হারানো সু-দিন বনাম নতুন কু-দিন!

প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০১৮, ০০:০৪

কোন এক শুক্রবারের কথা! সেভেন বা এইটে পড়ি। বেলা করে ঘুম থেকে উঠবো ভেবেছিলাম, কিন্তু কি একটা নিয়ে যেন সকাল থেকেই বেশ হইহই হচ্ছে বাসায়! চোখ কচলে উঠে গিয়ে দেখি, একটা বড় কার্টন এর ভেতর বরফে গুছানো ইয়া বিশাল বিশাল সাইজের কম করে হলেও শ’খানেক চিংড়ি! আব্বু খুবই বাজার-রসিক, শুক্রবার সকালে বাজারে গেলে এমন চিংড়ি তো নিয়ে আসেন, কিন্তু তাই বলে এতগুলো!

না, কাহিনী জানলাম আস্তে আস্তে। এই কার্টন কে বা কাহারা দরজায় এসে নক করে দিয়ে গেছে। বুয়া তো বুঝে না, কে দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে না জিজ্ঞেস করেই, বা বাসার কাউকে না ডেকেই রিসিভ করে ফেলেছে! এবং এই নিয়ে আব্বু তাণ্ডব করছেন, আম্মু আব্বুকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন! আর বুয়া যথারীতি কিচেনে ‘গজগজ গজগজ’ করেই চলছে! 

বাহ! সারপ্রাইজ গিফট! এত্তগুলো চিংড়ি! কি মজা! কিন্তু আব্বু আম্মু এত আপসেট হয়ে আছেন কেন?!

এর মধ্যে আব্বু শার্ট পাল্টে কার্টনটা নিয়ে কই যেন চলে গেলেন, ফিরে এলেন খালি হাতেই। মন খারাপ হয়ে গেলো! আহা, এত্তগুলো সুন্দর চিংড়ি! কিন্তু কে দিয়ে গিয়েছিল এগুলো? আর গিফট পেলে এত আপসেট কেন আম্মু-আব্বু, জিজ্ঞেস করতেও কোন সদুত্তর পেলাম না। যেন আমাদের বলা যাবে না এমন ‘বড়দের ব্যাপার’! 

পুরো ঘটনা জেনেছি আরও অনেকদিন পরে। আব্বু তখন ফেনীতে অগ্রণী ব্যাংকের একটা শাখার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। সে এলাকায় সামুদ্রিক চিংড়ির বহু বাণিজ্যিক ফার্ম আছে। যারা ব্যাংক লোন নেয়। তো, লোন ইস্যু করার আগে এমনি এক ফার্মে আব্বু ভিজিট করে এসেছিলেন। সম্ভবত লোন পাবার মত ক্যাপাবিলিটি ছিল না সেই লোকের বা ফার্মের। তাই আব্বুদের ইন্সপেকশন রেজাল্ট ম্যানিপুলেইট করতেই তার এই ‘উপহার’! নিশ্চয়ই ততদিনে তিনিও জেনেছেন আব্বুর ভোজন রসিকতার গল্প! তাই এই প্রচেষ্টা তার!

শুনে ভেবেছিলাম, তাই তো! কেউ ব্যাংক থেকে টাকা চাইলেই তো তাকে দেয়া যায় না, সে টাকাটা শোধ করতে পারবে কিনা, তাও তো দেখতে হবে। আব্বুর সাইনে টাকা নিয়ে যদি না ফেরত দেয়, তখন আমার আব্বুকেই তো সবাই বকা দেবে! আর এই পঁচা লোক চিংড়ি দিয়ে মন গলাবার ট্রাই করছিল! কি বজ্জাত এরা! আমার আব্বুও খুব ভালো। খুব ভালো কাজ করেছে ফেরত দিয়ে এসেছেন চিংড়িগুলো। আমার চোখে সেদিন থেকে আবারো বিশ্বাস হয়ে গেলো, আমার ব্যাংকার পিতা আর কলেজ শিক্ষক মাতার আয়ের একটা দানাও অবৈধ নয়! ব্যাংকার-শিক্ষকের ফ্যামিলিতে কখনো ঘুষ প্রবেশ করেনি। 

