নিহন দিনের গল্প
প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ২২:১৪
“আপনারা কেউ কি 'কমফোর্ট উইমেন' এর নাম শুনেছেন?!”
প্রশ্ন করেই, প্রফেসর আমাদের দিকে নজর বুলিয়ে গেলেন। আমি তো এখানেও ফার্স্ট টেবিলে বসে ক্লাস করি! সেখান থেকেই মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, শুনেছি!! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, ক্লাসের কেবল আমিই মাথা ঝাঁকাচ্ছি!!
কাকতালীয় ভাবে, দুইদিন আগেই একটা আর্টিকেল পড়তে যেয়ে 'কমফোর্ট উইমেন' নজরে আসে আমার। খুব বিস্তারিত পড়িনি, তাই ক্লাসে আর পটরপটর করলাম না। শুধু বললাম, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারে জাপান আর্মি দ্বারা ভিক্টিম হওয়া নারীদের কমফোর্ট উইমেন নাম দেয়া হয়েছে। ... যা হোক, প্রফেসর এতেই খুশি! কেননা এবার উনি বিস্তারিত বলতে পারবেন, যা বলছিলেন!!
ভাষা শেখাবার পাশাপাশি এখানে রুটিন করে ডিপ্লোম্যাসির উপর ক্লাস হয় আমাদের। ওসাকা উনিভার্সিটি থেকে নামজাদা প্রফেসররা এদ্দূর এসে ক্লাস নিয়ে যান। এবং বিশ্বের আর সকল উন্নত দেশের মত এই বুদ্ধিজীবীরাও নির্ধিদ্বায় সরকারের সমালোচনা, ইতিহাসে নিজের দেশের ভুল-ভ্রান্তি, কিংবা বর্তমানের পদক্ষেপ নিয়ে নিরপেক্ষ মতামত দেন অনায়াসেই।
প্রায়ই অবাক হই; একটা প্রচ্ছন্ন 'দেশপ্রেম বোধ' নিয়ে চলতে আমরা সবাই ভালোবাসি, দেশ নিয়ে অহংকারকেও স্বাগত জানাই, অন্তত বিদেশিদের সামনে দেশের সমালোচনা তো, নৈব নৈব চ!! কিন্তু এরা অন্যরকম। জাপানের অনেক অন্ধকার দিক, অপমান কিংবা ভুলের গল্প কি নির্বিচারে আমাদের শুনিয়ে যাচ্ছে যে কোন ক্লাসেই। এই যেমন আগ বাড়িয়ে এতো 'বিব্রতকর' একটা প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন ক্লাসে ... 'কমফোর্ট উইমেন'!!
চোখটা বন্ধ করে যখন পৃথিবীর ইতিহাস নিয়ে ভাবি, সেই আদ্যিকাল থেকে... প্রেম–ভালোবাসা-আবিস্কার-সৌহার্দ্য-সভ্যতার পাশাপাশি কানে বাজে একের পর এক যুদ্ধেরও দামামা। অস্ত্রের ঝলকানি, রক্তের স্রোত আর আর্তের কান্না!! বিশ্ব ইতিহাসে মানুষ যেমন দিনে দিনে মানব হয়েছে, তেমনি মানুষই কালে কালে দানব সেজেছে!! কোন দেশ নেই আজতক যুদ্ধ ছাড়া– সংঘাত ছাড়া– সংগ্রাম ছাড়া!! আর সেটা যেই দেশ হোক, যেই ধর্ম হোক, যেই জাতি হোক ... গুলি করে মানুষ মারুক– বা পুড়িয়ে মারুক– কিংবা জবাই করুক ... যতই পার্থক্য অত্যাচারের ধরনে থাকুক না কেন, একটা ব্যাপারে বিশ্বের কোথাও কোন ফারাক নেই!! বলেন তো কি সেটা?!
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। নারীর প্রতি সহিংসতায়। নারী নিগ্রহে!!
সংঘাত মানে, অরাজকতা মানে, বিশৃঙ্খলা মানেই সেখানে আর কিছু হোক না হোক, নারী নির্যাতন হবেই হবে। কোনটা যুদ্ধের মধ্যে শত্রুপক্ষের প্রতি জিঘাংসা থেকে, কখনো স্বাধীনতা চাওয়া জাতির হৃদয়ে আঘাত করার জন্য, কোনটা শত্রুর মনোবল নষ্ট করার জন্য, তো কখনো কেবলই ভোগের জন্য নারী অপমানিত হয়েছে– কষ্টে আর কান্নায় জর্জরিত হয়েছে সকল জেনোসাইডে, সকল আগ্রাসনে, সকল দমনে– নিপীড়নে।
আমার ধর্ম শান্তির ধর্ম– সাম্যের ধর্ম, তাতেও কি ছাড় দেয়া হয়েছে?!! যুদ্ধের পর শত্রুপক্ষের নারীরা “বিয়ে করা বউয়ের মর্যাদা” পেয়েছে, ... মানে, পিতার হন্তারকের সাথে– কিংবা স্বামীর হন্তারকের সাথে– কিংবা ভাইয়ের হন্তারকের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক! হয়ত এর চেয়ে ভালো কোন উপায় ছিল না তাদের কপালে, কিন্তু এই কি করে ‘ভালো' বলা যায়!
অত্থাৎ, বিশ্বের কোন দেশ– কোন জাতি– কোন ধর্মই এই মানবতাবিরোধী অপরাধের অপরাধী হওয়া থেকে মুক্ত নয়– ভিক্টিম হওয়া থেকে মুক্ত নয়!! জাপানীরাও অন্য সকল দেশের মত তাই করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে– এটা কি আর এত 'বিগ ডিল'!!?
