একটি ললিউড আর জঙ্গিবাদ‬

প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০১৬, ২১:২২

মেহেদী হাসানের গজল শুনে আমার ছোটবেলা কেটেছে। নুরজাহান শুনেছি। পাকিস্তানের সংগীতশিল্পীদের গানের ক্যাসেট ছিল আমার বাসায়। “দামা দাম মাস্ত কালান্দার” গান বাজিয়ে নাচতাম! তখন উর্দু বুঝি না, জাতীয়তাবোধ বুঝি না। গান বুঝি, সুর বুঝি। অনেক পরে যখন বুঝেছি, তখনও দামা দাম মাস্ত কালান্দার শুনেছি। পার্থক্য এই যে রুনা লায়লার গলায় শোনা শুরু করেছিলাম! 

শভেনিস্টরা হয়ত এই বেলায় ছাগু বা পাকিপ্রেমী বলে গালি দিতে পারে। আমি মেহেদী হাসানের গজল শুনি এখনো। আজকেও শুনেছি। “দুনিয়া কিসি সে পেয়ার” গান ইউটিউবে বের করে দেখছিলাম। ভেবেছিলাম নায়িকা কোন ঘোমটাওয়ালী থাকবে। আমায় অবাক করে নায়িকা মাথার চুল ছেড়ে ফুলবনে নায়ক ওয়াহিদ মুরাদের সঙ্গে নাচছে। দেখে টাশকি খেলাম। 

বাংলাদেশের প্রখ্যাত পরিচালক বেবি জামানের প্রথম মুভি ছিল উর্দু ভাষার ‘তালাশ’। রহমান আর শবনাম ছিলেন ললিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রী। রুনা লায়লা তার জীবন শুরু করেছেন উর্দু গানের মাধ্যমে। পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তারা বাংলাদেশে আসেন। আমার প্রসঙ্গ এটা নয়। 

আমার প্রসঙ্গ ললিউড। লাহোর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। দেশভাগের পর যতটা ছিল বলিউড, ততটা ছিল ললিউড। আজ ২০১৬ সালে মাত্র ১০টা মুভি বের হয় এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে। তাও ভয়ে ভয়ে, চুপিসারে! পাকিস্তানি মুভি মুক্তি পায় বাইরের দেশে। নিজ দেশে নয়। অথচ ৬০ এবং ৭০ দশকের মুভি দেখলে কেউই বলিউড আর ললিউডকে আলাদা করতে পারবে না!

পাকিস্তান চিরন্তন ডানপন্থী দেশ। তবুও এর কৃষ্টি সংস্কৃতি উপমহাদেশীয় আচারে পুষ্ট ছিল। কিন্তু ১৯৮০ সালে জেনারেল জিয়াউল হকের মিলিটারি ডিক্টরশিপ চালু হয়। পাকিস্তানের ন্যাশনাল টিভি পিটিভিতে সব ধরণের গানবাজনা বন্ধ করে শুধু দেশাত্মবোধক গান প্রচার শুরু হয়। অথচ এই পিটিভিতে গান গেত নুরজাহানের মত কিংবদন্তীরা। শুধু তাই নয় জিয়াউল সমস্ত সিনেমা হলের উপর কর আরোপ করল। অবস্থা বেগতিক হতে হতে হলগুলো বন্ধ হয়ে গেল।

মিউজিক বন্ধ, ফিল্ম বন্ধ! জঙ্গি তৈরি হবার পারফেক্ট পরিবেশ! জিয়াউল সরকার আফগানদের সহায়তা করতে মুজাহিদ টিম সৃষ্টিতে মদত দিল। যার পরবর্তী রুপ আল কায়েদা বাহিনী। 

পাকিস্তানের এই উদ্ভুত পরিস্থিতি বাঁচিয়েছিল রক মিউজিশিয়ানরা। যারা ছিল বামপন্থী এবং পিংক ফ্লয়েড, লেড জিপলিন দ্বারা অনুপ্রাণিত। তাদের তৈরি ব্যান্ডই একমাত্র জাতির সংস্কৃতির দিশা হয়েছিল। নাজিয়া হাসান, জোহেব হাসান, জুন্নুন, স্ট্রিংস ব্যান্ড তাদের রক মিউজিকের মাধ্যমে এক অভিনব প্রতিবাদে নেমেছিল স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। আজ অবধি পাকিস্তানের মিউজিক বলতে সেই রক ব্যান্ড আর সম্প্রতি কোক স্টুডিও।

কিন্তু ললিউড? নাহ! বেনজীর ভুট্টো এলেও ললিউডের কপাল ফেরেনি। গতবছর 'বিনা রয়' নামে একমাত্র ব্যয়বহুল ছবি বানিয়েও বড় ধরণের ধাক্কা খেয়েছে। পাকিস্তানের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এখনো লড়াই করে যাচ্ছে নিজেদের পুরানো দিনগুলো ফিরে পেতে। 

এ থেকে কি বোঝা যায়? এক জাতিকে শেষ করতে চাইলে তার সুস্থ বিনোদন মাধ্যমগুলো শেষ করে দেওয়াই যথেষ্ট। বোঝা যায়, এক দেশের মানুষ তখনই জঙ্গি হয় দলে দলে যখন তাদের ভিতর কালচারের ছাপ থাকে না। যখন তারা বই পড়ে না, টিভি দেখে না, গান শুনে না! 

এইবার শভেনিস্টের মত বলি, এই পাকিস্তানের সামরিক শাসকরাই রবীন্দ্রসংগীত বাজানো বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল সেই ৫২ সালে, ভাষা আন্দোলনের আগে। রবি ঠাকুরকে নিয়ে তাদের চুলকানি ছিল অনেক। কারণ রবিঠাকুর যে সুবিশাল রচনা রেখে গেছেন আমাদের জন্য, সেটাই শুধু পড়লেই বাংলার এবং উপমহাদেশীয় কৃষ্টিকে বোঝা সম্ভব!

হিস্টোরি রিপিটস ইটসেলফ! ঢালিউড বহু বহু গুণ এগিয়ে গেছে পাকিস্তান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির চাইতে। আর ললিউড চুপি চুপি ১০টা মুভি রিলিজ দেয়। দর্শক থাকে না। বোম খাওয়ার ভয়ে। একেই বলে পাশার দান উলটে গেছে মামা! 

কে জানে! হয়ত ললিউড আগের জায়গায় ফিরে গেলে ও দেশের যুবকেরা বোমা ছেড়ে ক্যামেরা নিয়ে ছুটবে!

মারজিয়া প্রভা'র ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত