নারীবাদ কি ও কেন
প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০১৭, ২৩:৪১
পুরুষতন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা আর পুরুষ-বিদ্বেষের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। নারীবাদকে আমরা অনেকেই দ্বিতীয়টির সাথে গুলিয়ে ফেলি। আমার আজকের লেখাটি সেরকম কিছু ভুল ভাঙ্গার প্রয়াস।
পুরুষতন্ত্র কি সেটি দিয়ে একটু শুরু করি।
খুবই সাধারণ অর্থে, পুরুষতন্ত্র হচ্ছে সেই ভাবনাটি, যে পুরুষরা নারীর চাইতে শ্রেয়। সেটি বুদ্ধিতে হতে পারে, কিংবা শক্তিতে, অর্থনীতি বা রাজনীতি, বা যে কোন কিছুতেই। আমরা যারা ভালোমানুষ, তারা হয়তো হুট করে তেমনটি ভাববো না; আমরা বলবো, "কে ভালো কে মন্দ সেটি ব্যক্তিবিশেষে নির্ধারণ করা উচিত, আমি তো তাই করি!" - কিন্তু একটি সমাজ যদি বছরের পর বছর একটি ভাবনার সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন অবচেতন মনেই আমরা নিজেরাই অনেক কিছু ভেবে ফেলি, বা অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আমরা বুঝিও না হয়তো, সেটি একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বড় হওয়ার কারণে আমরা এভাবে ভাবছি, বা এই কাজটি করছি।
নারীবাদ যেটি করে, এইসব 'সাধারণ' অভ্যাসগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সেই সচেতনতা থেকে একটু একটু করে একদিন পরিবর্তন আসে আমাদের সমাজে। - আর এতে করে কেবল কোন একটি গোষ্ঠীর নয়, সমস্ত সমাজই তা থেকে উপকৃত হয়।
যেমন দেখুন, এমন একটা সময় ছিলো, লেখাপড়ার বিষয়টি শুধুমাত্র পুরুষদের এখতিয়ারে ছিলো। (আমার সমস্ত উদাহরণগুলো সামগ্রিক হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মনোভাব বা রীতি বোঝাতে)। এখনকার দিনের কোন ভালোমানুষ কিন্তু সজ্ঞানে বলবে না, মেয়েদের লেখাপড়া শিখে কাজ নেই, শুধু ছেলেরাই শিখুক! - আমি আমেরিকার মেয়ে; ১৯২০ সালের আগ পর্যন্ত নারীর অধিকার ছিলো না ভোটদানের - অথচ, আমেরিকার জন্ম কিন্তু ১৭৭৬ সালে!
এই যে লেখাপড়া আর ভোটদানের সমঅধিকারের নিশ্চয়তা, সেটি কোত্থেকে এসেছে? নারীবাদ থেকে! না, আমি নির্দিষ্ট করে কোন নারীবাদী নেত্রীর নাম বলছি না (আমাদের বেগম রোকেয়া বা আমেরিকার সুজান এন্থনির নাম চাইলে যেমন আলাদা করে বলাই যায়); - আমি বলছি এই ভাবনাটার কথা, "শুধু মাত্র পুরুষেরা লেখাপড়া শিখবে কেন? ভোট দেবে কেন? মেয়েরা দেবে না কেন? এই সমান সুযোগটা নেই কেন?" এই ভাবনাটা এসেছিলো বলেই এই নিয়ে আলোচনা হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে, বিপ্লব হয়েছে, - আর তাই এখন সবার লেখাপড়ার সুযোগ, ভোটাধিকার, এগুলোই সাধারণ, অন্যথা নয়।