কথিত আছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিভিন্ন ক্যাম্পে ক্যাম্পে ইম্পেরিয়াল জাপান আর্মির মনোরঞ্জনের জন্য কোরিয়া, ফিলিপাইন, চায়না থেকে মেয়েদের জোর করে বা চাকরি দেবার কথা বলে পাঠানো হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারাত্মক ভাবে পরাজিত দেশ, জাপানের হিসেবে সংখ্যাটা ২০ হাজার। জাতিসংঘের হিসেবে ২ লক্ষ। আর অত্যাচারিত দেশগুলোর হিসেবে সাড়ে তিন থেকে চার লক্ষ নারীকে 'কমফোর্ট উইমেন' হতে হয়েছে। সে সব ক্যাম্পে দীর্ঘ যুদ্ধের ডামাডোলে অযত্ন-অবহেলায়-অকথ্য নির্যাতনে তাদের অনেকেই মারা গেছে, অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে, অনেকেই অবর্ণনীয় দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে নিভৃতে পার করেছে বাকি জীবন। লজ্জাকর–গোপন কান্না বয়ে চলেছে সেই তখন থেকে। এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?!
যুদ্ধের শহীদের জন্য ওয়ার সিমিট্রি হলেও, যুদ্ধে সম্ভ্রম হারানোর জন্য সিমেট্রি কে কবে বানিয়েছিল, বলেন!!?
কিন্তু জানেন, কোরিয়া কি করেছে?!!
সেই সত্তর বছর আগের নিগৃহিতা’দেরকে টেনে এনেছে!! ২০১২ সাল থেকে তারা বছরের একটি দিন পালন করছে 'কমফোর্ট উইমেন মেমোরিয়াল ডে' হিসেবে। জাদুঘর বসিয়েছে তাদের স্মৃতি ঘিরে। বলেন, জাপানের জন্য বিব্রতকর কিনা?!
সান ফ্রান্সিস্কো এর পার্কে সেখানের প্রবাসী কোরিয়ানরা মূর্তি বসিয়েছে 'কমফোর্ট উইমেন' এর। দেখাদেখি নিউজার্সি, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানির কোরিয়ান প্রবাসিরাও গাঁটের পয়সা খরচ করে তাই করেছে! জাপানের জন্য কি অপমান!
সম্প্রতি কোরিয়া তাদের পাবিলিক বাসের প্রথম সিটে একটা ১৩ বছরের বাস্তব 'কমফোর্ট উইমেন' এর চরিত্রের ব্রোঞ্জের পুতুল বসিয়ে দিয়েছে!! গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ পাচ্ছে এসব কাহিনী!! আর শেষে তো চূড়ান্ত বেজ্জতি হয়েই গেলো!! ২০১১ সালেই কোরিয়ার রাজধানী সিওলের দূতাবাস পাড়ায় জাপানের দূতাবাসের সামনে ঘটা করে উন্মোচন করা কমফোর্ট উইমেন এর হৃদয়স্পর্শি স্ট্যাচুটি জাপান সরকারের বহু অনুনয়– আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেবার অনুরোধের পরেও আজতক সেখানেই আছে!
প্রতিবেশী জাপান ও কোরিয়া- দুইদেশের প্রায়শই টালমাটাল এবং নানা রকম বিশ্বাস অবিশ্বাসে ভরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আগুনে আরও ঘি ঢেলে দিচ্ছে সত্তর বছর আগে ঘটে যাওয়া এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপাঙতেয় বীরাঙ্গনা-বালিকাদের বিশাল একটি ‘ইস্যু’!! কোরিয়ার দাবি একটাই, টাকা চাই না– ক্ষতি পূরণ চাই না!! কেবল ক্ষমা চাও! আমাদের মেয়েদের সামনে ক্ষমা চাও! আমাদের বোনদের সামনে ক্ষমা চাও! আমাদের মায়েদের সামনে ক্ষমা চাও!!
কি বোকা, এই কোরিয়ান গুলো!! বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কেউ কথা বলে নাকি?!! তাদের কাছে কেউ ক্ষমা চায় নাকি?!!
পুনশ্চঃ এই পৃথিবীর পরে একটা আজব দেশ আছে। আপনারা হয়ত ভুলে গেছেন!! ছেচল্লিশ বছর আগে এক 'গণ্ডগোল' হয়েছে সেখানে। সেই সময়ে ত্রিশ লক্ষ মানুষ মরেছে নাকি তিন লক্ষ মরেছে– সেই নিয়ে জাতি দ্বিধাবিভক্ত হলেও কতজন নারী নিগৃহিতা হয়েছেন, সেই হিসাব দুইলক্ষের বেশী, সেটা নিয়ে কেউই কোন দ্বিধায় নেই। দেশটিও এখন মাশাল্লাহ অনেক উন্নতির দিকে যাচ্ছে। পঞ্চাশ বছরে পা দিচ্ছে, স্বাধীনতার আসল- নকল- সিজনাল, সকল চেতনায় উজ্জিবিত সে দেশের মানুষ।
কিন্তু জানেন, সেখানের কেউ ভাবেই না তাদের বীরাঙ্গনাদের নিয়ে! তাদের জন্য কোন দিবসও নেই। ক্ষমা চাইবার দাবি নেই। আর ভাস্কর্য?! স্ট্যাচু?!! ... ওমা! কি লজ্জার কথা!!
মাত্র, ছেচল্লিশ বছর!! এমনি এক ডিসেম্বরে যে স্বাধীনতার সূর্য উঠেছিল সে দেশে, সেই দেশে বীরাঙ্গনাদের ‘স্বাধীনতা’ আজো আসে নি!! ওদের ‘বিজয়’ আজো হয় নি! সে দেশটিকে ভুলে যান! দেশটি বোধহীন!!
তাহসিনা আফরিন এর ফেসবুক থেকে