কিন্তু ধর্ম যখন সন্ত্রাসের হাতিয়ার?
প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০১৬, ০০:২৭
হাইস্কুল আর কলেজের যে ছেলেগুলি অত জন লোকের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে কোরান মুখস্থ ধরে সাচ্চা মুসলিম কি না পরীক্ষা করছিল, মুসলিম হয়েও মেয়েরা কেন হিজাব পরেনি তার খবর নিচ্ছিল, তারা কে কী কেন, এই সব খবর নেওয়ার ভার এখন বাংলাদেশ প্রশাসনের। যারা তাদের অস্ত্র জোগান দিল, তারাই বা কে কী কেন, সে খবরও প্রশাসনকেই নিতে হবে। কিন্তু একটা কাজ বোধহয় তারা করে উঠতে পারবে না। ওই ছেলেগুলি কেন মানুষ মারার কাজটাকেই শ্রেষ্ঠ ধর্মাচরণ বলে ভাবছিল, সেটা বোঝা, ভাবা, তার সমাধান করা তাদের কর্ম নয়। বাংলাদেশ কেন, দুনিয়ার কোনও দেশের প্রশাসনের সাধ্য নেই সেটা করার।
রমজানের মাসে নমাজ না পড়ে যারা মানুষ খুন করতে ব্যস্ত হয়, তারা কেমন মুসলিম, প্রশ্ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুরোধ করেছেন, ছেলেমেয়েরা ধর্মের নামে কী শিক্ষা পাচ্ছে বাড়ির লোকরা যেন দেখেন। ক’দিন আগে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিও বলেছেন, রমজান মাসে হত্যাকাণ্ডই বলে দেয়, কে ভাল মুসলমান কে নয়। বলেছেন, এই পার্থক্য করার কাজটা অসম্ভব জরুরি হয়ে পড়েছে, সকলে মিলে সেটা করতে হবে। ঠিক বলেছেন দু’জনই। এটা প্রশাসনের কাজ নয়। সমাজ পরিবার পরিজনের কাজ। ধর্মের নামে ভয়ানক ব্যাপ্ত ও গভীর মগজধোলাই যে সমস্যার মূলে, ‘সরকার কী করছে’ বলে বসে থাকলে সে সমস্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বেই।
গত দুই সপ্তাহে কাশ্মীর ইস্তানবুল ঢাকা বাগদাদ সর্বত্র— মুসলিমরা কেন যথেষ্ট ‘মুসলিম’ নন, ‘মুসলিম সমস্যা’র প্রতি যথেষ্ট সমর্থনপূর্ণ নন, সহিংস রক্তবন্যার পিছনে এটাই অজুহাত। হ্যাঁ, অজুহাত। প্রতিটি হানার পিছনে অবশ্যই আরও বড় সব হিসেব আছে। টাকার, ক্ষমতার, রাজনীতির। কিন্তু সব হিসেবের সামনে ‘বর্ম’ রূপে থেকেছে ধর্ম। ধর্মের সঙ্গে সন্ত্রাসের যে সত্যি কোনও সম্পর্ক নেই, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরা এ কথা জানি। কিন্তু ধর্মকে যে সন্ত্রাস অবাধে ব্যবহার করে চলে, সেটাও তো জানি। মুশকিল হল, অনেক সময় এই জানাটা আমরা উচ্চারণ করি না শুভবোধের প্রসারে ব্যাঘাত ঘটার ভয়ে। আর সেই নীরবতার অবকাশে, ধর্মের সীমাহীন অপব্যবহারকারীদের হাতই আরও শক্ত করি।
আজ আর কথাটা না বলে উপায় নেই। বাংলাদেশ তো দূরের যে-কোনও-দেশ নয়! সেই মাটিতে এমন ঘটনা ঘটল যার সঙ্গে ২৬/১১-র মুম্বই-কাণ্ডের তুলনা চলে, অথচ প্রশিক্ষিত জঙ্গির বদলে সাধারণ শিক্ষিত ঘরের ছেলেমেয়েরাই সেটা ঘটিয়ে ফেলতে পারল? এর পরও আমরা আলোচনা করব না ইসলাম-এর এই অপার অপব্যবহার নিয়ে?
