ইসলামে হিলা বিয়ে ও তাৎক্ষণিক তালাক
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০১৭, ১৬:০২
হিলা হল শরিয়া মামলা যাতে কোনো কারণে ফতোয়ার আদালত কোনো দম্পতির বিয়ে বাতিল ঘোষণা করেন। তারপর তাদের আবার বিয়ে দেওয়ার শর্ত হিসেবে স্ত্রীকে অন্য লোকের সঙ্গে বিয়ে ও সহবাসে বাধ্য করেন। দ্বিতীয় স্বামী স্বেচ্ছায় তালাক দিলে তবে সে আবার আগের স্বামীকে বিয়ে করতে পারে। এটা ঘটে প্রধানত স্বামী রাগের মাথায় স্ত্রীকে একসঙ্গে তিনবার তালাক বলে ফেলেছে বলে, তার কথা শোনার সাক্ষী কখনও থাকে, কখনও থাকে না। বাংলাদেশে এ সব দলিল ধরা আছে ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’এর বইতে ‘ফতোয়া ১৯৯১-১৯৯৫’।
ভারতে একবার খুব হইহল্লা হয়েছিল, কারণ এক স্বামী ঘুমের ঘোরে তিনবার তালাক বলে ফেলেছিল। এ খবর চাউর হলে স্থানীয় মওলানারা তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘোষণা করেন। অথচ সুরা বাকারা আয়াত ২২৯ মাফিক তালাক দিতে চাইলে স্বামীকে অন্তত দুবার ‘তালাক’ উচ্চারণ করতে হয়, তারপর ইদ্দত পার হলে আর উচ্চারণ না করলেও তৃতীয় তালাক প্রয়োগ হয়ে বিয়ে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু সে উচ্চারণ একসঙ্গে তিনবার করলে তালাক পুরো হয় কি না, সেটাই প্রশ্ন। কারণ হিলা বিয়ের শুরুটাই সাধারণত হয় সেটা দিয়ে।
এ নিবন্ধে আমরা দেখব এ ব্যাপারে শরিয়া আইন কী বলে, কোরান কী বলে, রাসুল (সা.) কী করেছেন, অন্য বিশেষজ্ঞেরা কী বলেন এবং বাস্তবে কী ঘটেছে ও ঘটছে।
১. শরিয়া আইন
“স্বামী তাহার স্ত্রীকে একই সময়ে একই বাক্যে অথবা পৃথক পৃথক সময় ও বাক্যে তিন তালাক দিলে তৎক্ষণাৎ বিবাহবন্ধন ছিন্ন হইয়া যায় এবং স্বামী তাহাকে ফিরাইয়া লইতে পারে না… স্বামীর সুস্পষ্ট বাক্যে অথবা পরোক্ষ বক্তব্যে অথবা ইশারা-ইঙ্গিতে অথবা লিখিতভাবে প্রদত্ত তালাক সঙ্ঘটিত হইবে… তালাক বলার সময় স্বামীর মনের যে সংখ্যা নির্ধারিত করে তাহা বা দেখানো আঙুল দিয়া তালাকের সংখ্যা ধরা যায়… যদি স্বামী বলে তোমাকে তালাক দিলাম, তবে বলিবার সময় স্বামীর মনে যে সংখ্যা থাকে তাহাই বলবৎ হইবে।”
সূত্র: বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৭, ধারা ৩৫১; পৃষ্ঠা ৪৮৩ ধারা ৩৫১; পৃষ্ঠা ৪৭৮ ধারা ৩৪৩; হানাফি আইন পৃষ্ঠা ৮১; শাফি’ই আইন পৃষ্ঠা ৫৬০ আইন নং এন.৩.৫; মওলানা মুহিউদ্দীনের বাংলা-কোরানের তফসির পৃষ্ঠা ১২৮; মওলানা আশরাফ আলী থানভীর ‘দ্বীন কি বাঁতে’ পৃষ্ঠা ২৫৪, আইন # ১৫৩৭, ১৫৩৮, ১৫৪৬ ও ২৫৫৫; ইউরোপিয়ান ফতোয়া কাউন্সিল ও ক্যানাডার মওলানার ফতোয়া ইত্যাদি।
স্বামী যদি অত্যাচারের চাপে, বা নেশার ঘোরে, বা রোগের কষ্টে অধীর হয়ে, বা হাসি-ঠাট্টায়, নোট লিখে বা টেলিফোনের অ্যান্সারিং মেশিনেও তালাক বলে রাখে তবু তালাক পুরো হয়ে যায়।
সূত্র: বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড ধারা ৩৪৭, ৩৪৯; হানাফি আইন, মওলানা আশরাফ থানভির ‘বেহেশতি জেওর’ থেকে শুরু করে ‘মকসুদুল মু’মেনিন’ ইত্যাদি।
তাৎক্ষণিক তালাকটা সাধারণত ঘটে রাগের মাথায়, তাই প্রায়ই তার সাক্ষী থাকে না। এ ব্যাপারে শরিয়া আইনটা হল, “তালাক সঙ্ঘটিত হওয়ার জন্য সাক্ষী শর্ত নহে।” (বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড ধারা ৩৪৪, পৃষ্ঠা ৪৭৮)
“বিয়ে ব্যতীত অন্য সব ব্যাপারে সমাধা করার জন্য সাক্ষী শর্ত নয়।” (মওলানা মুহিউদ্দিনের অনুদিত বাংলা-কোরানের তফসির, পৃষ্ঠা ১২৪)
এই শরিয়া আইন ঘোরতর ইসলামবিরোধী, কোরান, রাসুল (সা.) কোথাও কখনও সাক্ষীবিহীন তালাককে বৈধতা দেননি। দেখুন সুরা ত্বালাক আয়াত ১ ও ২:
“তোমরা যখন স্ত্রীদিগকে তালাক দিতে চাও তখন ইদ্দত গণনা করিও। অতঃপর তাহারা যখন ইদ্দতকালে পৌঁছে, তখন তাহাদিগকে উপযুক্ত পন্থায় ছাড়িয়া দিবে বা রাখিয়া দিবে এবং তোমাদের মধ্য হইতে দুইজন সাক্ষী রাখিবে।”
হাদিসেও আছে– রাসুলের (সা.) পরে এক সাহাবী সাক্ষী ছাড়াই তালাক দিলে অন্য সাহাবী বলেছেন এ তালাক বৈধ নয়।
২. রাসুল (সা.)
“এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন তালাক একসাথে দিয়েছে শুনে রাসুল (সা.) রাগে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, তোমরা কি আল্লাহর কিতাবের প্রতি ঠাট্টা করছ? অথচ আমি এখনও তোমাদের মধ্যেই রয়েছি!” (মওলানা মুহিউদ্দিনের অনুদিত বাংলা-কোরানের তফসির, পৃষ্ঠা ১২৭)
“এক সাহাবি তার স্ত্রীকে একসাথে তিন তালাক বলেছে শুনে রাসুল (সা.) বললেন, ‘এই তিন তালাক মিলে হল এক তালাক। ইচ্ছে হলে এই তালাক বাতিল করতে পার।’” (মওলানা ওয়াহিদুদ্দিনের ‘Women in Islami Sharia’তে ফতহুল বারীর সূত্রে, পৃষ্ঠা ১০৮ ও ১০৯)
এ ব্যাপারে বিপরীত হাদিসও আছে, যেমন: “একই সঙ্গে তিন তালাক দিয়ে নিষ্কৃতি লাভ করা যদিও রাসুলের (সা.) অসন্তুষ্টির কারণ, যা পূর্ববর্তী বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, এ জন্য সমগ্র উম্মত একবাক্যে একে নিকৃষ্ট পন্থা বলে উল্লেখ করেছে এবং কেউ কেউ নাজায়েযও বলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যদি কেউ এ পদক্ষেপ নেয়, তবে এর ফলাফলও তাই হবে বৈধ পথে অগ্রসর হলে যা হয়। অর্থাৎ তিন তালাক হয়ে যাবে, এবং শুধু প্রত্যাহার নয়, বিবাহবন্ধন নবায়নের সুযোগও আর থাকবে না।” (মওলানা মুহিউদ্দিনের অনুদিত বাংলা-কোরানের তফসির, পৃষ্ঠা ১২৭-১২৯)
“রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন তিনটি বিষয় এমন রয়েছে যে, হাসি-তামাশার মাধ্যমে করা ও বাস্তবে করা দুই-ই সমান। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে তালাক… হাসি-ঠাট্টার ছলে হলেও এবং অন্তরে বিয়ে, তালাক ও তালাক-প্রত্যাহারের ইচ্ছা না থাকলেও মুখের কথা দ্বারা বিয়ে, তালাক এবং প্রত্যাহার বাস্তবায়িত হয়ে যাবে… জবরদস্তি অবস্থায় যদিও সে তালাক দিতে আন্তরিকভাবে সম্মত ছিল না, অক্ষম হয়ে তালাক শব্দ বলে দিয়েছে, তবুও তালাক হয়ে যাবে।” (মওলানা মুহিউদ্দিনের অনুদিত বাংলা-কোরানের তফসির, পৃষ্ঠা ১২৮ ও ৭৫৮)
অর্থাৎ হাদিসে আমরা এ ব্যাপারে বিপরীত কথা পাচ্ছি। এটা নতুন কিছু নয়, হাদিসে এ রকম বহু স্ববিরোধীতা আছে। কিন্তু তালাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বিপরীত সুন্নত আমাদের জন্য যতটা লজ্জার কথা তার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। এ ক্ষেত্রে কী করতে হবে তা ইমাম শাফি বলেছেন, “পরস্পরবিরোধী দুইটি হাদিসের মধ্যে কোনটি বেশি নির্ভরযোগ্য তাহার বিচার অন্য সুন্নত দ্বারা বা কোরান দ্বারা হইবে।” (ইমাম শাফির বিখ্যাত কেতাব ‘রিসালা’, পৃষ্ঠা ১৮২)
৩. কোরানে যাওয়ার আগে ‘অন্য সুন্নত’
সহি মুসলিম হাদিস ৩৪৯২ উদ্ধৃতি: “আবু সাহবা ইবনে আব্বাসকে (রা.) বলিলেন, ‘আপনি কি জানেন যে আল্লারর রাসুলের (সা.) সময়ে, হজরত আবু বকরের সময়ে এবং হজরত ওমরের (রা.) প্রথম তিন বছরের খেলাফতকালে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে এক তালাক ধরা হতো?’ ইবনে আব্বাস (রা.) বলিলেন, ‘হ্যাঁ’।” (এই একই হাদিস আছে ৩৪৯১ ও ৩৪৯৩-তে ও সুনান আবু দাউদেও)
আসলে শরিয়ার এ আইন বানানো হয়েছে নবীজির (সা.) অনেক পরে– এ কথা বলেছেন বেশ কয়েকজন বিশ্ববিখ্যাত শরিয়া সমর্থকই। যেমন: “নবীজির মৃত্যুর বহু পরে তালাকের এক নূতন নিয়ম দেখা যায়। স্বামী একসাথে তিন তালাক উচ্চারণ করে বা লিখিয়া দেয়। এই তালাকে অনুতাপ বা পুনর্বিবেচনার সুযোগ নাই। অজ্ঞ মুসলমানেরা এইভাবে গুনাহ্ করে। নবীজি তীব্রভাবে ইহাতে বাধা দিয়াছেন।” (বিশ্ববিখ্যাত শরিয়াবিদ ড. আবদুর রহমান ডোইয়ের ‘শরিয়া দি ইসলামিক ল’, পৃষ্ঠা ১৭৯)
“নবীজির সময় থেকে শুরু করে হজরত আবু বকর ও হজরত ওমরের সময় পর্যন্ত একসাথে তিন তালাক উচ্চারণকে এক তালাক ধরা হত। কিন্তু যেহেতু লোকে তাড়াতাড়ি ব্যাপারটার ফয়সালা চাইত তাই হজরত ওমর একসাথে তিন তালাক বৈধ করেন এবং এই আইন চালু করেন।” (মওলানা ওয়াহিদুদ্দিনের ‘Women in Islami Sharia’, পৃষ্ঠা ১১০)