এসব ছিল সেই মহাকালের গল্প, যখন ‘ঘুষ নেয়া’/‘বেতন বহির্ভুত শান শউকত’ সমাজের একটা নিন্দনীয় কাজ ছিল! একটা পাড়ায় ত্রিশ চল্লিশটা ফ্যামিলির মাত্র একটা হয়ত ঘুষখোর ছিল, একটা বাজে বিজনেসের ফ্যামিলি ছিল, আরেকটা কি কারনে যেন ‘রহস্যময়’ পরিবার ছিল- সবাই ওদের এড়িয়ে চলতো। দাম দিতো না। ওদের গাড়ি থাকুক, বাড়ি থাকুক, বাসায় সাদা কুকুর থাকুক, কেউই মিশতো না। যেন মিশলে সে কলংক ভালোদের গায়েও লেগে যাবে। খেলায় নিতো না ওদের ছেলেমেয়েদের, স্কুলে পাশে বসতো না! ফিসফিসিয়ে বড়দের থেকে শোনা লাইন বলে যেত, জানিস! ওর আব্বু না ঘুষ খায়! ঘুষ খুব খারাপ জিনিস! 

আজ কোথায় গেল সেসব দিন! কেন চলে গেলো? কেন আমরা আগের মত ভাবি না, কেউ গোনা টাকায় সরকারি বেতন পেয়ে কি করে এত শানে জীবন কাটাচ্ছে! ব্যবসা অত বড় না হলেও কি করে ফ্ল্যাট কিনছে, গাড়ির মডেল বদলাচ্ছে! দিনের পর দিন এলাকায় রাজনীতিই তো করে, ছেলেমেয়েরা কি করে দেশ বিদেশে পড়াশোনা করছে! বরং, আমরা এটাই ভাবছি এখন, ওর এত ‘পয়সা’, তবে আমার নাই কেন? আমার সেই শাড়ি, ঐ গয়না নেই কেন? আমাদের গাড়ি পুরান কেন? আমাদের বিয়েতে এটার আয়োজন, সেটার আয়োজন নেই কেন? 

কেউই ভাবি না, এখন ওদের কেউই ‘একঘরে’ করে না, বরং ওরাই রোল মডেল ‘উন্নতি করছে খুব’ এর উদাহরন হিসেবে। সে জন্যই তো আমাদের ভীরু ভীরু বা সুযোগের অভাবে ভালোমানুষ হয়ে থাকা হাতের কাছেও যেদিন ‘এক কার্টন চিংড়ি’ আসছে, সেটা কিনে ফেলতে পারছে আমাদের। 

বেঁচে থাকলে কত কিছুই তো দেখতে হয়! বেশি দিন তো না, সেই ক্লাস সেভেন–এইটের বয়সের বিশ বছর পর নিউজে পড়ি, আমার দেশের ব্যাংকগুলো থেকে গুনে গুনে ৭৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে আছে! কোটি টাকা চোখে দেখি নি কোনদিন! একশ বা এক হাজার কোটিও না, ৭৫ হাজার কোটি টাকা! সাধারন মানুষের টাকা। কিন্তু হদিস নাই! যারা নিয়েছেন তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এই টাকা সরকার পরিশোধ করবেন এখন। সরকারের টাকা কার? সরকারের টাকা আমাদের ট্যাক্সের টাকা। যে টাকায় দেশের কাজ হবার কথা ছিল, সেই টাকা চোরের চুরির ক্ষতিপূরণ দিতে লাগছে এখন। 

আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক জানতে চায়, নিশ্চয়ই সেখানেও লোন দেবার আগে ভিজিটের কথা ছিল, পরিশোধের সম্ভাবনা কত, সেটা খতিয়ে দেখার কথা ছিল। এরপর নিশ্চয়ই কোন ব্যাংকারের সই এর পরেই টাকাগুলো লোন হিসেবে ইস্যু হয়েছে সেসব খেলাপির নামে। তাহলে কোথায় তাদের সেই দায়বদ্ধতা? কি দিয়ে কেনা হয়েছে তাদের, বা সে সব ব্যাংকের মালিকদের? ‘এক কার্টন চিংড়ি’ তাহলে আজকাল কাজ করা শুরু করছে?

এক জীবনে কত ‘চিংড়ি’ খেতে হয় মানুষের? 
এত খেয়েও কি ‘অমর’ হতে পারেন? 
সন্তান ‘সুসন্তান’ হতে পারেন? 
‘রোগ–শোক–দুর্ঘটনা-অপমৃত্যু’ এড়াতে পারেন? 
কিসের জন্য ‘খায়’ তাহলে?

লেখক: কূটনীতিক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত