তিনি একজন নাস্তিক রোজাদার
প্রকাশ : ১৯ মে ২০১৮, ১৩:৫০
আমাদের অফিসে প্রত্যেক বৃহস্পতিবারে লাঞ্চের ব্যবস্থা থাকে। আমাদের প্রধান বস কিছু ব্যাপারে মহা সৌখিন, উনি একজন শেফের সাথে চুক্তি করেছেন, প্রত্যেক সপ্তাহে বিভিন্ন রেসিপি থেকে আমাদের চয়েস দেন, আমরা সোমবারে উনার কাছে ইমেল করে বলি এই সপ্তাহে কি খাবো, উনি সেটা আমাদের জন্য বানান। আমিও প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই কিছু না কিছু অর্ডার দেই; শেফ আবার নাম/মুখ মনে রাখেন খুব ভালো, আমাকে এর মধ্যে ভালোই চিনে গেছেন তিনি।
আমি সোমবারের মধ্যেই জানিয়ে দেই কি চাই; আর তাই এই সপ্তাহে এই শেফ আপু মঙ্গলবারে আমাকে আলাদা করে জিজ্ঞেস করলেন, - আমি অর্ডার দিতে ভুলে গেছি ভেবে। আমি হেসে বললাম, নাহ, রমজান মাস শুরু, এক মাসের আগে কোন লাঞ্চ খাওয়া নেই। উনিও হেসে বললেন, বেশ, মাসটির জন্য শুভ কামনা রইলো।
ডালাস শহরও খুবই বিচিত্র কারণে এইবার দুই ভাগ হয়ে গেছে, কেউ কেউ রোজা শুরু করলো বুধবারে, আর কেউ কেউ বৃহস্পতিবারে। আমি প্রথম দলে ছিলাম। আর বরাবর যা হয়, আমার সহকর্মীদের কত কৌতূহল, কত ভাবনা, আমি ঠিক আছি কিনা, আমার আলাদা কিছু লাগবে কিনা, ইত্যাদি। বৃহস্পতিবার সেই লাঞ্চের দিন, সেটা নিয়েও খোঁজ নিলো; - কেউ কেউ মেইন লাঞ্চ রুমে বসে খায়, আর আমাদের ডিপার্টমেন্টের আমরা সবাই আবার যার যার 'খুপড়ি'তে ফিরে কাজ করতে করতে খেতে থাকি। তারপর এই এক ঘন্টা লাঞ্চ বিরতি যে যার ইচ্ছা মতো কাজে লাগাই, - কেউ হয়তো দোকানে গেলো, কেউ গাড়িতে বসে ঘুম দিলো একটু বা বই নিয়ে বসলো। কেউ বা অফিসেই থেকে যায়, বিকেলে তাই এক ঘন্টা আগে ছুটি নিয়ে নেয়।
তো, আজকের দিনেও, ডিপার্টমেন্টের বাকিরা লাঞ্চ আনতে যাবে, কিন্তু যাওয়ার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করে গেলো, এই যে আবার লাঞ্চ নিয়ে ফিরবে, আমার কোন অসুবিধা হবে কিনা, - যেহেতু আমি কিছু খেতে পারবো না। আমি হেসে বললাম, সমস্যা নাই, তোমরা খাও, আমি যাই বাইরে থেকে ঘুরে আসি। আমি বসে থাকলেও কোন সমস্যা হতো না, কিন্তু বসে থেকেই বা কি হবে খামোখা? সুঘ্রাণ নাকে লাগিয়ে ঈমানের পরীক্ষা দেয়ার চাইতে ভাবলাম, গাড়িতেই বসে একটু ফেসবুক গুঁতাই।
কিন্তু মনে করুন, আমি যদি বলতাম, হু, আমার খুব অসুবিধা হবে, তোমরাও লাঞ্চ করো না, বা করলেও মেইনরুমেই বসে খেয়ো, আমার আশপাশে এসো না। তাদের রুটিন যদি আমার কারণে আমূল পাল্টে ফেলতে বলতাম, তাহলে কেমন হতো বলুন তো? মুখ ফুটে হয়তো কিছু বলতো না, কিন্তু বিরক্ত কি বোধ করতো না তারা? এই সপ্তাহে আমার খোঁজ নিচ্ছে, আগামী সপ্তাহে তো কিছুই বলতো না, - পাছে আমি যদি আরো আব্দার করে বসি! আজকে বলছি লাঞ্চ খেয়ো না, কালকে যদি বলে বসি, এই টেক্সান গরমে তোমরা পানি খেয়ো না, সকালের ঘুম তাড়াতে কফি খেয়ো না, মাঝে মাঝে যে টুকটাক বাদাম বা চিপ্স চিবাও , সেটাও করতে পারবে না, - যেহেতু আমি পারছি না! তাহলে বলুন তো, না আমার প্রতি, না মুসলমান জাতটারই প্রতি, তাদের তখন ভালোবাসা কি মায়া বোধ হতো, নাকি বিতৃষ্ণা?