নারীর জীবন ও সন্তান-সংসার এতটুকু সুতোর ওপর ঝুলে থাকতে পারে না এবং মাতৃজাতিকে এভাবে অপমান করে কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। মানুষ রাগের মাথায় ভুল করতেই পারে, তাকে সে ভুল সংশোধনের সুযোগ দিয়ে ভানো মানুষ বানানোই ইসলাম। অনেক কঠিন অপরাধের তওবার সুযোগ দিয়েছে ইসলাম, দিয়েছেন রাসুল (সা.)। তাই মুখ ফসকে দুটো কথা বের হয়ে গেলে তার আর মাপ নেই, এটা হতে পারে না। তাই তাৎক্ষণিক-তালাক কোরানবিরোধী। সে জন্যই মরক্কো, সিনেগাল, তিউনিসিয়া প্রভৃতি বহু মুসলিম দেশ আইন করে এই বর্বর প্রথা বেআইনি করেছে। (Documenting Women’s Right Violations by Non-State Actors – by WLUML – পৃষ্ঠা ৭০)
পুরো তালাকের পর স্বামী-স্ত্রীর পুনর্বিবাহের ওপরে কি কোরানের অন্য কোনো নির্দেশ আছে যা দিয়ে আমাদের ইমামরা মা-বোনের ওপর এই অপমান আর অত্যাচার বন্ধ করতে পারেন? অবশ্যই আছে।
সুরা বাকারা আয়াত ২৩২: “যখন তোমরা স্ত্রীদিগকে তালাক দাও ও তাহারা নির্ধারিত ইদ্দত পূর্ণ করে, তখন পারস্পরিক equitable (সাম্য, সমঝোতা, যৌক্তিক….)-র ভিত্তিতে তাহাদের (পূর্বের) স্বামীর সহিত বিবাহে বাধা দিও না”
“দুটি প্রেমময় হৃদয়ের মধ্যে বিয়ের চেয়ে ভালো আমি আর কিছু দেখি না” (সহি ইবনে মাজাহ, ৩য় খণ্ড, হাদিস ১৮৪৭)
এই হলেন আমাদের বিশ্বনবী। তাঁর এই বিশাল উপদেশ কে কোথায় ডাকাতি করল? ভ্রান্তিময় মানুষ ভুল করতেই পারে, কিন্তু অনুতাপের পরে স্বামী-স্ত্রী, বাচ্চাদের জীবন ধ্বংস হবে কেন? যে নারীকে তাৎক্ষণিক তালাকের মধ্যে পড়ে পর-পুরুষ দ্বারা ধর্ষিতা হতে হয় তার অপমান, তার ক্ষোভ-দুঃখ কবে আমরা বুঝব? এ কোন ইসলাম যে নিরপরাধের জীবন এত নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস করে? কবে সরকার আইন প্রয়োগ করার মতো শক্তিশালী হবে, কবে আমাদের ইসলামি দলগুলো এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে, কবে গ্রামেগঞ্জের ইমাম-চেয়ারম্যানেরা এর বিরুদ্ধে শক্ত হয়ে দাঁড়াবে, কবে মাদ্রাসা-শিক্ষকেরা এ সব তত্ত্ব-তথ্য সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করবেন, জানি না।
তবে যতদিন তা না হবে ততদিনই আমাদের মা-বোনেরা জাতির চোখের সামনে নিপীড়িতা হতে থাকবেন এবং ততদিনই আমরা পিছিয়ে থাকব। আমি ইসলামি দলগুলোকে আহ্বান করছি এখনই এই নিষ্ঠুর ইসলামবিরোধী প্রথা বন্ধ করতে। আর মা-বোনদের আহ্বান জানাচ্ছি প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে, আমরা সঙ্গে আছি।
লেখকের ‘শারিয়া কী বলে, আমরা কী করি’ বইয়ের “হিলা বিয়ে ও তাৎক্ষণিক তালাক” অধ্যায় থেকে সংক্ষেপিত। http://hasanmahmud.com/index.php/books/sharia-ki-bole
লেখক: ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেসের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, মুসলিমস রিফর্ম মুভমেন্ট ও আমেরিকান ইসলামিক লিডারশিপ কোয়ালিশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য