নারীর প্রতি সহিংসতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি
প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০১৭, ২০:৫০
সোহাগী জাহান তনুর হত্যাকাণ্ডই একমাত্র ঘটনা নয়। তনু হত্যা ব্যাপকভাবে আলোচিত। সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। কিন্তু তনুর মতো ঘটনা প্রায়ই সমাজে ঘটছে। যার সবটা গণমাধ্যমে আসে না। নারীর প্রতি সহিংসতা এবং একই সঙ্গে বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেন আমাদের দেশ ও সমাজের অতিসাধারণ চিত্র।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গল্প আমাদের শোনানো হয়। উন্নয়ন যে একেবারে হয়নি তা-ও নয়। এমনকি বিশ্বের অনেক অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকও এই উন্নয়নের গতি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। অবশ্য উন্নয়নের পাশাপাশি সম্পদ ও আয়ের বৈষম্যও বেড়েছে বিপজ্জনক হারে। যাহোক, আজকের নিবন্ধে আমরা সে বিষয়ে আলোচনা করছি না। আমরা কেবল এটুকু বলতে চাই যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কিছু কিছু সূচকের আশাপ্রদ দিকের পাশাপাশি দরকার রাজনৈতিক গণতন্ত্র ও সমাজের গণতন্ত্রীকরণ। রাজনৈতিক গণতন্ত্র নিয়েও এই নিবন্ধে কোনো আলোচনা করা হচ্ছে না। বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কীভাবে গণতন্ত্রের সর্বনাশ করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রথম আলো ও অন্যত্র যথেষ্ট লেখালেখি হয়েছে। আজকের নিবন্ধে সেসবের পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে না। গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। রাজনৈতিক গণতন্ত্রের বাইরেও রয়েছে সামাজিক গণতন্ত্রের বিষয়টি। যে সমাজে দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে হয়, সেই সমাজ গণতান্ত্রিক নয়। যে সমাজে কিছুসংখ্যক মানুষের ক্ষমতার দাপটের সামনে অধিকাংশ মানুষ অসহায় বোধ করে, সেই সমাজও গণতান্ত্রিক নয়। বস্তুত সমাজে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থবহ হতে পারে না।
সামাজিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠী হচ্ছে তিনটি— ১. নারী, ২. অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষ, ৩. ধর্ম ও জাতীয় বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে সংখ্যালঘু যথা: হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান অথবা আদিবাসী ও বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ।
আজকের নিবন্ধে নারী বিষয়টি নিয়ে কিছু আলোচনার সূত্রপাত করা হবে। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই কার্ল মার্ক্স লিডউইক কুগেলম্যানের কাছে লেখা এক চিঠিতে বলেছিলেন (১৮৬৮ সাল), ‘ইতিহাস সম্পর্কে যাঁর কোনো ধারণা আছে তিনিই জানেন যে নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো বড় সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব নয়।’ আমরা দেখেছি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর বিশাল অবদান ছিল। হয়তো বন্দুক হাতে নারী যোদ্ধার সংখ্যা কম। কিন্তু যে মা রাতের বেলায় গভীর সযত্নে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, সব রকম ঝুঁকি নিয়েছেন, আদর করে রেঁধে খাইয়েছেন, তাঁদের সংখ্যা গণনা করলে, সেটা হবে বিশাল। যে দুই লাখ নারী স্বাধীনতার জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাঁদের অবদানও বিরাট।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্বকে বিস্মিত করেছে, সেখানেও নারীর অবদান সর্বাধিক। সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আনছে যে খাত, সেই পোশাকশিল্পের ৮০ শতাংশ নারী। অন্যান্য উৎপাদন খাত ও সেবা খাতেও নারীর সদম্ভ উপস্থিতি আমরা লক্ষ করতে পারি। আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে নারীর বিরাট অবদান রয়েছে। কিন্তু তা সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়। বরং সমাজজীবনে নারী চরমভাবে অবহেলিত, উপেক্ষিত ও নির্যাতিত। ওপরে উল্লিখিত একই চিঠিতে কার্ল মার্ক্স পরের যে বাক্যটি লিখেছিলেন সেটা অধিক তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘নারীর সামাজিক অবস্থান দ্বারাই সমাজ প্রগতির মাত্রা নির্ধারণ করা চলে।’ আমরা যদি মার্ক্সের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হই, তাহলে দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হব যে আমাদের সমাজ অনেক পিছিয়ে আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বহুবিধ রাজনৈতিক সংগ্রামের পরও সমাজের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি।
গত বছর আগস্ট মাসে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ৩৭০ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। তার মধ্যে ৪৪ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল। সম্প্রতি আইন ও সালিশ কেন্দ্র কর্তৃক সংগৃহীত তথ্যভান্ডার থেকে যে হিসাব পাওয়া যায়, তা-ও ভয়াবহ। এই বছর (২০১৬) জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ৩৭০ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ১৫২ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। অ্যাসিড নিক্ষেপ করা হয়েছে ১০ জন নারীর মুখে। বখাটের উৎপাত ও যৌন হয়রানির শিকার ৮৯ জন। ধর্ষিত হয়েছেন ১৬১ জন। সালিস ও ফতোয়ার মাধ্যমে নির্যাতিত হয়েছেন দুজন। যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতিত হয়েছেন ৬৬ জন। নানাভাবে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১০৩ জন। গৃহপরিচারিকা হিসেবে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের ঘরে কাজ করে যে বালিকা ও কিশোরীরা, তারাও যৌন হয়রানি ছাড়া নানাভাবে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। তিন মাসে তেমন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১৮টি। এসব তথ্য সংগৃহীত হয়েছে মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর থেকে। এর বাইরেও যেসব নির্যাতনের খবর আছে, তার সংখ্যা এর চেয়ে বেশিই হবে। কিন্তু প্রকাশিত হয়নি।
এখানে দুই ধরনের নির্যাতনের চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। যৌন লালসার কারণে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি। অবশ্য ধর্ষণের পর হত্যাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। দ্বিতীয় ধরনের মধ্যে পড়ে পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুক নিয়ে নির্যাতন, ফতোয়াবাজের নির্যাতন, গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতন। ধর্ষণ উন্নত বিশ্বেও হয়। কিন্তু সেগুলোর বিচার ও শাস্তি হয়। আমাদের দেশে গরিব ঘরের মেয়ে প্রভাবশালীর ছেলে দ্বারা ধর্ষিত, এমনকি ধর্ষণের পর হত্যা করা হলেও বিচার হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে।
পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে নারী নির্যাতন অব্যাহত ধারায় চলে আসছে, তা সমাজের পশ্চাৎপদ অবস্থা নির্দেশ করে। তা আরও নির্দেশ করে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এটাই সবচেয়ে লজ্জার কথা। উন্নয়ন নিয়ে গর্ব করার আগে এই লজ্জা দূর করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। মৌলভীবাজারে নূরজাহান নামে এক কিশোরীকে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়েছিল। তার শরীর মাটিতে পুঁতে এই নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এরপরও আমরা কীভাবে নিজেদের সভ্য বলব?