বাংলাদেশে যারা যারা মাইকিং করছেন, রোজার মাসে সমস্ত খাবারের দোকান বন্ধ করে দিতে বলে, আপনার সংযমের ভারটি এই যে অপরপক্ষের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন, নিজেই নিজের দায়িত্ব না নিয়ে, - বলি, ইহা কি ঈমানী দায়িত্ব পালন করছেন, নাকি, আপামর মুসলমানদের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি করছেন, - কোনটা?
জানেন, আমার বন্ধুতালিকায় একজন মানুষ আছেন, যিনি কোন ধর্মে বিশ্বাস রাখেন না; তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো এক রাস্তার মোড়ে, আমরা কিছু এক্টিভিস্টরা একটা দোকানের সামনে পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম প্রতিবাদে, কারণ সেই দোকান ঘোষণা দিয়েছিলো, মাথায় হিজাব পরা কাউকে তারা চাকরিতে রাখবে না। ঐ প্রতিবাদটি স্বল্প পরিসরেই হয়েছিলো, অনেক হিজাবীরাই এসেছিলেন। সেখানে দেখলাম এই এক আমেরিকান বয়স্ক ভদ্রলোক, তিনিও আমাদের পাশে পাশে পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। আমি গিয়ে কথা বললাম, আর আমরা সেইদিন থেকে বন্ধু। সেই মানুষটা কিছুদিন আগে স্ট্যাটাস দিলেন- আমার খুব ইফতার খাওয়ার ইচ্ছা হয়, আমি সবসময় রোজার কথা শুনেছি, কিন্তু নিজ চোখে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে কেমন করে কি হয়। আমি তাকে বললাম, আপনি একদিন আমাদের বাসায় আসবেন, আমাদের সাথে ইফতার করবেন, কেমন? তিনি সাথে সাথেই সেই দাওয়াত কবুল করে বললেন, অবশ্যই আসবো, আর আমি সেদিন সারাদিন রোজাও থাকবো। আমি হেসে বললাম, আপনি চাইলে রাখতে পারেন, কিন্তু ইফতার খাওয়ার জন্য রোজা রাখার কোন দরকার নেই, আপনি চাইলে এমনিই আসতে পারেন! কিন্তু তিনিই জোর করলেন, না না, যেদিন তুমি ডাকবে, আমি সেদিন সারাদিন রোজা রেখেই তবে আসবো।
এখন আপনি আমাকে বলেন দেখি, এই পবিত্র মাসের পবিত্রতা রক্ষা করছেন কে বেশি? মানুষে মানুষে ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ববোধ, মমত্ববোধ, শ্রদ্ধাশীলতা, এইসব বাড়াচ্ছেন কে বেশি? এই নাস্তিক মানুষটি যিনি নিজে থেকেই রোজা রাখতে চাইছেন, নাকি সেই সব রোজাদারেরা যারা জোর করে অন্যদেরও উপোস করাতে চাইছেন, - বলেন তো? এই রোজার মাসে এই নেন, এই ধাঁধা ধরলাম!
লেখক: লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট