আমি কি ভুলিতে পারি?
প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০০:২৫
“তোমার বাড়ি, আমার বাড়ি,
মধ্যে সুরনদী
সেই নদীখান মনে হইল,
অকূল জলধি!
আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি!”
আরো একটা একুশে ফেব্রুয়ারি। মনে-প্রাণে-ফেসবুকে সবার বাঙালি হবার দিন। প্রতিবারের মত এবারও আমি গোটা কতক বাংলা গান গুনগুন করব, ইউটিউবে আঙুল চালিয়ে শুনব ‘আমি কি ভুলিতে পারি?’, ফেসবুকের দেয়ালে কঠিন শব্দে বাক্য বানিয়ে জানান দেব নিজের জাত্যাভিমান—তবুও কেন জানি, আমার হয়তো পুরোপুরি বাঙালি হয়ে ওঠা হবে না এজন্মে। আমার নামে কেমন একটা অ-হিন্দু (মানে মুসলমান আর কি) গন্ধ, আদিবাড়ি অ-কথ্য বাংলায় কথা বলা অঞ্চল সিলেটে এবং আমার জন্মস্থান তথাকথিত বাংলার সীমানা থেকে ‘নির্বাসিত’ বরাক উপত্যকার শিলচরে। রাষ্ট্রের চোখে আমি সন্দেহজনক জাতির অন্তর্গত, যাদের নাম যে কোনো মূহুর্তে ঠাঁই পেতে পারে বিদেশীর তালিকায়। আর যে বাড়িগুলির জানালার কাঁচ ভেঙে আমার বলখেলায় হাতেখড়ি, সেই পাড়া থেকেই আমায় পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে একটা কাঁটাতার পার করিয়ে দেওয়া হবে। অনেক দূরে টিমটিম করে আলো জ্বলতে থাকা কিছু কুঁড়েঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে রাষ্ট্র আমায় বোঝাবে যে আমার বাড়ি আসলে কোথায়। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারব না। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে এটুকু বুঝব, এখন আমার ঠিকানা আর আমার বাড়ির মধ্যে যেন একটা অকূল জলধি অবস্থান করছে। আর তার একপারে বসে আমি কোনো এক অজানা ঘরে ফিরতে চেয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছি। অলিখিত উদ্বাস্তুদের বোধহয় এমনই হয়। এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি তাই আমার জন্য বাঙালি হবার গর্ব বয়ে আনে না। যদি কিছু এনে থাকে, তবে তা চরম কুণ্ঠা, ভয়, ত্রাস। কেন, আসছি সে কথায়।
কিছুটা গবেষণা, কিছুটা ছুটি কাটাতে এবারের শীতে গিয়েছিলাম শিলচরে। অন্য কোন বছরে হয়তো গোটা শিলচর পিঠে-পুলিতে মেতে থাকত, এবছর শিলচর তথা গোটা বরাক উপত্যকারই যেন শিরে সংক্রান্তি। যে বাড়িতেই যাই, যার সাথেই আড্ডা দিই, যে রাস্তার মোড়ে কান পাতি বা যে পত্রিকায় হাতে তুলি না কেন—সর্বত্র একই শব্দবন্ধে ছয়লাপ। এনআরসি- National Register of Citizens (NRC) বা নাগরিক পঞ্জী, যার নবায়ন প্রক্রিয়াই এহেন উত্তেজনার মূল কারণ। ২০১৭ সালের শেষ দিন, ৩১শে ডিসেম্বর, যখন গোটা পৃথিবী নতুনের আহ্বানে ব্যস্ত, নাগরিক পঞ্জী নবায়নের ঠেলায় গোটা আসামের দৃষ্টি পড়েছিল অতীতে। ফলাফলস্বরূপ দেখা গেল, নতুন বছরের প্রথম রাত্রি বারোটা বেজে দুই মিনিটে প্রকাশিত নতুন নাগরিক পঞ্জীর প্রথম খসড়ায় প্রধানত বাংলাভাষী বরাক উপত্যকার মোটে ৩০% মানুষের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, এদিকে উজান আসাম (উত্তর ও মধ্য আসাম)-এ অন্তর্ভুক্তির হার ৯০%-এর কাছাকাছি। বরাক উপত্যকা থেকে এমন অনেক ব্যক্তির নাম তালিকায় নেই, যাঁদের মা-বাবা, স্ত্রী-স্বামী, পুত্র-কন্যা প্রভৃতিরা তালিকায় আছেন। আবার এমনও মানুষ তালিকাভুক্ত হয়েছেন যাঁদের জন্ম এই দেশের মাটিতে, কিন্ত রাষ্ট্রের চোখে, কেবলমাত্র ভাষিক পরিচয়ের নিরিখে তিনি ‘অভিবাসী’, আদি অধিবাসী নন। আইনি, রাজনৈতিক বা সামাজিক জটিলতা—এসব কাটিয়ে আসামের বাঙালির সাথে সাথে আমারও দৃষ্টি আটকে আসন্ন দ্বিতীয় খসড়ার নাগরিক পঞ্জীর দিকে। কে জানে, দয়া করে একটু ঠাঁই মিলবে কি না রাষ্ট্রের পায়ের কাছে। আর যদি না মেলে, তবে কি হবে ভবিষ্যৎ? পরের বার শিলচর গিয়ে পাড়ায় চেনা মুখগুলি দেখতে পাব তো? নাকি জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দী হয়ে যাবে আমার ছেলেবেলার শহর, মাটি, উপত্যকা, ভাষা?
