সিনেমা রিভিউ
প্রাক্তনের শিক্ষা
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২৩:৫৭
সবার মুখে মুখে 'প্রাক্তন' ছবির প্রশংসা শুনে একটু দেরিতে হলেও ছবিটা দেখে ফেললাম। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ ‘প্রাক্তন’ কবিতা আবৃত্তি করেছেন শুনে খুব দেখার লোভ হচ্ছিল। ছবির অসাধারণ গান আর ট্রেইলরে অসাধারন দৃশ্যায়ন দেখে আমি আসলেই মুগ্ধ তাই দেখার আগ্রহ দ্বিগুণ হল।
ছবির শুরু হয় ট্রেনের যাত্রা দিয়ে। যেখানে একটি নববিবাহিত জুটি আমাদের হাসির যোগান দেয়। তাদের কমেডি দৃশ্যে তারা সফলভাবে দর্শককে বিনোদন দিতে পেরেছে। ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়’ আর ‘সাবিত্রি দেবী’র মত শক্তিমান অভিনেতা আর অভিনেত্রীর উপস্থিতি অথচ একজনের কবিতা পড়ার জন্য আর আরেকজনের ভুলভাল হিন্দি বলা ছাড়া আর বিশেষ কোন ভূমিকা দেখলাম না। যাই হোক ছবিতে পরিচালক তাদের মানিয়ে নিয়েছেন। 'ভূমি' 'অনুপম'-দের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে একটি আলাদা আকর্ষণ সৃষ্টি করে ছবিকে প্রাণ দেয়। কিন্তু ছবিকে নিষ্প্রাণ করে দেয় ছবির মূল ভিত্তি ছবির 'থিম’।
যেখানে গল্প গড়ে ওঠে ছবির তিন প্রধান চরিত্র ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত (সুদীপা), প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায় (উজান) আর অপরাজিতা (মালিনী) এই তিনজনকে ঘিরে।
উজানের প্রথম স্ত্রী সুদীপা যার সাথে উজান সংসার করতে পারেনি, পরে তার জীবনে আসে মালিনী যে তাকে সুখে সুখে ভরে রেখেছে। ট্রেনে কাকতালীয়ভাবে দুজন এক কামরায়।
যেখানে একদিকে সুদীপা একজন আত্মনির্ভরশীল, স্বাধীনচেতা, নির্ভীক, সাহসী ও প্রতিবাদী চরিত্র অন্যদিকে মালিনী টিপিক্যাল হাউস ওয়াইফ যার নিজের কোন পরিচয় নেই স্বামীকে ধ্যান-জ্ঞান করে পরগাছা হিসেবে বেঁচে থেকে সুখী। যে খুব কৌশলী এবং সবকিছুতে মানিয়ে নেয়াতে বিশ্বাস করে। যৌতুকের জন্য তার বাবা বিয়ে ভেঙে দেয় শুনে আপাতদৃষ্টিতে তার বাবাকে প্রতিবাদী মনে হলেও, টাকা ছাড়া বিয়ের শর্তে ডিভোর্সি ছেলের সাথে বিয়ে দেয়ার ঘটনায় বোঝা যায় কোনোমতে মেয়েকে বিদায় দিলেই বাঁচেন টাইপ কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা। এবং তার যোগ্য মেয়ে “যা দিবে তার দ্বিগুন পাবে” “অ্যাডজাস্টমেন্ট মানে হেরে যাওয়া নয় বরং জিতে যাওয়া” এ ধরণের প্রবাদ দিয়ে হাজার বছর ধরে মেয়েদের দাবিয়ে রাখার এবং ভালমানুষীর আড়ালে মেয়েদের অন্যায় সহ্য করে যাওয়ার ভ্রান্ত আদর্শে বিশ্বাসী মালিনী। এবং ছবির পরতে পরতে সুদীপা এসব শিক্ষা গ্রহণ করে এবং নিজের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে মালিনীর দীক্ষায় দীক্ষিত হতে থাকে।
ছবিতে একদিকে সুদীপার সাথে থাকাকালীন ‘উজান’ যে কিনা স্ত্রীর প্রতি চরম উদাসীন। স্ত্রীর সফল ক্যরিয়ারে ঈর্ষান্বিত হওয়া, বউকে প্রোপার্টি ভাবা, সন্দেহ করা, সময় না দেয়া, অশ্রাব্য কথা বলা আর চরম অবহেলা করা যার কাজ। যে কিনা তার পরিবারে কুসংস্কারের শিকার স্ত্রীর মিসক্যারেজে তার পাশে থাকতে পারে না। স্পেশাল ডে- স্ত্রীর জন্মদিন যার কাছে মূল্যহীন, অথচ এই বউকে সে ভালবেসে বিয়ে করেছে; সেই এক উজানই পারিবারিকভাবে বিয়ে করা দ্বিতীয় স্ত্রী মালিনীর প্রতি খুব যত্নশীল, মেয়ে তার প্রাণ, সন্তান জন্মের সময় থেকে শুরু করে সন্তান বেড়ে ওঠা অব্দি একজন দায়িত্বশীল পিতা ও বর। যে কিনা মালিনীর জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিতে একদম অর্ধযাত্রায় নাটকীয়ভাবে ট্রেনে হাজির।
