের মতোই সমঅধিকার ভোগ করবে এই মর্মে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রের নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়াও সংবিধানে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী হিসেবে স্পষ্টভাবে বলা আছে।
এতকিছু সত্ত্বেও আমাদের দেশে সমকামী ব্যক্তিরা শুধুমাত্র যৌন প্রবৃত্তি ও লিঙ্গ পরিচয়ের কারনে হত্যা, ধর্ষন, শারীরিক এবং মানসিকভাবে আহত, নির্যাতিত,এবং চাকরি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যসহ বিভিন্নরকম সহিংসতার শিকার হন।
সমকামীরাও সাধারন মানুষ একথা আমাদের বুঝতে হবে এবং জানতেও হবে। আর দশটা সাধারন মানুষের মতোই তারা হাঁটা চলা, চিন্তা চেতনা, বইপড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা সহ সব কাজ করে। শুধু তাদের যৌনজীবনের আকর্ষণ হোমোসেক্সুয়ালিটি। এবং সমকামী সম্পর্ক শুধুমাত্র যৌনতা নির্ভরও হয় না, একথা বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে ভালোবাসার ক্ষেত্রে শুধু শরীরই মুখ্য নয়, এবং ভালোবাসার ক্ষেত্রে লৈঙ্গিক পরিচয়ও বিবেচ্য বিষয় নয়। সমাজের যে কোনো সম্পর্কের মতো সমকামী সম্পর্কের ভিতও পারস্পারিক আকর্ষন বোধ, ভালবাসা, সম্মান ও বিশ্বাস থেকে তৈরী হয়। সুতরাং সমকামিতা জেনেটিক ভেরিয়েশন হতে পারে, কিন্তু মানসিক রোগ কখনোই নয়।
বৈচিত্র আমাদের মানুষ নামক প্রজাতিটির একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। প্রকৃতিগতভাবে আমরা প্রত্যেকেই একে অন্যের থেকে আলাদা, কিন্তু তার মানে এটা কখনোই নয় আমি সুস্থ আর বাকী সবাই অসুস্থ। তার অর্থ এটাও নয়, আমি ভালো অন্যরা খারাপ। সামাজিক এবং ধর্মীয় ব্যবস্থা আমাদের শেখায় বটে সমকামীরা মানসিক রোগী, কিন্তু সমকামী হওয়া নির্ভর করে একজন ব্যক্তির স্টিমুলি বা ইচ্ছা বা চয়েসের উপর।
সবচেয়ে বড় কথা, কে কাকে ভালোবাসবে, কে কার সাথে থাকবে, সে বিষয়ে মাথা গলানোর অধিকার যে আমার নেই সেটা ভালোভাবে বুঝতে হবে আমাদের। ভালোবাসা প্রত্যেকজন ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব বিষয়। সমাজ, দেশ, রাষ্ট্রে সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে হলে আমাদের অবশ্যই ধর্মীয় এবং সামাজিক সংস্কার মুক্ত হতে হবে। মতানৈক্য থাকতেই পারে, কিন্তু মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের প্রতি কোনভাবেই বৈষম্য, নির্যাতন বা কুৎসা রটানোর অধিকার আমাদের নেই - এই সারসত্যটা নিজের মধ্যে ধারন করতে হবে এবং সেটাকে মেন্টেইনও করতে হবে।
জীবন সত্যি সুন্দর। কিন্তু সেটা সুন্দর তখনই যখন একজন মানুষ সেটাকে নিজের ইচ্ছেমত চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ইচ্ছেমত সঙ্গী নির্বাচন করতে পারে। আর এজন্যই মানুষ স্বাধীন। এবং স্বাধীনতা তার জন্মগত অধিকারও। সমকামীদের জীবন যাপন নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার মতো বা ঘৃণা করার মতো কিছুই নেই। শুধু এটুকু মনের মধ্যে গেঁথে নিলেই চলবে স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক শব্দ দুটো আমাদের সৃষ্টি এবং আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতাও।
কথা শেষে দেখলাম স্টুডেন্টগুলোর মুখে লজ্জা নেই, বরং খুব স্বাভাবিকভাবে তারা বিভিন্ন প্রশ্ন করছে এবং বিষয়টা বুঝতে চাইছে। এবং পরদিন Adolecence পিরিয়ডের বৈশিষ্ট্যের যে উত্তর তারা লিখে এনেছিল তাতে তিন নম্বরে এই পয়েন্টটা জ্বলজ্বল করছিলো - 'Attraction Towards the Opposite or Same Sex'।
লেখক: শিক্ষক