একই ভাবে, আমরা প্রায়শই মুখ ফুটে বলি না যে, ‘অমুকের বাড়িতে গরুর মাংস আছে, চল ওদের জবাই করি’ এই মনোভাবের মধ্যে যে ‘ধর্ম’ নেই, তা-ও যেমন ঠিক, এ-ও আবার ঠিক যে, এক রকমের ধর্ম-ধর্ম খেলা এতে আছে অবশ্যই। যে লোকগুলি লাঠিসড়কি় নিয়ে ওই পরিবারকে মারতে গেল, তাদের অনেকেই নিশ্চয় মনে মনে ভাবছিল, গোমাংস ‘অধর্ম’, আর অধর্মকে খতম করাই পুণ্য? তাদের যদি আমরা কেবল গুন্ডা বলি, আংশিক সত্য নয় সেটা? গুন্ডামির পিছনে তাদের উদ্দাম অসহিষ্ণু ‘হিন্দু’ মনটাও তো মানতে হবে? আর তাই, ‘জঙ্গির কোনও ধর্মপরিচয় হয় না’, আজও যদি এইটুকু বলেই থেমে যাই, এই জঙ্গিদের উদ্দাম অসহিষ্ণু ‘মুসলিমত্ব’কে যদি না দেখি, ‘ইসলাম’ কী ভাবে সন্ত্রাসের হাতে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেই কথাটা না বলি, আকাশ অন্ধকার করে বিপদ আমাদের গলা টিপে ধরবে, খুব তাড়াতাড়ি।
দারিদ্র, অসাম্য, অত্যাচার, অবহেলা, সংস্কৃতির বিরোধ— ভুল, বিকৃত ধর্মবোধের প্রসারের পিছনে বহু কারণ থাকে এবং আছে। কিন্তু আগে এই কারণগুলোর প্রতিকার, তবেই ‘ভুল ধর্ম’-এর সঙ্গে যুদ্ধ, এই যুক্তিপরম্পরাটা আর এক বার ফিরে ভাবা দরকার। ইতিহাস বলে যে এই বৃহত্তর প্রতিকারের কাজটা ন্যায্য ও জরুরি, কিন্তু তাতে জয়ের সম্ভাবনা স্বল্পই। জয় আসবে না জেনেই কাজটা চালাতে হয়, চালাতে হবে। কিন্তু ধর্মের যুদ্ধটা তত দিন মুলতুবি রাখব, এমন ভাবলে কেবল সময় নষ্ট, অন্য পক্ষকে জিতে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া। অথচ সেকুলাররা অনেক সময়ই এই যুদ্ধের গুরুত্বটা স্বীকার করেন না। এই যেমন, সে দিন কাশ্মীরে মেহবুবা মুফতির কথা শুনে সেখানকার ‘সেকুলার’ নেতা, ন্যাশনাল কনফারেন্স-এর প্রধান ওমর আবদুল্লা বললেন, মেহবুবা যে ‘মন্দ মুসলিম’-এর কথা বলছেন, এতেই স্পষ্ট যে তিনি সন্ত্রাসের সঙ্গে ইসলামকে এক করে ফেলছেন। আশ্চর্য! জঙ্গিরা অবাধে ইসলামের ধুয়ো তুলে নিজেদের কাজ সারবে, কিন্তু তারা যে ইসলামকে কলুষিত করছে, এটুকু বলাও হবে ইসলামের বিরুদ্ধতা? মুফতি কিন্তু ইসলামের পক্ষেই লড়ছিলেন। সন্ত্রাস বন্ধ করার জন্যই ইসলামকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করার কথা বলছিলেন। ভারতীয় নেতাদেরও কারও কারও বলা দরকার যে, হিন্দু ধর্মকে বাঁচানোর জন্যই রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদের কবল থেকে ধর্মকে ছিনিয়ে আনা জরুরি। ধর্মবিশ্বাসী হিন্দু মুসলমান সমাজকেই করতে হবে এই কাজ।
সে দিন একটি নাটক দেখতে দিয়ে এ কথা আবারও মনে হল। সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘আগশুদ্ধি’ নামে সেই নাটকে ধর্ম-সংস্কারে আপাদমস্তক নিমজ্জিত এক চরিত্র বলছিলেন: আমি তো মানুষের ভাল হবে বলেই ধর্মের এই সব সংস্কারে বিশ্বাস করি, কিন্তু এতে যদি মানুষের অমঙ্গলই হয়, তবে কিছুই আমার চাই না। হয়তো আজকের এই বিপন্ন সময়ের ধ্বস্ত মন নিয়ে দেখছিলাম বলেই কথাটা জোর ধাক্কা দিয়ে গেল। ধর্ম যাঁরা