এবার এখনকার পৃথিবীটা দেখি। লেখাপড়ার অধিকার আমাদের সবারই; কিন্তু এখনো কি এমন পরিবার নেই, যেখানে- মনে করুন অর্থনৈতিক কারণে - কেবলমাত্র একটি সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর সুযোগ আছে, মনে করুন তাদের এক ছেলে আর এক মেয়ে, তখন কি ছেলেটিকেই স্কুলে পাঠানো হয় না? হু, এর পেছনেও অনেক ফ্যাক্টর কাজ করতেই পারে; - যেমন, মনে হতে পারে, মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, সে তো আমাদের ভরণপোষণ করবে না আজীবন, তার চেয়ে ছেলেকে পড়ানোই হবে বুদ্ধিদীপ্ত বিনিয়োগ! এই যে নেপথ্য ভাবনাটি, এর পেছনেও কি অসমতা নেই? - অবচেতন বৈষম্য কি নামীদামী শিক্ষিত পরিবারেও নেই, যেখানে একজন পুরুষ নির্দ্বিধায় উচ্চতর ডিগ্ৰী, বা বিদেশে পড়তে যাওয়া নিয়ে ছক কষতে পারে, কিন্তু মেয়েদেরকে সংসারের কথা ভেবে ছাড় দিতে হয়? - নারীবাদ হচ্ছে সেই অসমতাকে নিয়েই প্রশ্ন তোলা, আস্তে আস্তে সমতার দিকে সমাজকে প্রভাবিত করা। একজন ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি পরিবার যেমন সুদূরপ্রসারী চিন্তা করে, তেমনি একটি মেয়েকে নিয়েও ভাবুক, - ঠিক একইরকম সুযোগ তাকেও দিক, সেই লক্ষ্যটাই নারীবাদের।
আমেরিকার ভোটাধিকারের কথা বললাম; এখনো সে দেশে কোন নারী প্রেসিডেন্ট হয়নি। ২০১৬ সালে একটি জোরালো সুযোগ ছিলো; কিন্তু হিলারি ক্লিনটনের হেরে যাওয়ার পেছনে যে বেশ কিছু ফ্যাক্টর কাজ করেছে, তার মধ্যে একটি ছিলো 'লিঙ্গবৈষম্য'। অনেকক্ষেত্রেই সেটি অবচেতন; - 'হিলারি এতো গম্ভীর কেন, একটা মেয়ে যদি হাসিখুশি না হয় তাকে কি মানায়? গম্ভীর মেয়েমানুষ মানেই সে 'মুখরা রমণী'- আমি এর উপর আস্থা রাখতে পারি না, আমি একে জীবনেও ভোট দেবো না!' - না, এটাই একমাত্র কারণ না, আর এটি হয়তো মূল কারণও না, কিন্তু এটাও একটা ফ্যাক্টর ছিলো। (লিঙ্গবৈষম্য যে হয়েছে তার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে মিডিয়ার কভারেজ; - হিলারির পোশাকের উপর ফোকাস ছিলো অনেকেরই, তার প্রফেশনাল এচিভমেন্টগুলোকে পাশে ঠেলে।)
এই অবচেতন বৈষম্যটাকেই একটু পরখ করি; - হিলারির কথা বাদই দিলাম, আমরা ধরেই নেই, "একটি ভালো মেয়ে সদা হাসিখুশি, কিন্তু খারাপ মেয়েরাই গালি দেবে বা মুখ গম্ভীর করে রাখে"। আপনি হয়তো ভাবছেন, আমি তো যে কোন মানুষের মুখেই হাসি দেখতে - ছেলে হোক কি মেয়ে - আর গালি কারো মুখেই পছন্দ করি না। বেশ; - কিন্তু আশপাশে তাকিয়ে দেখুন, একটি ছেলে গম্ভীরমুখে থাকলে আমাদের প্রতিক্রিয়া, বনাম একটি মেয়ে: প্রথমজন সমাজের চোখে জ্ঞানী, কিন্তু দ্বিতীয়জন দজ্জাল নারী! গালি পুরুষকণ্ঠেও আপনার কাছে কাম্য না, কিন্তু একটি মেয়ে একই শব্দগুলো বললে আপনার কানে আরেকটু বেশি করে বাজে। সিগারেট খাওয়া খুব বাজে অভ্যাস, স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর; কিন্তু আপনি ছেলেদের সিগারেট টানতে দেখলে অফেন্ডেড হন না, মেয়ে'কে ধোঁয়া ছাড়তে দেখলেই ভেবে ফেলেন, "ছি ছি, আমাদের দেশটা আগে কত ভালো ছিলো, এখন দিনকে দিন রসাতলে যাচ্ছে!"