এরপর যদি দেখা যেত সুদীপা চলে যাওয়ায় সে নিজের ভুল বুঝতে পারে এবং যে ভুল প্রথম বিয়েতে করেছে তা দ্বিতীয় বিয়েতে করেনি তাহলে ঠিক ছিল। কিন্তু ছবিতে দেখানো হয়েছে মেয়েদের মানিয়ে নিতে হয়, সুদীপার মত ক্যারিয়ারিস্টিক নয়, মালিনীর মত চাকরি বাকরি ও নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে সংসার করাই বিয়ে টিকিয়ে রাখার মূল চাবিকাঠি। যার নিজের জন্য কোন সময় থাকবে না, নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা থাকবে না, বরের অনুমতিবিহীন কোন কাজ করবে না কোথাও যাবে না, এবং সবসময় পাকাগিন্নীবান্নি হবে। অতীত বর্তমান দোলাচলে সুদীপা ভাবতে থাকে কেন সে নিজ থেকে নিজ খরচে কাশ্মীর বেড়াতে যাবার ব্যবস্থা করলো- মালিনীর মত বছর তিনেক অপেক্ষা করলেও পারতো। তার কেন ভাল উপার্জন ছিল? সেই টাকায় কেন বরকে ভালবেসে কিছু দিতে গেল? এতে তো বরের মনেই হতে পারে সে টাকার গরম দেখাচ্ছে। সে তো মালিনীর মত বরের গায়ে হাত পা ছেড়ে দিতে পারতো, বর যেমন রাখবে তেমন থাকতো। বিনিময়ে বর তার কথা শুনে অধিক উপার্জনক্ষম হবে, তাকে সারপ্রাইজ দিবে, তার ও সন্তানের খেয়াল রাখবে ও হ্যাঁ আর বাজার করবে।
এসব দেখে সুদীপা মরমে মরে যেতে থাকে, সে কেন মালিনীর মত করলো না, সে কেন স্বাধীনচেতা, প্রতিবাদী হল! তাহলে তো উজান তারও খেয়াল রাখত, তার মিসক্যারেজ হত না- পুতুলের মত তারও একটা সন্তান থাকতো, তার জন্মদিনেও কেক কাটত, সারপ্রাইজ দিত।
ছবির রন্ধ্রে রন্ধ্রে সুদীপাকে অনুশোচনায় জ্বলতে দেখে চরম বিরক্তির উদ্রেক হয়। যদি দেখাতো বন্ধুর মায়ের মৃত্যুতে উজানের থেকে যাওয়া নিয়ে ওভাবে ওভাররিয়েক্ট করায় সে অনুতপ্ত তাও একটা কথা ছিল। কিন্তু না, এখানে দেখানো হয়েছে তার মানিয়ে নেয়া, কম্প্রোমাইজ করার অভাবেই উজান তার সাথে এমন অমানুষ ছিল। যে কিনা নিজে দিনের পর দিন বাইরে থাকত আর বউ কাজ থেকে দেরি করে ফিরলে মাতাল হয়ে নোংরা ভাষায় গালাগাল দিত আর সেই উজান মালিনীর কাছে এমন লক্ষিটি যে কিনা বউকে ধমকই দিতে পারে না। ছবিতে উজানকে একবারও অনুতপ্ত হতে দেখা যায় নি, বরং সে সুখী মালিনীর মত বউ পেয়ে। যে কিনা স্বামী-শ্বশুরবাড়ি ছাড়া কিছু বুঝে না, যার আলাদা কোন ব্যক্তিসত্তা নেই। প্রাক্তন স্ত্রীর প্রতি বরের আকর্ষণে চুপ থাকে তাদের একান্ত সময় দেয়, চোখ থাকিতে অন্ধ- দেখিয়াও দেখিলাম না-শুনিয়াও শুনিলাম না টাইপ হয় আর উজানকে পেয়ে ধন্য হয়। সুদীপাকে একা ভেবে উজান কিছুটা সমব্যথী হয় এবং তার ভুল ছিল তাও স্বীকার করে কিন্তু সে পরিবর্তন হয় মালিনীর মত বউ পেয়ে তাও বুঝিয়ে দেয়। আর পুরো ছবি জুড়ে সুদীপার 'হায়-হায়' 'হা-হুতাশ'।
ছবির শেষে দেখা যায় সুদীপারও সংসার হয়। তার এই বর তাকে প্রাইভেসি দেয়–স্পেস দেয়। তার কথামত কাজের সময় বিরক্ত করে না, আর বউয়ের খেয়ালও রাখে, তাকে স্টেশনে আনতে যায়। সুদীপার বরকে দেখে উজানের বেজার হবার কারণ বোঝা যায় কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ে করেও পুরো ছবি জুড়ে সুদীপার এমন অসুখী, মরণাপন্ন মুখছবি কেন? তার সন্তান হয় নি তাই, নাকি সে ডিভোর্সি ট্যাগ নিয়েছে তাই? নাকি সুদীপার মত মেয়েরা প্রথম, দ্বিতীয় কোন সংসারে সুখী হতে পারে না তাই?
এখানে যেন পরিচালিকা ও পরিচালক (নন্দিনী রায় ও শিবপ্রসাদ মুখপাধ্যায়) সচেতনভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন মেয়েদের বেশি বাড় বাড়তে হয় না, তাদের চার দেয়ালের ভিতরেই থাকতে হয়, বরের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাতে হয়। মালিনীর মত হলে সংসার টিকবে আর সুদীপার মত হলে দুঃখে জীবন যাবে। খুব সুন্দর গান, দৃশ্যপট, কমেডি, আবৃত্তি ,অভিনয়দক্ষতা দিয়ে এসব বস্তাপচা শিক্ষা দিতে চেয়েছে ছবিটি। আমাদের সুশীল সমাজও যে ঠিক এইটাই চিন্তা করে এর বড় প্রমাণ এই ধরনের বাজে ছবির জয়জয়কার। প্রাক্তনে মূলতঃ নারী স্বাধীনতা, অস্তিত্ব ও আত্মসম্মানকে পদদলিত করা হয়েছে এবং তা যৌক্তিক ও বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা করা হয়ে এর অসাধারণ উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে।
লেখক: ফ্রিল্যান্সার