এসো পা বাড়াই (১৯ তম পর্ব)
প্রকাশ : ১৫ এপ্রিল ২০১৭, ২১:১৯
"মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে সাথে নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত, কিন্তু কেন? ফেসবুক এর চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ (Sheryl Sandberg) এর বই 'Lean In'- এ তিনি দেখিয়েছেন এ সমস্যার মূলে কি, কিভাবে নারীরা নেতৃত্ব অর্জন করতে পারে, তার পূর্ণ ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারে। তার নিজের জীবন এবং পাশ্চাত্যের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও সারা পৃথিবীর নানা পরিসংখ্যান আর গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে তিনি এই বইকে সমৃদ্ধ করেছেন সমস্ত মানব জাতির জন্য। আমার আন্তরিক ইচ্ছা বাংলাদেশের মানুষও এই বই পড়ে উপকৃত হোক। সেই ইচ্ছা থেকেই অনুবাদের এই প্রচেষ্টা। ইতোমধ্যেই ২০টিরও অধিক ভাষায় এই বইয়ের অনুবাদ করা হয়েছে। এই বইয়ের নামে একটি আন্তর্জাতিক চক্রও গড়ে উঠেছে (http://leanin.org/) যেখানে সারা পৃথিবী থেকে যে কেউ চাইলে যুক্ত হতে পারে। মূল বইয়ে রেফারেন্স গুলোর বিস্তারিত দেয়া আছে।"
LEAN IN এসো পা বাড়াই
WOMEN, WORK AND THE WILL TO LEAD নারী, কাজ এবং নেতৃত্বের ইচ্ছা
WRITER: SHERYL SANDBERG অনুবাদ: আফরিন জাহান হাসি
টেবিলে বস
কয়েক বছর আগে ফেসবুক অফিসে আমি একটি মিটিং এর আয়োজন করেছিলাম, ট্রেজারি সচিব টিম গাইদনার (Tim Geithner) এর জন্য। অর্থনীতি নিয়ে আলোচনার জন্য পুরো সিলিকন ভ্যালি থেকে আমরা ১৫ জন এক্সিকিউটিভকে সকালের নাস্তার দাওয়াত দিয়েছিলাম। সচিব গাইদনার তার কর্মীদের চার সদস্য নিয়ে এসেছিলেন, দুইজন সিনিয়র ও দুইজন অপেক্ষাকৃত জুনিয়র। আমরা সবাই আমাদের একটি মনোরম সম্মেলন কক্ষে জড়ো হয়েছিলাম। সাধারণ কথাবার্তার পর আমি অংশগ্রহণকারীদের সবাইকে বুফে নিতে এবং বসতে উৎসাহ দিচ্ছিলাম। আমাদের আমন্ত্রিত অতিথিদের, বেশিরভাগ পুরুষরা দ্রুতই প্লেট আর খাবার নিয়ে বড় কনফারেন্স টেবিলে বসে পড়লেন। সচিব গাইদনারের দলের সবাই ছিলেন নারী, তারা সব শেষে খাবার নিয়েছিলেন এবং ঘরের কোণে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসেছিলেন।
আমি নারীদের জন্যে ইশারা করেছিলাম টেবিলে এসে বসতে, তারা যেন সাদরে অভ্যর্থিত অনুভব করে তাই হাত নাড়ছিলাম। তারা উঠে আসতে সংকোচ করছিল এবং ঐ চেয়ারেই বসেছিল।
ঐ চারজন নারীর পুরো অধিকার রয়েছে এই মিটিং এ থাকার, কিন্তু তাদের পছন্দ করা আসনের কারণে মনে হচ্ছিল যেন তারা দর্শক, অংশগ্রহণকারী নয়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার অবশ্যই কিছু বলা উচিত। তাই মিটিং শেষ হওয়ার পর আমি তাদেরকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম, কথা বলতে। আমি সুনির্দিষ্ট করে বলেছিলাম যে তাদেরকে আমন্ত্রণ করা না হলেও তাদের টেবিলে বসা উচিত ছিল, আর যখন প্রকাশ্যে স্বাগত জানানো হলো তখন অবশ্যই তাদের যোগ দেয়া দরকার ছিল। প্রথমে মনে হলো তারা আশ্চর্য হয়েছে, শেষে তারা একমত হয়েছিল।
আমার জন্য এটা ছিল এক চরম মুহুর্ত। সেই মুহুর্ত, যখন আমি সাক্ষী হয়েছিলাম কিভাবে অভ্যন্তরীণ বাধা নারীদের আচরণ পরিবর্তন করতে পারে। সেই মুহুর্ত, যখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও নারীদের নিজের ভেতরেই যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়।
কর্মক্ষেত্রে নারীরা কিভাবে সাফল্য পেতে পারে তা নিয়ে টেড টক (TED Talk) এর বক্তৃতায়, কিভাবে নারীরা নিজেদের আটকে রাখে তা ব্যাখ্যা করতে আমি এই গল্পটি বলেছিলাম, আক্ষরিক অর্থেই নারীরা দূর থেকে দেখাটাই পছন্দ করেছিল। নারীদের এই পছন্দ এখনও আমাকে একইরকম আশাহত করে। সেই সাথে এই নিরাপত্তাহীনতাও আমি গভীরভাবে উপলদ্ধি করি যা এই ঘরের কোণে তাদের চিত্রিত করেছিল এবং আঠার মত ওই চেয়ারে আটকে রেখেছিল।
কলেজের উপরের বর্ষে আমি ফাই বিটা কাপ্পা অনার সোসাইটি (Phi Beta Kappa honor society) তে অভিষিক্ত হয়েছিলাম। ঐ সময়ে হার্ভার্ড (Harvard) আর রেডক্লিফ (Radcliffe) ছিল আলাদা অধ্যায়, তাই আমার অনুষ্ঠান ছিল শধু মেয়েদের জন্য। ওয়েলেসলি সেন্টার ফোর উইম্যান (Wellesley Centers for Women) এর ড. পেগী ম্যাকিনটশ (Dr. Peggy McIntosh) প্রধান বক্তা হিসেবে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, 'প্রতারণার মত অনুভুতি' ('Feeling Like a Fraud') শিরোনামে। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, অনেকেই বিশেষ করে নারীরা, তাদের অর্জনের জন্য প্রশংসিত হলে, নিজেদেরকে প্রতারণাপূর্ণ মনে করে। তারা যে স্বীকৃতির যোগ্য, এই অনুভূতির পরিবর্তে তারা অযোগ্য এবং অপরাধী বোধ করে, যেন একটা ভুল হয়ে গেছে। অনেক অর্জনের পরেও, এমনকি নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও নারীরা মনে হয় এই অনুভূতি ঝেড়ে ফেলতে পারে না। সীমিত দক্ষতা আর যোগ্যতা দিয়ে বেশি অর্জন করে ফেলার এই জারিজুরি অল্পতেই প্রকাশ হয়ে যাবে এমন বোধ তাদের তাড়া করে ফেরে।
(চলবে...)