সুন্দরবনে হবে টেলিটকের টাওয়ার, বসবে জেনারেটর!
প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:২৮
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন বাংলাদেশের সুন্দরবন। কিন্তু এর উপর থেকে মানুষের আগ্রাসী চোখ যেন সরছেই না। সুন্দরবনের কাছেই রামপালে কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন কতটুকু যৌক্তিক সেই আলোচনার মীমাংসা না হতেই এখন খোদ সুন্দরবনের সংরক্ষিত অঞ্চলের ভেতরেই টাওয়ার, জেনারেটর সহ নানা স্থাপনা গড়ার পরিকল্পনা চলছে। আর বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এর উদ্যোক্তা সরকারি খাতের মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটক।
সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকার আটটি স্থান- সাতক্ষীরা জেলাধীন দুবেকি, কাবিখালি, পুষ্পকাঠি, নটাবেকী, মান্দারবাড়ীয়া; বাগেরহাট জেলাধীন চর দুয়ানী, কোকিল মণি ও কচিখালীতে টাওয়ার স্থাপনের অনুমতির জন্য ইতোমধ্যেই বন বিভাগকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে টেলিটক।
গত ৮ ডিসেম্বর প্রধান বন সংরক্ষককে দেওয়া চিঠিতে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আগামী মার্চের মধ্যে সুন্দরবনের ওই আট এলাকায় মোবাইল ফোনের টাওয়ার স্থাপনের কাজ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। অন্যথায় বর্ষা মৌসুমে বিরূপ ও প্রতিকূল পরিবেশে কোনোভাবেই কাজ করা যাবে না।
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পাশাপাশি গিয়াস উদ্দিন টেলিটকের টাওয়ার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করছেন।
কিন্তু এমন সংরক্ষিত এলাকায় কেন এই টাওয়ার স্থাপনের পরিকল্পনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে টেলিটক যুক্তি দেখাচ্ছে বনদস্যু দমন, বন বিভাগের কর্মীদের মধ্যে সহজে যোগাযোগ স্থাপন, গহিন বনে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক স্থাপনই এর উদ্দেশ্য। এখানেই শেষ নয়, টাওয়ার স্থাপনের পর তা পরিচালনার জন্য টেলিটক সুন্দরবনের ভেতরে তেলচালিত জেনারেটরও স্থাপন করার চিন্তা করছে। এর আগে ২০১৪ সালেও সুন্দরবনের কটকা, মোংলাসহ তিনটি এলাকায় টাওয়ার স্থাপন করে টেলিটক। কিন্তু এবারের এই আটটি এলাকা ওই তিন এলাকার চেয়েও বেশি বাঘ, হরিণ, পাখি, ডলফিন ও অন্যান্য বন্য প্রাণীর সমন্বয়ে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ ফলে পরিবেশগতভাবে বেশি সংবেদনশীল ও সমৃদ্ধ। এসব এলাকায় অবকাঠামো নির্মাণ তো বটেই, যে কারও প্রবেশাধিকার পর্যন্ত নিষিদ্ধ।
এ সংক্রান্ত আইনে বলা আছে, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী মোবাইল ফোনের টাওয়ারের মতো বড় স্থাপনা লাল ক্যাটাগরির। এমন স্থাপনা করার আগে প্রাথমিক পরিবেশগত পরীক্ষা (আইইই) করে প্রাথমিকভাবে অবস্থানগত ছাড়পত্র নিতে হবে। তারপর প্রকল্পের পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা প্রতিবেদন (ইএমপি) করতে হবে। এরপর পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা প্রতিবেদন (ইআইএ) করতে হবে। এসব জমা দেওয়ার পর পরিবেশ অধিদপ্তর তা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পর্যালোচনা করে অনুমোদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়। এই অনুমোদন পেলেই প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান ও অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু করা যায়।
২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সচিব কামাল উদ্দিন আহমেদ (বর্তমানে স্বরাষ্ট্রসচিব) সব মন্ত্রণালয়ের কাছে লিখিতভাবে ওই তিনটি সমীক্ষা প্রতিবেদন করার পর যেকোনো প্রকল্পের কাজ শুরুর জন্য বলেছিলেন।
অথচ এমন সংরক্ষিত অঞ্চলে এতো বড় প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিলেও আইন অনুযায়ী এখনো এই তিনটির একটির প্রতিবেদনই করেনি টেলিটক।
যদিও প্রকল্পটির উপপরিচালক রেজাউল কবির জানান, মার্চের আগেই তারা সব ধরনের সমীক্ষা ও অনুমতি নিয়েই টাওয়ার স্থাপন করবেন।
এই ব্যাপারে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দেশের বিদ্যমান পরিবেশ ও বন আইনের আলোকেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব। তবে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনাকেও আমরা এ ক্ষেত্রে আমলে নেব’।
অন্যদিকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী শাহজাহান মাহমুদ এই প্রসঙ্গে কিছু জানেন না বলে এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রাণীবিদ ড. আনিসুজ্জামান খান বলেন, বনদস্যু দমন, বন বিভাগের কর্মীদের মধ্যে সহজে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য টাওয়ার বসানোর যে যুক্তি দেখিয়েছে টেলিটক তা হাস্যকর। বর্তমানে পৃথিবীতে বহু ধরনের ডিভাইস আছে যোগাযোগের জন্য যাতে টাওয়ার বসানোর প্রয়োজন হয় না। আবার শক্তিশালী ওয়ারলেসও ব্যবহার করা যায়।
তিনি বলেন, সুন্দরবন একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এমন কোন কিছু করা ঠিক হবেনা যা সামান্যতম হুমকি হয় সুন্দরবনের জন্য।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. গাজী আসমত বলেন, সুন্দরবনে টাওয়ার বসালে কি ধরনের সমস্যা হবে সেটা গবেষণা না করে বলা যাবে না। তবে জেনারেটর বসানোর পরিকল্পনা একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। সুন্দরবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মৌমাছি। মৌমাছি না বাঁচলে এই পৃথিবীই বাঁচবে না। তাই মৌমাছির ক্ষতির আশঙ্কা আছে এমন কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করা যাবে না। সুন্দরবন যেভাবে আছে ঠিক সেভাবেই রাখার কোন বিকল্প নেই। তাছাড়া পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়া সুন্দরবন এলাকায় কোন ধরনের পরিকল্পনাও করাও উচিৎ নয়।