কি ছিল সেই 'অশ্লীল' চিত্রে?
প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০১৭, ১৮:৩৫
শ্রেণীকক্ষে ‘অশ্লীল চিত্রের’ মাধ্যমে পাঠদানের অভিযোগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ড. মো. রিয়াজুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান জানান, শিক্ষার্থীরা অশ্লীল চিত্র প্রদর্শনের অভিযোগ করলে সিন্ডিকেটের সভায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্তের পর এ নিয়ে প্রতিবাদ উঠে অনেক সচেতন মহলে। ফেসবুক সহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন উঠে, শ্লীল-অশ্লীল যেখানে আপেক্ষিক ব্যাপার সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে জেন্ডার স্টাডিজ পড়াতে গিয়ে এমন কোন চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে যাকে অশ্লীল আখ্যা দিয়ে এই শিক্ষককে বহিষ্কৃত করা হল?
সাবেক ছাত্র নেতা বাকি বিল্লাহ ফেসবুকে লিখেন, "অভিযোগ এসেছে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। খবরটা গতকালেই শুনেছি, শোনার পর থেকে বিভ্রান্ত হয়ে আছি। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এখন যে গড়পড়তা মান তাতে জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় স্বাভাবিক কন্টেন্টকেই অশ্লীল মনে হতে পারে তাদের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কথা কী আর বলবো?"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী কামরুস সালাম সংসদ ফেসবুকে লিখেন, "জেন্ডার স্টাডিজ বিষয়টাকে পরিপূর্ণভাবে পড়াতে হলে এই সোসাইটির লেবাসের চোখে অশ্লীল বলে গণ্য হতে পারে, এমন অনেক কিছুই চলে আসাটা স্বাভাবিক। যেমন ধরুন- নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা বোঝাতে আর পর্ন ইন্ডাস্ট্রির বৈশ্বিক অর্থনীতি, রাজনীতি আর ভয়াবহ সহিংস রূপটা আপনি সংশ্লিষ্ট টেক্সট, ডকুমেন্টারি না পড়িয়ে, দেখিয়ে কিভাবে বুঝাবেন, পড়াবেন? মেডিক্যাল সায়েন্স পড়তে গিয়া ছেলে মেয়েরা একসাথে ছুরির নিচে নগ্ন দেহ দেখে না? তখন কী শ্লীলতা-অশ্লীলতা বিবেচনায় থাকে?"
সেসময় কোন মিডিয়াতেই অভিযুক্ত শিক্ষকের কোন বক্তব্য কিংবা অভিযুক্ত সেই স্লাইডে কি ধরণের 'অশ্লীল চিত্র' ছিল তা প্রকাশ না হলেও অবশেষে সেই অভিযুক্ত শিক্ষকের কাছ থেকেই পাওয়া গেলো অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত সেসব লেকচার এর কিছু কপি।
সেখানে দেখা যায় 'Gender Development Empowerment & Public Policy: Bangladesh Perspectives’ শিরোনামের একটি লেকচারের কভার পেজে সুপ্রীম কোর্টে বিএনপিপন্থী নারী আইনজীবীদের উপর চড়াও হওয়া এক ছাত্রলীগ কর্মীর প্যান্টের চেইন খোলা ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে। যার পর্যবেক্ষণে তিনি লিখেছেন, লিঙ্গ বৈষম্যের ক্ষেত্রে অধিকাংশ পন্থাই বাস্তবায়নে মন্ত্রিসভার সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। তিনি আরো লিখেন, শিক্ষানীতিতেও পাঠ্যক্রমে নারী ও পুরুষের প্রথাগত চিত্রই ফুটে ওঠে। এমনকি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণেও নারীর বহুমুখী কর্মকাণ্ডকে তুলে ধরা হয় না।
'Gender Relation: Violence Against Women in Bangladesh’ নামক লেকচারের শুরুতে একটি কোটেশন আছে। তাতে লেখা “In Bangladesh, women are not safe anywhere, neither at home, nor at workplace, police stations nor court premises”। একই লেকচারে উঠে এসেছে নারীদের নিয়ে নানা ধরণের ট্রল এর মাধ্যমে নারীর প্রতি পুরুষের নেতিবাচক মনোভাবের কথা। নারীর উপর বিভিন্ন দেশে অত্যাচার নির্যাতনের জরিপের পাশাপাশি তুলে ধরা হয়েছে নারীর আন্দোলনের ইতিহাসও যেখানে নাঙ্গেলির আন্দোলন নিয়ে জাগরণীয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
Challenges for Women’s Movement in Bangladesh: Islam and NGO Politics শীর্ষক লেকচারে উঠে এসেছে এদেশে নারীদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে অন্তরায় হিসেবে কিভাবে ইসলামী দলগুলো দাঁড়িয়ে আছে। একইসাথে শহরভিত্তিক কিছু বেসরকারি সংগঠন যারা নারী উন্নয়নের কথা বললেও মূলত এদের সেবা ও সুযোগ সুবিধা কিভাবে শহরের সুবিধাভোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে সেই আলোচনাও করা হয়েছে।
এছাড়া The Body Politics: Prostitution, Sexuality and the Law in Bangladesh লেকচারে উঠে এসেছে হিজড়া, যৌনকর্মীদের কথা ও এদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি।
Body Politics: LGBT and the Law in Bangladesh লেকচারে উঠে এসেছে সমকামীদের কথা।
অভিযুক্ত শিক্ষকের এসব লেকচার দেখে সাবেক ছাত্র নেতা বাকি বিল্লাহ বলেন, "নারীর উপর সহিংসতা বোঝাতে গিয়ে আক্রান্ত নারীর নগ্ন কাঁধ দেখানো যদি অশ্লীল হয় তবে সবচেয়ে ভালো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে জেন্ডার পড়ানো বন্ধ করা হলে"।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং প্রগতি লেখক সংঘের নেতা অভিনু কিবরিয়া ইসলাম বলেন, "এর চাইতে অশ্লীল সিদ্ধান্ত আর হয় না। অশ্লীল রিয়াজুল হক নন, অশ্লীল ঢাবি প্রশাসন"।