এই যে খারাপ অভ্যাসগুলোতেও মেয়েদের প্রতি আঙ্গুল তোলা হয় ছেলেদের চাইতে বেশি, এটাও বৈষম্য। আর আমরা বহুবারই সচেতনে নয়, সেটি অবচেতনেই করি। একজন নারীবাদী মানুষ- নারী কি পুরুষ - কেবলমাত্র এটাই চাচ্ছেন, যা ভালো, তা ভালো, যা খারাপ, তা খারাপ; সেটি নারীপুরুষ নির্বিশেষেই ভাবুন, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উপর বাড়তি দায় না চাপিয়েই ভাবুন!
সমতা যত আসে সমাজে, সেটি সবার জন্যই সুখবর হয়ে আসে। পুরুষতন্ত্রের কারণে পুরুষদের প্রতি অবিচার হয় না, সেটি কে বললো? একটি উদাহরণ দেই: পুরুষতন্ত্রের একটি ভাবনা হচ্ছে, কান্না হচ্ছে দুর্বলতা, সেটি নারীর শোভা পায়, পুরুষের নয়। পুরো মনোভাবটাই বেশ সমস্যাজনক, কান্না দুর্বলতা নয়, আর 'দুর্বলতা' ভেবে নারীর শোভা বানানো হচ্ছে, সেটাও অন্যায়।
কিন্তু আরেকটা অন্যায় হচ্ছে, এই মনোভাবের কারণে প্রচুর পুরুষ মন খুলে নিজেদের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারে না; এতে করে স্ট্রেস যেমন অহরহ থাকে, সেই স্ট্রেস থেকে শারীরিক এবং মানসিক দুই স্বাস্থ্যেরই উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাদের সম্পর্কগুলোর উপর প্রভাব করে, কমিউনিকেশন থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য, হরেক কিছুতে প্রভাব পড়ে - যদি নিজেদের অনুভূতিগুলোকে তারা যথাযথভাবে বহিঃপ্রকাশ না করা শেখে।
যখনই কোথাও অসমতা থাকে, সেটি সমাজের কারো জন্যই ভালো না, কোন নির্দিষ্ট গোত্র যতই সাময়িক সুযোগসুবিধা পাক না কেন এতে করে; একটা সময় আসবে যখন এই অসমতা থেকে বিরূপ প্রভাব তৈরী হবেই হবে!
একজন নারীবাদী মানুষ এই অসমতার বিরুদ্ধেই লড়ছে; - নারীবাদ শব্দটা নিয়ে আপনার যতই দ্বিধা কি কুন্ঠা থাক, দিনশেষে এই শব্দটির মানে হচ্ছে সাম্যবাদ, বা সমান অধিকারে বিশ্বাস, ন্যায়ের নীতিতে বিশ্বাস।
এর মধ্যে কিছু নারীবাদী কি আছেন, যারা পুরুষবিদ্বেষী? থাকতেই পারে! কিন্তু আপনি কি সব মুসলমানদের জঙ্গী বলে ডাকাটা মানবেন? ইসলাম ও জঙ্গিবাদকে সমার্থক শব্দ বানাবেন? - সেই ঘোর অন্যায়ের বিরুদ্ধে যদি কণ্ঠ তুলতে পারেন, তাহলে নারীবাদকে যারা পুরুষ-বিদ্বেষের সাথে গুলিয়ে ফেলছে, এখন থেকে তাদের বিরুদ্ধেও বলবেন।
যদি কারো নারীবাদী কথা ও কাজকে আপনার বিদ্বেষ বা স্বেচ্ছাচারিতা মনে হয়, তবে নির্দিষ্ট করে সেই ভাবনার বিপক্ষে বলুন, নারীবাদের বিপক্ষে নয়। নারীবাদের অর্থ বুঝেও যদি এর বিপক্ষে বলেন, তাহলে তার একটাই মাত্র মানে দাঁড়াচ্ছে: আপনি নিজেই একজন বৈষম্যকারী, আপনি নিজেই বিদ্বেষী। আপনি সমাজের কীট, আপনার কারণেই পৃথিবীটা পিছিয়ে পড়ছে; - আর, আমরা বাকিরা, আপনারই বিরুদ্ধে লড়ছি।
খামোখা বৈষম্যের অন্ধকারে কেন পড়ে থাকবেন, বলুন তো?
সমতার আলোতে আসুন, পুরো পৃথিবীটা আরেকটু আলোকিত হোক!