নূরজাহানের মৃত্যু তখন বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তারপর ফতোয়াবাজি এবং একাধিক নারীকে প্রকাশ্যে দোররা (চাবুক) মারার ঘটনাও ঘটতে থাকে। ২০০১ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি গোলাম রব্বানী সুয়োমোটোভাবে ফতোয়া-সংক্রান্ত একটি মামলায় ফতোয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন। তার এক দশক পর সুপ্রিম কোর্ট সেই বিচারে ভিন্নমত প্রদান করেছেন। বলেছেন, ফতোয়া বৈধ, তবে তা কেবল শিক্ষিত আলেমরাই দিতে পারবেন। অবশ্য ফতোয়ার ভিত্তিতে শাস্তি প্রদান করা যাবে না। পারিবারিক জীবনে নারী স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকদের দ্বারা প্রহৃত ও নির্যাতিত হন। বালিকা-কিশোরী গৃহকর্মীরাও নির্যাতিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা প্রকাশ হয় না। এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। নারী আন্দোলনও জোরদার করা দরকার।
যে কথা দিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বলছিলাম, তনুই একমাত্র ঘটনা নয়। হ্যাঁ, তা-ই। কিন্তু তনুর ঘটনা দেখিয়ে দিল, যারা ধন ও ক্ষমতার দিক দিয়ে দুর্বল, তারা কত অসহায় থাকে। গত ২০ মার্চ তনুর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায়। কীভাবে সেখানে লাশ পড়ে থাকল? এই প্রশ্নের উত্তর এক মাসেও পাওয়া গেল না। ৩১ মার্চ পারিবারিক অবস্থা বিবেচনা করে পুলিশ সুপার বলেছিলেন, ধর্ষণের পর হত্যা হয়েছে বলে অনুমান হয়। প্রথম ময়নাতদন্তের দুই সপ্তাহ পর ৪ এপ্রিল রিপোর্ট জমা হয়। ধর্ষণ বা হত্যার কোনো চিহ্ন নাকি পাওয়া যায়নি। অনেক প্রতিবাদের পর দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করা হয়েছে, যার রিপোর্ট এখনো পাওয়া যায়নি। সবটাই রহস্যজনক। জনমনে সন্দেহ, প্রশাসন কোনো কিছু আড়াল করতে চাইছে। প্রথম দিকে তনুর মা ও নিকটাত্মীয় ছাড়া কাউকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। তনুর মাকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে থানায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের এই আচরণের অর্থ কী? তনুর বাবা নিম্ন আয়ের একজন সাধারণ কর্মচারী। তাই তনু হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার আশা করা যায় না। কারণ, যারা দুর্বল তাদের জন্য বিচার নেই এই দেশে।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান গত বছর আগস্ট মাসে এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকলে আইন তাকে স্পর্শ করে না।’ এবারও তনু হত্যার ব্যাপারে ‘জজ মিয়া’ নাটক যেন না হয়, সে জন্য তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সতর্ক করে ও পরামর্শ দিয়ে চিঠিও লিখেছেন।
কয়েক দিন আগে কে বা কারা তনুর ছোট ভাইয়ের বন্ধুকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। বেশ অনেক দিন তিনি নিখোঁজ ছিলেন। অবশেষে তাঁকে পাওয়া গেল শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায়। এসব ঘটনা ‘জজ মিয়া’ নাটকের মহড়া বলে সন্দেহ তৈরি করে। ২ এপ্রিল প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে তাই যথার্থই বলা হয়েছে ‘...উদ্বেগের বিষয় হলো মূল অপরাধীকে আড়াল করার কৌশলী চেষ্টার কথা গণমাধ্যমে আসছে। অতীতে স্পর্শকাতর মামলায় ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর আত্মরক্ষার চেষ্টার অংশ হিসেবে “জজ মিয়া” কাহিনির জন্ম হয়েছিল।’ তারপর সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়েছে, ‘দেশে ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের শীর্ষে তনুর ঘটনায় দেশবাসী কঠিন মানসিক ধাক্কা অনুভব করেছে।...এ অবস্থায় অপরাধীদের পার পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা বুমেরাং হতে বাধ্য।’
নারীর প্রতি সহিংসতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। আশা করি, সরকার ও বিচারব্যবস্থা যথাযথ ভূমিকা নেবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হলো জনগণ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম। তনু হত্যার সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে দেশের সর্বত্র স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা যেভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে, তা সাম্প্রতিক কালে অভাবনীয় ছিল। এখানেই আমি ভরসার জায়গা খুঁজে পাই।
লেখক: সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
সূত্র: প্রথম আলো, ২০ এপ্রিল ২০১৬