প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না, কিন্ত উত্তরের আশায় যার দিকে চাতকের মত তাকিয়ে রয়েছি আমি, আমরা, সেই রাষ্ট্রের প্রতি আমার অন্তত এতদিনে চরম অনাস্থা। ঐতিহাসিক ভিত্তি ছাড়া এই বিদেশী চিহ্নিত করা ও বিতাড়নের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা রাষ্ট্রের চোখে দ্রোহ। অথচ দেশরক্ষার দোহাই দিয়ে যারা ধর্মের ফেউ লেলিয়ে দেয়, তাদের দেখেও চোখের আড়াল করতে জানে এই একই রাষ্ট্রব্যবস্থা। পঞ্জীতে গোনার কথা ভারতীয়দের, অথচ পাশের দেশগুলি থেকে আগত হিন্দুদের সেই নাগরিকত্বে অবাধ অগ্রাধিকার, শুধুমাত্র ধর্মগত পরিচয়ের কারণে। আর এদিকে চোখের সামনে প্রমাণিত ভারতীয় নাগরিক, অথচ নেহাত ধার্মিক, ভাষিক, লৈঙ্গিক সংখ্যালঘু বলে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের ওপর যে অকথ্য অত্যাচার নামিয়ে আনা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হাত-পা-চোখ-মুখ সব বাঁধা। শুধু তাই নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতার অপব্যবহারে ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে আঘাত করে একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে ভারতের মানচিত্রে কোণঠাসা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, যা কখনো ‘এনআরসি’, কখনো ‘নাগরিকত্ব বিল’, বা কখনো ‘ওরিজিনাল ইনহ্যাবিটান্ট’ নামে একের পর এক পরিহাস ঠেলে দিচ্ছে কন্ঠহীন সংখ্যালঘুর ওপর। আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার আড়ালে থাকা আরামপ্রিয় মানুষেরা ভাবছেন এসব নিছকই হেডলাইন, মনে মনে ভাবছেন— “বাঙালিকে কে কবে আটকেছে, বলুন তো?” তাদের উদ্দেশ্যে বলি, বুকের পাটা থাকলে কলকাতা থেকে প্লেনে নয়, ট্রেনে চেপে শিলচর আসুন। আর বুঝতে চেষ্টা করুন কেন স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও আপনার জাতভায়েরা নিজদেশে বিদেশী তকমা গায়ে সেঁটে ঘুরলেও, জন্মগতভাবে অন্তত তিনটে ভারতীয় ভাষার সাথে আন্তরিকভাবে অবগত।
২০১৮’র একুশে ফেব্রুয়ারি আমার যতটা ভীত করছে, ততটাই জেদ চাপাচ্ছেও বটে। এতদিন বাংলা আমার ‘তৃপ্ত শেষ চুমুক’ হলেও এখন সময় বাংলার ‘দৃপ্ত স্লোগান’ থেকে ‘ক্ষিপ্ত তীর-ধনুক’ হয়ে ওঠার। আর এরপরও যদি কলকাতায় বসে কোন বাঙালি ডাক দেন বিশুদ্ধ বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গ গড়বার, সেই বাঙালির কোন অধিকার নেই একুশে’র উত্তরাধিকারে। যে বাঙালি তারই রাজ্যে বসবাসকারী ভাষিক সংখ্যালঘু বিষয়ে অবগত নয় মোটেও, বরং গর্ব করে হিন্দি বা নেপালি না জানায়, অথচ যাঁদের দাবী পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষকে বাংলায় সচল হতে হবেই, তাদের কাছ থেকে একটি অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের বিরোধিতার আশা না করাই বোধহয় ভালো। বড়জোর একখানা দীর্ঘশ্বাস আশা করা যেতে পারে, স্লোগান নয়।
১৯৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন ছিল রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া ভাষার বিরুদ্ধে মাতৃভাষার অধিকারের জন্য আন্দোলন। আসামের ১৯৬১’র উনিশে মে’ও খানিকটা তাই, যদিও এখনের উনিশ কেবলমাত্র বাংলাভাষার আন্দোলন হয়েই থেমে নেই। প্রত্যেকের নিজস্ব মাতৃভাষার ওপর তার অধিকার বিষয়ক একটি বৃহত্তর মঞ্চের আকার ধারণ করেছে সে। কিন্ত ২০১৮ সালে দাঁড়িয়ে, একুশ আর উনিশ—দুইয়ের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় একটি প্রশ্ন। রাষ্ট্রের সাথে ভাষা আন্দোলনের বিরোধ কি শুধুই একটি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের ছিল? মাতৃভাষা রক্ষার প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে সংখ্যালঘুত্বের সম্পর্ক কোথায়? নাকি আসল বিরোধ সব সময়েই ক্ষমতা বনাম ইতিহাসের, সত্যের?
উত্তর আমি জানি না, কিন্ত যদি লড়াইটা ক্ষমতা বনাম ঐতিহাসিক সত্যের হয়ে থাকে, তবে যুদ্ধ এখনও থামেনি। আর ময়দানও এখন ফাঁকা নয়। তার স্থান-বদল হয়েছে শুধু। রাষ্ট্রের চরিত্র এখনও একই রকম দৃঢ়। সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতান্ত্রিক চেতনাও একই রকম নির্লিপ্ত।
তফাৎ শুধু সংখ্যায়।
লেখক: ব্লগার, সঙ্গীতশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী
প্রথম প্রকাশ: এবং আলাপ