মানেন, এমনকী সংস্কারও যাঁরা মানেন, তাঁরা সবাই কি অবিশ্বাসী বা অন্য-বিশ্বাসীদের ধ্বংস বা ক্ষতির সাধনা করেন? না। তাঁদেরই কিন্তু এখন এগিয়ে আসা দরকার প্রতিবাদে। বাংলাদেশের অসহিষ্ণু মৌলবাদ ছড়াচ্ছে অতি দ্রুত। ঘরে-বাইরের বহু অর্থসম্পদ তাকে সাহায্য করতে ব্যস্ত। ভয়ঙ্কর সেই গোলকধাঁধার হাত থেকে ছেলেমেয়েদের কী ভাবে বাঁচানো যায়, সেটা শুধু প্রশাসন কিংবা সেকুলার নাগরিকরা ভাবলেই চলবে না। স্বঘোষিত ধার্মিকদেরই বোঝাতে হবে, ধর্মপ্রাণ আর ধর্মান্ধ, দুটো কথার দূরত্ব কত যোজন।
পথটা সহজ নয়। কিন্তু পথান্তরও নেই। যে মানুষটি দিনের আলোয় ঘিঞ্জি মধ্যবিত্ত পাড়ার দোকানের খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে নির্বিরোধী বই-প্রকাশককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে চলে যায়, কিংবা হঠাৎ সকালে এক বৃদ্ধ লেখকের বাড়ি সদলবল চড়াও হয়ে তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলে, তাদের আটকানোর সামর্থ্য কোনও পুলিশ-প্রশাসনের নেই। বরং তারা জোরাজুরি করে ‘আটকানো’র চেষ্টা করলে সন্ত্রাস দ্রুত ফিনিক্সের রূপ নেবে, প্রতি রক্তবিন্দু থেকে নতুন করে ফুঁসে উঠবে।
পুলিশ-প্রশাসনের অবশ্য অন্য একটা কাজ ছিল, আছে, থাকবে— যে কাজ তারা কখনও করে উঠতে পারবে না, রাজনীতির চক্করে যে কাজ সমানেই ভেসে চলে যাবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আজ পর্যন্ত কর্নাটকের কালবুর্গি বা দাদরির আখলাকের হত্যাকারীদের শাস্তি দেওয়ার কথা বলেননি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আজও এত জন ব্লগার-হত্যার শাস্তির ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি। ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার গত দুই বছরে যে ভাবে বেড়ে গিয়েছে, বিজেপি সরকারের তাতে প্রত্যক্ষ মদত আছে। আর বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের সঙ্গে যে কাণ্ড চলছে, হাসিনা সরকার তাতে চোখ বুজে থাকাই শ্রেয় মনে করছে। আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ নতুন নয়। তাদের ভয়টাও সহজবোধ্য। বিরোধী দল বিএনপি আর কট্টর ইসলামি সংগঠনের যোগাযোগ যাতে আরও সমৃদ্ধ না হয়, সেই ভয়েই তারা কত কিছু করে উঠতে পারে না। সবটাই রাজনীতির লাভক্ষতি। সমাজের লাভক্ষতি ভাবার অভ্যেস বা প্রয়োজন কোনও দেশের কোনও রাজনীতিরই নেই কি না।
হয়তো একমাত্র নাগরিকরাই তাঁদের সেটা করতে বাধ্য করতে পারেন। ঘুরে ফিরে প্রশ্নটা তাই আবার প্রশাসন থেকে সমাজের দিকেই আসে। এবং শেষ অবধি যে কিছুই করা যাবে না, সেটাই বুঝিয়ে দেয়। ঠিকই তো, প্রশাসন তার কাজ করুক, এই চাপ নাগরিকরা যদি না দেন, হিসেবের খেলা থেকে রাজনীতিকরা বার হতে যাবেনই বা কেন, কোন স্বার্থে? আর, যে নাগরিকরা নিজেদের সমাজের অন্যায়-অবিচার, নিজেদের ধর্মের দোষত্রুটির কথাই মনে সাহস এনে বলে উঠতে পারেন না, তাঁরা সেই চাপ দেবেনই বা কেন? কী করে?
প্রথম প্রকাশ: আনন্দবাজার